Select Page

তারেক মাসুদ ও তার স্বপ্নফেরি

তারেক মাসুদ ও তার স্বপ্নফেরি

তিনি ছিলেন স্বপ্নের ফেরিঅলা। আর তার স্বপ্ন ছিলো সিনেমা, কেবলই সিনেমা। নিজেকে তিনি সিনেমার ফেরিঅলাই মনে করতেন। তিনি ফেরিঅলার মতো নিজের সিনেমা ফেরি করে দেশে-বিদেশে, শহরে-উপশহরে, গ্রামে-গঞ্জে প্রদর্শন করতেন। যেনো এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সুতা ধরে নেমে আসা এক বায়োস্কোপ-অলা। তিনিই তারেক মাসুদ—সিনেমার জন্য যিনি জমি-জমা, সর্বস্ব বিকিয়ে দিতে পারতেন, সিনেমা ছিলো যার কাছে স্বপ্ন, যিনি আসলে স্বপ্নই ফেরি করে বেড়াতেন।

তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার কখনো আলাপ-পরিচয় ছিলো না। তবে তাকে একবার দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। তিনি তার ‘আদম সুরত’ নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দেখাতে—সেইদিন তাকে দেখেছি, তার কথা শুনেছি দূর থেকে। কী বলেছিলেন আজকে এতো বছর পর আর মনে নাই। কিন্তু তারপর থেকে তার লেখা থেকে বা তার সম্পর্কে যা পড়েছি, যা জেনেছি তার বন্ধুবান্ধব বা অনুরাগীদের কাছ থেকে, তার সিনেমা দেখে যা বুঝেছি, তারপর সব মিলিয়ে আমার নিজের যা মনে হয়েছে আজকে তাইই বলার চেষ্টা করবো।

জহির রায়হানের পর আলমগীর কবির। আর তার পরে বাংলাদেশি সিনেমায় তারেক মাসুদের মতো এতো বিশালকায়া আর তেমন কাউকে দেখা যায়নি। তারেকের অকাল মৃত্যুর পর সে শূন্যতা পূরণ করবে তেমন কাউকে দেখা যায় না। অবশ্য কতিপয় চলচ্চিত্রকার যথা তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, আবু সাঈদ, নূরুল আলম আতিক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাহিদুর রহিম অঞ্জন প্রমুখ আছেন, যাদের কাছ থেকে পাই ‘কর্ণফুলির কান্না,’ ‘চাকা’, ‘নিরন্তর’, ‘চিত্রানদীর পাড়ে’, ‘লালসালু’, কীর্তনখোলা, ‘নদীর নাম মধুমতি’, ডুবসাঁতার, মেঘমল্লার, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’সহ বেশ কিছু বিকল্পধারার সিনেমা। কিন্তু আমার মনে হয় না তারা কেউই তারেক মাসুদের শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা রাখেন।

১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমানের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ আমার মনে হয় প্রথম সিনেমা যেখানে ঔপনিবেশিক শক্তির বিপক্ষে বাঙলার মানুষের জতীয়তাবাদী জাগরণের প্রকাশ প্রথম ঘটে। তারপর ১৯৭০ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে সরাসরি ধারণ করে দেখান। তারপর তার ‘স্টপ জেনোসাইড’। তারপর আলমগীর কবিরকে আমরা জহিরের উত্তরাধিকার হিসেবে গভীরভাবে পাই। তার কাছ থেকে পাই ‘সূর্যকন্যা’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘রুপালি সৈকতে’, ‘সীমানা পেরিয়ে’সহ কিছু সিনেমা। এছাড়া চাষী নজরুল ইসলাম, আলমগীর কুমকুম, মসিহউদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, আমজাদ হোসেন, হুমায়ূন আহমেদসহ আরো কতিপয় চিত্রনির্মাতাকে পেয়ে যাই যারা চলমান স্রোতের বিপরীতে সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের কাছ থেকে পাই ‘ওরা এগারোজন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘আগুনের পরশমনি’সহ বেশকিছু সিনেমা। কিন্তু আলমগীর কবিরের পর তারেক মাসুদকেই তার যথার্থ উত্তরাধিকারী বলে আমার মনে হয়েছে। আলমগীর কবির যেমন বহুমাত্রিক, সর্বদা গতিশীল, আর সকল সময় কর্মময় একজন কর্মী ছিলেন তারেকের মধ্যেও সেইসব গুণ আমরা দেখেছি। কোনো না কোনো ভাবে তারেকের অস্তিত্ব টের পাওয়া যেতো।

