Select Page

ঢাকা অ্যাটাক : আমাদের সিনেমার নতুন দিগন্ত

ঢাকা অ্যাটাক : আমাদের সিনেমার নতুন দিগন্তScore 0% Score 0%

মুভি : ঢাকা অ্যাটাক
পরিচালনা : দীপঙ্কর দীপন
কাস্ট : শতাব্দী ওয়াদূদ, আরিফিন শুভ, মাহি, এবিএম সুমন প্রমূখ।
IMDb রেটিং : 9.1/10 (820+ votes)
সতর্কতা : ??#Spoiler_Alert.. ??

কীভাবে শুরু করব ভুমিকা? প্রথম লাইনে আমার কি লেখা উচিৎ সেটা ভাবতে ভাবতেই কয়েক মিনিট চলে গেল। আসলে যখন কেউ প্রত্যাশার থেকে অনেক বেশি পায় তখনই তার অবস্থাটা এমন হয়, কী রেখে কী বলবে খুঁজে পায় না। ঠিক তেমনই এই মুভিটা, বর্তমানে আমাদের দেশেও ভালো মুভি হয় বাট সেটা কমার্শিয়াল মুভির বাইরে, বাট একদম বাণিজ্যিক মুভিতেও আমাদের দেশে এত ভালো করা সম্ভব ঠিক কল্পনায় ছিল না।

ছোটবেলা থেকে মুভি/ফিল্ম/ছবি এগুলার প্রতি চরম আসক্ত আমি, সেই আসক্তি সময়ের সাথে সাথে ডাল-পালা মেলে তার সীমা পৃথিবীর সব ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে ঠেকেছে, অন্য দশজনের মতো অনেক বড় মুভিখোর না হলেও নিজেকে মুভিখোর মনে করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

বলছিলাম আসক্তি…. হ্যাঁ যেহেতু শৈশব কেটেছে দেশের মুভি দেখে, সো দেশের ভালো মুভির প্রতি আলাদা আগ্রহ সবসময়ই থাকে, এলাকার সিনেমা হলের পর্দা পরিবেশ ভালো না থাকায় কখনো প্রতিক্ষীত মুভি দেখার জন্যে দৌড়াই ৯০ কিলো দূর ঢাকায় নয়তো ৭০/কিলো দূর ফরিদপুর। মুভি দেখার পর যখন এই কষ্টগুলা সার্থক হয়। মনে হয় যেন রাজ্য জয় করেছি।

সেই সুবাদে ৬ তারিখ প্রথম দিনেই ১২টার শো’তে গিয়ে উঠি মতিমহল সিনেমা হলে। নির্দিষ্ট টাইমে মুভি শুরু হয়…। মুভি দেখে বের হওয়ার সময় যা ভিড় ছিল বলার বাইরে আমার বেরুতেই কষ্ট হচ্ছিল। ভালো মুভি হলে অবশ্যই দর্শক গ্রহণ করবে এটা তার আরেকটা প্রমাণ।

আসলে কেউ যদি আমায় জিজ্ঞেস করে মুভি কেমন লেগেছে?? তাহলে আমি এক কথায় উত্তর দেবো ‌‘১২০টাকা দিয়ে টিকিট কেটে মুভি দেখে বেরিয়ে আসার পর মনে হয়েছে টিকিটের দাম অনেক কম হয়ে গেল না? এই মুভির জন্যে আরো তিন/চার ডবল দাম উচিৎ ছিল টিকিটের।’

গল্প/প্লট : এতে কোনো সন্দেহ নেই গল্প ছিল পুরোপুরি মৌলিক, এবং আর দশটা থ্রিলার মুভির গল্পের মতো করেই মুভিটার গল্প এগোয়, খুনের পর খুন, দেশ আতঙ্কিত পুলিশ চিন্তিত, খুনিকে ধরার জন্যে চলতে থাকে একেকটা মিশন। শেষ পর্যন্ত কী হয়? উত্তর সিনেমা হলে।

ডিরেকশন : মুভিটার মুল হিরোই পরিচালক, আমি ক্ষণে ক্ষণে অবাক হয়েছি একটা লোক তার প্রথম ডিরেকশন দিয়ে কিভাবে এতোটা সুন্দর মুভি তৈরি করতে পারে? আমাদের ঢালিউড ‘থ্রিলার’ শব্দের সাথে তেমন পরিচিত নয়, সো কেউ যদি বর্তমানে আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘থ্রিলার’ কাকে বলে? এক কথার উত্তর থাকবে ‘ঢাকা অ্যাটাক’কে।