তারেক মাসুদের সিনেমার হাতেখড়ি হয়েছিলো মূলত মুহম্মদ খসরু ও তারপরে আলমগীর কবিরের হাত ধরে। জহির রায়হান ও আলমগীর কবিরের সিনেমা হয়ে উঠেছিলো মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক সিনেমার পাশে বিকল্পধারার সিনেমা। এই দুই চলচ্চিত্রকারের পর তারেক মাসুদই হয়ে উঠেছিলেন বিকল্পধারার সিনেমার উজ্জ্বল বাহক। যদিও তারেক মূলধারা কিংবা বিকল্পধারা কোনো প্রকারেই বিশ্বাস করতেন না, তিনি মনে করতেন, সিনেমা কেবল বিচার হতে পারে ভাল আর খারাপ এই মানদণ্ডে। তিনি ভালো সিনেমা বানানোর জন্যই অঙ্গিকারবদ্ধ ও নিবেদিত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি নতুন দিনের সিনেমা কেমন হবে তার পথ অনুসন্ধানে প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন। মুহম্মদ খসরু ও আলমগীর কবিরের পর বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ফিল্ম আর্কাইভ গড়ে তোলার আন্দোলনে তার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।

তারেক মাসুদ মূলত চলচ্চিত্রকার হলেও তার আরো পরিচয় ছিলো। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক ইত্যাদি। তিনি গীতিকারও ছিলেন, তার সিনেমায় ব্যবহৃত অধিকাংশ গানই তার রচিত।

আমরা ভাবতে পারি, তারেক মূলত মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন। আমার মনে হয়, চিন্তাচেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থার মানুষ ছিলেন। এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ইতঃপূর্বে আমরা আহমদ ছফার মধ্যে দেখি। তারেকের বানানো সিনেমাগুলি দেখে মনে হয়, তিনি কোনো সিদ্ধান্তই উপস্থিত করেন না। সমস্যাগুলিকেই শুধু উপস্থাপন করেন। বলতে পারি, চরম বা পরম কোনো প্রকার তার মধ্যে উপস্থিত ছিলো না, ছিলো খানিকটা মরমি মনোভাব; যা কিছুটা আমাদের লোকসংস্কৃতির মধ্যকার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনাকে লালন-পালন করে।

তারেক মাসুদের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য কেটেছে বিভিন্ন মাদরাসায় পড়ে, রক্ষণশীল পরিবেশে। কিন্তু সেই মাদরাসা পড়ুয়া ছেলেটির পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সিনেমা দেখা, চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া, অবশেষে চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠার ঘটনাটাকে কিন্তু তার কালের জন্য অভাবনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা দেখতে পারি।

তারেকের বিভিন্ন সিনেমায় দেখানো নৌকাবাইচ, গ্রাম্য-মেলা, লোকনৃত্য, লোকগান, পুতুলনাচ ইত্যাদি বিষয় আসলে আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক, জীবনযাপনের ঐতিহ্যকেই ধারণ ও উন্মোচন করে। হতে পারে এই অঞ্চলের লোক, মরমি, সহজিয়া, বাউল ইত্যাকার দর্শনই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলো এইভাবে চিন্তা করার বিষয়ে। মূলত তিনি এই অঞ্চলের ইতিহাস ও দর্শন পাঠ করেছেন তার নিজের মতো করে।

ডকুমেন্টারি, ফিচারফিল্ম, শর্টফিল্ম, অ্যানিমেশনসহ তারেক মাসুদ খুব সম্ভবত তেরো-চৌদ্দটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। এর বাইরে তার বেশ কিছু চিত্রনাট্য তৈরি ছিলো, যা থেকে সিনেমা বানাবেন ঠিক করেছিলেন। দুয়েকটা বাদ দিয়ে তার প্রায় সব সিনেমাই আমি নানা সময়ে দেখেছি।