পুরো মুভিতে পরিচালক থ্রিল শব্দের যথাযথ ব্যবহার করেছেন, রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশ পুরো মুভিতেই রেখেছেন তিনি, দর্শকের চোখ পুরোটা সময় পর্দায় আটকে থাকতে বাধ্য থাকবে।

আসলে আমি অভিভূত কাজটা দেখে, একজন পরিচালক তখনই পুরো সার্থক যখন দর্শককে পুরো সময়টা সিনেমা হলে থাকতে বাধ্য করবে। সেটা পেরেছেন এই পরিচালক। কয়েক বছর অপেক্ষার মধুর অবসান দিয়েছেন তিনি। তিনি চেয়েছেন ভিন্ন কিছু করতে। পেরেছেন। কিছু দুর্বলতা ছিল বাট সেটা তেমন চোখে পরার মতো নয়, সেগুলোর আলোচনায় পরে আসি।

তবে এটা হলফ করে বলতে পারি তিনি পরিচালক হিসেবে সম্পুর্ণ সফল, আমরা চাইবো তার এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক, তার দ্বিতীয় ফিল্মের জন্যে অপেক্ষায় রইলাম।

কাস্টিং-অ্যাক্টিং : মুভির আরেকটা শক্তি শতাব্দী ওয়াদূদ, তার অভিনয়ের লেভেলটা উঁচু, দারুণ অভিনয়, কিন্তু আফসোস আমাদের পরিচালকরা তাকে ইউজ করেনি তেমন। এই মুভিতে দীপন দাদার বেস্ট চয়েজ বলব ওয়াদুদ।

শুভ : শুভর ক্যারিয়ারের বেস্ট অ্যাক্টিং বলব এটাকে, আগের মতো সেই ন্যাকাভাবটা একটুও ছিল না, ড্রামিক হাঁটাচলা কিছুই ছিল না। উল্টো প্রতিটা স্থানে তার এক্সপ্রেশন ছিল প্রশংসার দাবিদার। আমি বলব না শুভ পারফেক্ট অ্যাক্টিং করেছে, বরং বলব ওর ক্যারিয়ারের বেস্ট। তবে কখনো মনে হবেনা যে এই চরিত্রে শুভর থেকে অন্যজন পারফেক্ট, শুভ ঠিকই পুষিয়ে দিয়েছে।

কিছু স্থানে শুভর হাঁক ছেড়ে ডাক দেওয়া, মিন জোরে ডাক দিলে মনে হয়েছে চিৎকার করছে, একটু দুর্বল ছিল। অ্যাকশন সিনেও ভালো ছিল শুভ।

এবিএম সুমন : অভিযানে তার এক্সপ্রেশন জাস্ট চমৎকার, রাগী কঠোর ভাবটা সত্যিই মনে হয়েছে সে একজন দক্ষ সাহসী পুলিশ অফিসার। বাট অন্য ক্ষেত্রে তার অভিনয় দুর্বল। আমি হতাশ হয়েছি, কথা বলার স্টাইলটাও দুর্বল। তবে তার এই কথা বলার সিনগুলো মুভিতে খুব কমই ছিল তাই পুরো মুভিতেই তার উপস্থিতি ছিল চমৎকার। তাকে ইউজ করতে পারলে আগামীর নক্ষত্র হবে সে।

মাহি : দুই-একটা জায়গায় তার অ্যাক্টিং/এক্সপ্রেশন চমৎকার ছিল, বাট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হতাশা জনক, এর থেকে তার ‘দেশা’ মুভির সাংবাদিক অভিনয়টা বেশি ভালো ছিল। মুভিতে ন্যাকামি তার চোখে পড়ার মতো, আর তার সব কথাতেই যেন আমি রোমান্টিকের আভাস পেয়েছি। নাহ হতাশ।

ভিলেন : ট্রেইলারে, পোস্টারে, প্রচারণার সবখানে যেহেতু তাকে গোপন করা হয়েছে তাই আমিও গোপনই রাখছি। তার অভিনয় ছিল মুভির সবচেয়ে বড় শক্তি, তরুণ এই ভিলেন আমাদের ঢালিউডের কান্ডারী হবে বলে আশা করি।

শিপন : এই ছেলেটার উপস্থিতি খুব কম থাকলেও চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সাথে চমৎকার অভিনয় ছিল তার। ওর প্রথম সিনেমা ‌‘দেশা’ দেখার পর মনে হয়েছিল এই ছেলে কোনো দিনও কিচ্ছু পারবে না বাট আমার ধারণা ভুল করে দিয়ে সুন্দর অভিনয় ছিল মুভিতে।

নওশাবা : দারুণ ছিল যতটুকু ছিল, বাট ক্রাশ পাগলদের জন্যে দুঃসংবাদ হলো তিনি পুরো মুভিতে গর্ভবতি ছিলেন!