শিল্পী এসএম সুলতানের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ দিয়ে তারেক মাসুদের সিনেমার জগতে পদার্পণ। ১৯৮২ সালে প্রামাণ্যচিত্রটি বানানোতে হাত দেন তিনি, শেষ করতে সময় নেন সাত বছর মানে শেষ করেন ১৯৮৯ সালে। তার চলচ্চিত্র প্রতিভার প্রকাশ ঘটে এই ‘আদম সুরতে’র মাধ্যমেই। তার সিনেমা-চিন্তার বিকাশে সুলতানের যে প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছিলো তা এ সিনেমাটি দেখলেই বোঝা যায়। ‘আদম সুরত’ বানানোর মাঝখানে মানে ১৯৮৫ সালে ‘সোনার বেড়ি’ নামে একটা শর্টফিল্মও তৈরি করেন। এইটা খুব সম্ভবত আলমগীর কবিরের ওয়ার্কশপে বানানো। এই সিনেমা আমি দেখিনি তাই এটা সম্পর্কে কিছু বলতে পারলাম না।

১৯৯৫ সালে লিয়ার লেভিনের আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ নিয়ে তারেক নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’ নামে একটি কালজয়ী প্রামাণ্যচিত্র। ‘মুক্তির গান’কে তাত্ত্বিক বিচারে বলা যায় ন্যারেটিভ ডকুমেন্টারি। কিন্তু তারেক মাসুদ এ জাতীয় সিনেমাকে প্রামাণ্যচিত্র বা কাহিনিচিত্র কোনোটাই মনে করতেন না, তিনি একে ডকু-ফিকশন বলতেন।

তারপর ১৯৯৬ সালে সারাদেশে ঘুরে ঘুরে ‘মুক্তির গান’ প্রদর্শনের অভিজ্ঞতা ও প্রদর্শনকালীন ধারণকৃত মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিডিও ফুটেজকে ব্যবহার করে বানানো হয় ‘মুক্তির কথা’। আমার মনে হয় ‘মুক্তির গান’ সিনেমার অপূর্ণ বাসনা পূরণ করতেই তারেক তার ‘মুক্তির কথা’ নির্মাণ করেন। ‘মুক্তির কথা’কে বলা যায় কথ্য ইতিহাস।

মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ নির্মাণ করতে গিয়েই খুব সম্ভবত তারেক বাঙালি জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধারণার সামনা-সামনি পড়ে যান। তিনি উপলব্ধি করেন যে কথিত জাতীয়তাবাদের এই ধারণা একরৈখিক এবং তা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত মূল্যবোধকে ধারণ করে না। ফলত তারেক চলমান সমাজবাস্তবতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণার পুনর্ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেন তার পরবর্তী সিনেমায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা তার ভালো লাগতো না। অবশ্য তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গীকে জাতীয়তাবাদী চেতনার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেননি। অর্থাৎ তিনি প্রচলিত জাতীয়তাবাদী ধারণার বাইরে খুব একটা যাননি বলেই আমার মনে হয়েছে।

আগেই বলেছি যে তারেক জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে বেরিয়ে আসেননি, কিন্তু ২০০২ সালে ‘মাটির ময়না’ সিনেমায় জাতীয়তাবাদের মৌলিক কিছু সংকটকে সামনে নিয়ে আসেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইসলামধর্ম প্রশ্নে যে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা বিদ্যমান—তিনি নিজের জায়গা থেকে সেইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার মূলকথা ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের ইতিহাসকে আশ্রয় করেই দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ধর্ম যেখানে প্রতিপক্ষ হয়ে থাকবে না। ‘মাটির ময়না’ সিনেমায় তারেক একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে ইসলামি জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যদিও ইসলাম কখনোই লোকধর্ম হতে পারে না। তারপরও তিনি এই অঞ্চলের অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও লৌকিক বা লোকজধর্ম হিসেবে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে।

‘মাটির ময়না’কে সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে তুলনা করা যায়। অনু আর তার বোনের চরিত্র, অপু আর দুর্গার মতোই অনেকটা। কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই সিনেমার সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থানের প্রকাশ তীব্র। একজন শহরফেরত তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মুসলিমকে দেখা যায় নিজের ছেলেকে মাদরাসায় পড়তে পাঠাচ্ছেন। এটাকেও কিন্তু ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ হিসেবে ভাবা যায়।