গান : প্রথমত থ্রিলারধর্মী মুভিতে আমি গান পছন্দ করি না, তারপরেও যেহেতু এটা উপমহাদেশের ঐতিহ্য সো মেনে তো নিতেই হবে।

মুভির প্রথম গান ‘টিকাটুলি’। আসলে গানটা কেমন সেটা নতুন করে বলার দরকার নেই, অনেকের কাছে ভালোলাগে কারো কাছে লাগে না। তবে মুভিতে যে টাইমে গানটা আনা হয়েছে, একদম পারফেক্ট টাইমিং, অনেক্ষণ কাহিনীর থমথমে অবস্থা, আগ্রহের কারণে যখন দর্শক একদম ম্যাচম্যাচে, ঠিক তখনই এই গানটা সবাইকে নতুন করে চাঙ্গা করে, দারুণ উপভোগ্য ছিল।

টুপটাপ গানটা ভালোই ছিল, শেষের স্যাড সংটা একটু বেশিই ভালো ছিল, বাট আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে স্কুল বাসে শিশুদের গানটা।

অন্যান্য : আমি তো আগেই বলেছি মুভির মুল হিরো হলো পরিচালক, তার দিকনির্দেশিনা না থাকলে হয়তো সম্ভব হতো না এতো সুন্দর একটা কাজ। সিনেমার প্রতিটা অভিযান দেখে মনে হয়েছে সত্যিকারের অভিযান দেখছি, টানটান উত্তেজনার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তো ছিলই, প্রতিটা শটে ছিল যত্নের ছাপ, ড্রোন ক্যামেরার ইউজ ছিল আরো দারুণ। এক শট থেকে আরেক শটে যাওয়ার টাইমিংটাও দারুণ ছিল। সিনেমাটোগ্রাফি দারুণ ছিল বিশেষ করে স্কুলবাস অ্যাকসিডেন্টের পর মর্মান্তিক দৃশ্যগুলা দেখানোর সময়ে।

সবচেয়ে বড় কথা পুরো মুভি ছিল টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার মুভি। এবং তথাকথিত এন্ডিং সিস্টেম ‘সকলে মিলে উদযাপন করে মুভি শেষ’ করার মতো কোনো সিন ছিল না, ভালোলেগেছে বিষয়টা। তবে এন্ডিংটা বেখাপ্পা লেগেছে যদি আরেকটু রেশ রাখতো ভালো হতো। অর্থাৎ অভিযান শেষ মাত্রই মুভি শেষ, নাহ আরেকটু দেরি উচিৎ ছিল।

কিছু জিনিস যা চোখে বেশি লেগেছে….

আসলে কথায় আছে সাদা কাপড়ে একটু দাগ লাগলেও সেটা চোখে পরে, ঠিক তেমনই ভালো মুভির মধ্যে ছোটো খাটো জিনিষগুলাও মানুষ গুরুত্ব দেয়। আমি বলছিনা এটা অপরাধ, আমি বলব ভুল ছাড়া মুভি নেই, ভুল হবেই আর ভুল থেকেই শিক্ষা নিয়ে আরো ভালো কিছু করার প্রত্যয় হবে।

এগুলা ঠিক ভুল নয় জাস্ট দৃষ্টিকটু /দুর্বল লেগেছে।

সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমার দুর্বল লেগেছে সেটা হলো খুন/বোমা হামলার মোটিভ, মোটিভটা অনেক দুর্বল, আরো শক্ত কোনো মোটিভ দরকার ছিল, এই দুর্বল মোটিভের কারণে পুরো গল্পটাই কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছে।

প্রচারণার সময়ে আলমগীর স্যারকে এতো জোরে-শোরে ইউজ করা হয়েছে যে মনে হয়েছে পুরো মুভিতে তার উপস্থিতি থাকবে বাট তার উপস্থিতি ছিল এক মিনিট, এটা না করলেই পারতেন— দরকার ছিল না।

বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর একটা চরিত্র থাকবে কোন টিজার বা ট্রেইলারে এমন একটা সিনও ছিল বাট পুরো মুভিতে সেটা ছিল না, হয়তো সেন্সর কর্তন করেছে, ঠিক আছে সেটা বাট বিনা কর্তনে সেন্সর এই বুলি কেন?