‘মাটির ময়না’ ঠিক আত্মজৈবনিক সিনেমা না হলেও তারেকের শৈশবে একাধিক মাদরাসায় পড়ার অভিজ্ঞার বর্ণনাই এই সিনেমার একাংশজুড়ে বিদ্যমান। তারেকের সঙ্গে ‘মাটির ময়না’র আনুর সম্পর্ক মূলত শৈশবের সঙ্গে পূর্ণবয়স্ক সময়ের বোঝাপড়ার সম্পর্ক। এই সিনেমায় আনু একটা অনুঘটক চরিত্র, একটা চোখ, যে চোখ দিয়েই মূলত সব আমরা দেখি। তবে একই সিনেমায় এতো বিষয় আমার ভালো লাগেনি, একই সঙ্গে যুদ্ধ, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ইত্যাকার সব বিষয়ই যেনো প্রধান হয়ে ওঠেছে। সিঙ্গল একটা স্টোরি লাইনে বাকি সব অনুষঙ্গ হিসেবে আসতে পারতো হয়তো।

২০০৬ সালে তারেক মাসুদ নির্মাণ করে ‘অন্তর্যাত্রা’ নামে আরেকটি সিনেমা। ‘অন্তর্যাত্রা’ হলো ঘরে ফেরার গল্প। তবে গতাণুগতিক। এই রকম গল্প আমরা আরো অনেকের সিনেমায় দেখেছি। এটাও তার জাতীয়তাবাদী চেতনারই প্রকাশ। এই সিনেমার চরিত্রগুলি পূর্ণতা পেয়েছে বলে মনে হয়নি। সিনেমার মেকিংও তেমন ভালো লাগেনি, এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে জাম্পকাটের মাধ্যমে যাওয়ার বিষয়টা ভালো লাগেনি। আলমগীর কবিবের সিনেমায়, ধরেন ‘রুপালি সৈকতে’ও জাম্প কাট আমরা দেখি, সেখানে কিন্তু খারাপ লাগে না। এই সিনেমা নিয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলার আগ্রহ পাচ্ছি না। এই সিনেমা দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছিলো তারেক এই সিনেমা না বানালেও এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না।

এবার বলবো ‘নরসুন্দর’-এর কথা। এটা ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বানানো একটি শর্টফিল্ম।। মুক্তিযুদ্ধে বিহারিদের ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণার পাশাপাশি স্টিরিওটিপিকাল ধারণা থেকে বেরিয়ে একজন ব্যতিক্রম বিহারির ভূমিকা। একজন বিহারি নাপিতের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে কৌশলে বাঁচানোর কাহিনি। এই রকম ব্যতিক্রম কিন্তু বাস্তবেও কতিপয় আছে। যেমন সৈয়দ খান নামের একজন বিহারি ছিলেন, যিনি বাঙলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন।

‘রানওয়ে’ ছবির একটি দৃশ্য।

এইবার ‘রানওয়ে’ সিনেমার কথা বলি। ২০১০ সালে তিনি এই সিনেমা নির্মাণ করেন। সিনেমার প্রেক্ষাপট ২০০৫-০৬ সালের, যখন দেশে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটে। রুহুল থাকে এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে। বাবা মধ্যপ্রাচ্যে গেছে, কিন্তু অনেকদিন ধরে কোনো খবর নাই। ছোটবোন গার্মেন্টসে কাজ করে। আর মা এনজিও থেকে টাকা নিয়ে কেনা গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়। মাদরাসা পড়ুয়া রুহুলের কোনো চাকরি নাই, মানে সে পায় না। তার জীবন কাটে হতাশায়। সে মামার সাইবার-কাফেতে গিয়ে কম্পিউটার শেখার চেষ্টা করে। সেখানে আরিফ নামের এক ছেলের মাধ্যমে জঙ্গিচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

মাদরাসা মানেই যে ধর্মান্ধ উগ্রদের আখড়া নয়, তা রানওয়ে সিনেমায় বোঝানোর চেষ্টা ছিলো। তারপরে উগ্র মৌলবাদী শক্তির উত্থান ও বিস্তার লাভ, এদের আশ্রয়দাতা, কর্মপদ্ধতি সবকিছুই দক্ষতার সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে। যদিও এখানেও আমরা দেখি তার সেই সমন্বয়বাদী মনোভাব, মাঝামাঝি থাকার ব্যাপার। তারপরও জঙ্গিচক্র থেকে বের হবার সহজ উপায়ও দেখানো হয় এই সিনেমার কাহিনির মধ্যেই।

এই সিনেমার কিছু দৃশ্য চোখে আটকে থাকার মতো, যেমন রুহুল যখন পুকুরের পানিতে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে, পুকুরে তখন আকাশের আর  মেঘের ছায়া পড়ে। আর ঠিক তখনই সেই ছায়ার মধ্যে দিয়ে একটা প্লেনকে উড়ে যেতে দেখা যায়। আরেক দৃশ্যে রুহুলকে মা গরুর দুধ দিয়ে মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে। তারপর পাথরকে মাঝখানে রেখে রুহুলের প্রেমালাপ কিংবা উজোজাহাজকে মাটিতে ফেলে দেয়ার জন্যে ছোটো এক বালকের গুলতি ছুঁড়ে মারার দৃশ্য। আমি মনে করি, এই সিনেমায় এসে তারেক মাসুদ পূর্ণতা লাভ করে।

‘রানওয়ে’তে আরো দেখি মনোলগের ব্যবহার, সংলাপের পরিবর্তে প্রকৃতি নিঃসরিত শব্দের মাধ্যমে আবহ তৈরি করা—মনি কাউল-সহ আরো অন্য অনেকের সিনেমায় যেমন আমরা নৈঃশব্দ্যের ব্যবহার দেখি। তবে তার সিনেমার কাহিনি ও ফর্ম বরাবরই ঘনিষ্ঠ থেকেছে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি আর ইতিহাসের সঙ্গে। তিনি মনে করতেন, এই সিনেমা কেবল কতিপয় বোদ্ধা দর্শকের জন্য নির্মিত হয়নি, এই সিনেমা সাধারণ দর্শকদের জন্য বানানো।

তারেক মাসুদ ‘কাগজের ফুল’ নামে একটা সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। সেটা মাটির ময়নার পূর্বের প্রেক্ষাপট, দেশভাগের গল্প সম্ভবত, আনুর বাবা কাজী সাহেবের যৌবনের গল্প। ১৯৭১-এর গোঁড়া কাজী সাহেব ১৯৪৭-এর ‘কাগজের ফুল’-এ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর অবিভক্ত বাংলার কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়ানো এক স্বাপ্নিক যুবক।

‘কাগজের ফুল’ ছিলো তারেক মাসুদের স্বপ্নের প্রকল্প। ‘রানওয়ে’ বানানোর আগে থেইে এই স্বপ্ন তার মাথার ভিতর ছিলো, হয়তো চিত্রনাট্যও তৈরি ছিলো। সেই সিনেমা বানানোর লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে ফেরার পথেই তারেক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে চলে গেলেন। তবে আশা রাখি, তার আজীবনের সহযোদ্ধা ক্যাথরিন মাসুদ নিশ্চয়ই কোনোদিন ‘কাগজের ফুল’ সিনেমা বানাবেন। তখন আমরা দেখবো তারেক আসলে এই সিনেমায় কী দেখাতে চেয়েছিলেন।

এই কথা বলা যাবে না যে, তারেক মাসুদ একেবারে শুদ্ধ সিনেমা বানাতেন। তার সিনেমায়ও অনেক অসংগতি ছিলো। তবে তার সিনেমার ন্যারেটিভ প্রথাগত নয়। তারপর তার সিনেমার মতো বাহুল্যহীনতা অন্যদের সিনেমায় বিরল। আর সিনেমার কম্পোজিশন অসাধারণ সব বুনন নিয়ে আমাদের সামনে আসে, যার অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়ে আমাদের সহজাত চোখে দেখা ছোটোখাটো অসংগতিগুলি।


মন্তব্য করুন