মাহির অভিনয় আর সুমনের দুই এক জায়গার কথা নেগেটিভ দিক ছিল, বিশেষ করে এমন সিরিয়াস একটা মুভিতে মাহির ন্যাকামি।

শুভর হেয়ারস্টাইল, হয়তো অনেক সময় নিয়ে অভিনয়ের কারণে গেটাপ ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি বাট এটা প্রচুর দৃষ্টিকটু ছিল। বান্দরবান ঢোকার সময় এক স্টাইল, বের হওয়ার সময় আরেক স্টাইল, টিকাটুলি গানের শুরুতে এক স্টাইল শেষে এক স্টাইল।

বোম বাস্ট হওয়ায় যে ভিজুয়াল ইফেক্ট ইউজ করা হয়েছে, তা খুবই দুর্বল ছিল, আমি জানি অল্প বাজেটে একদম পারফেক্ট সম্ভব নয় তারপরও যেহেতু দুর্বল সাইড তাই উল্লেখ করলাম। এর থেকে আমাদের সেকেলে মুভিগুলায় পেট্রোল দিয়ে যে বাস্ট হইতো তা আরো ভালো দেখাতো।

শুভ-মাহি গাড়িতে বসে চলন্ত গাড়িতে একে অপরের এক চাহনিতে ৪ মিনিটের গান, কেন? তাও চলন্ত গাড়িতে। আর তাকালেই গান এটা তো এনালগ যুগের স্টাইল।

স্কুলবাস ভর্তি বাচ্চারা ছিল অ্যাকসিডেন্ট হলো, নিহত হলো আহত হলো একটা শিশুও বাস থেকে বের হয়নি কারণ বাসের দরজা বন্ধ ছিল, হ্যাঁ মানলাম বাট একটা ব্যাগ কিভাবে ছিটকে চলে আসলো? আচ্ছা আসতেই পারে জানালা দিয়ে বাট একটি ব্যাগই কেন? আরো তো কত ব্যাগ ছিল, আর ঘুরে ফিরে ঐ একটা ব্যাগই দেখানো হচ্ছে। এখানে আরো ব্যাগ ওয়াটার বোতল দেখালে মর্মান্তিক দৃশ্যটা আরো গভীর হতো বলে মনে করি।

শেষে বাচ্চাদের লাল সবুজের পোটকা/বেলুন দিয়ে পতাকা উদযাপনে যে সবুজ বেলুন ইউজ হয় তা আসলে ঠিক সবুজ রং এর ছিল না, অন্য একটা কালার হয়ে গিয়েছিল।

মালয়েশিয়ার অভিযানটা ঠিক কতটুকু জরুরি ছিল? হ্যাঁ, এটা প্লাস পয়েন্ট ছিল বাট কেন প্রয়োজন? এটার উত্তরটা আরো শক্ত করার দরকার ছিল। অভিযানের কারণটা আরো শক্তিশালী করার ছিল।

মাহির চরিত্রটা শেষের দিকে লেইম হয়ে গেল না?? এতো সিরিয়াস সময়ে তার এসব ছেলেমি বায়না অনেকটাই বেমানান।

হ্যাঁ, আরো কিছু ছিল ছোটোখাটো ওগুলো উল্লেখের প্রয়োজন নেই। তবে দেশের সেরা ক্রাইম থ্রিলার মুভি এটা নিশ্চিত, দেখে আসুন দারুণ উপভোগ্য।

সর্বশেষে বলব, অপেক্ষা ২০১৯ সালের ‘ঢাকা অ্যাটাক ২’ এর জন্যে…।

আর হ্যাঁ আমার কাছে কেউ রেটিং চাইলে…

দেশের মুভি হিসেবে 9.2/10

মাহির কারণে 0.4 কম, আর অন্যান্য কারণে 0.4 কম।

আর সবদিক বিবেচনায় আমি দর্শক হিসেবে রেটিং দেবো 8.0+0.3= 8.3/10

অতিরিক্ত 0.3 হলো একমাত্র আমাকে হলে ধরে রাখার জন্যে।


Review

0%

0%
0%

মন্তব্য করুন