Select Page

দেশান্তর : এ রকম নিখুঁত নির্মাণ আজকাল চোখে পড়ে না

দেশান্তর :  এ রকম নিখুঁত নির্মাণ আজকাল চোখে পড়ে না

 ‘দেশান্তর’, বাংলা কবিতার প্রবাদপুরুষ নির্মলেন্দু গুণের লেখা উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন আশুতোষ সুজন। এখনো যারা দেখেন নাই, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। এরকম নিখুঁত নির্মাণ আজকাল এদেশে সেভাবে চোখে পড়ে না।

কেন এমন বলতে হচ্ছে? নিখুঁত এ কারণে যে, সিনেমার প্রেক্ষাপট সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে। সিনেমায় সেই সময়টাকে ধরতে গিয়ে নির্মাতা সেই সময়ের বাড়িঘর, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, নদী ও জলাশয় আর মানুষের দৈনন্দিন জীবন যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় দেখেছি আমরা। ঋতুপর্ণের সিনেমাতেও দেখেছি। এদেশে দেখা গেছে তারেক মাসুদের সিনেমায়। এর বাইরে এত আগের সময়কে এত নিখুঁত দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই।

সামান্য একটা পাসিং ক্যারেক্টারের যে বেশভূষা বা চলাফেরা সেটাও মনে করিয়ে দেয়, এই বঙ্গের জীবন এমনই তো ছিল। পিতলের কুপি থেকে শুরু করে কুঁচি দেয়া বালিশের কভারে সেই সময়টার নিখুঁত উপস্থাপন অনেক বেশিই স্পষ্ট করে তুলেছে। সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সেই সময়কে যথাযথভাবে ধরতে পারা। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মতোই বিষণ্ণ সুন্দর এই উপন্যাস। আর তার প্রেক্ষাপট। আর তা নিয়ে এই চলচ্চিত্র।

সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা, এই গল্প নির্বাচন। দেশ ভাগের বেদনা অনেক জনপদেই এখনও টের পাওয়া যায়। একটা সময় এদেশে সবাই মিলেমিশে থাকত, এখন আর নাই। সেই ভিটেমাটি এখনও আছে অনেক। সেই পুরনো বৃক্ষ কিংবা পুস্কিনি আর ইন্দিরার পাড়ে পড়ে থাকা শান বাঁধানো ঘাট এখনও তো মন খারাপ করিয়ে দেয়। দেশভাগের সময় চলে গিয়েছিল অধিকাংশই। এই দেশ, এই মাটি ও জল ভালোবেসে থেকে গেছে বিচ্ছিন্ন কেউ। কেন থেকে গেছে, কীভাবে থেকে গেছে, সেই বেদনা আরও একবার এই সময়ে এসে মনে করিয়ে দিলো ‘দেশান্তর’।

তারপর আসে এই সিনেমার ফটোগ্রাফি। বিশেষ করে লং শটের দৃশ্যায়নে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এর চিত্রগ্রাহক, তা মন দিয়ে না দেখলেও মন কেড়ে নেয়। সিনেমার একটা দারুণ জায়গা ছিল এর পরিমিত সংগীত আয়োজন। সংগীতে আমরা এতদূর এগিয়ে গেছি, সেটা মনে করিয়ে দেবে এই দিকটা ভাবলে। কীর্তন ও বিয়ের গান দুটো ভীষণ মুগ্ধ করেছে। তবে নির্মাতা আশুতোষ সুজন নিজে গেয়েছেন একটা গান। তার সঙ্গী অবন্তী সিঁথি। গানটা সাধারণ কোনো গান না। এরকম গান একটা সিনেমার বিরাট সম্পদ। সঙ্গীতের জন্য জাহিদ নিরবের প্রতি ভালোবাসা। 

এবার আসি অভিনেতাদের ব্যাপারে। এই একটি সিনেমা, যেখানে প্রত্যেক অভিনেতাকে নিয়ে আলাদা করে বলার জায়গা আছে অনেক। আহমেদ রুবেল অনেক সিনেমাতেই অসামান্য অভিনয় করেছেন, তবে দেশান্তরে তার চরিত্রের প্রতি সবচেয়ে সুবিচার করেছেন তিনি। দেশের মাটি কামড়ে থাকার জন্য যে অভিনয়টা দেখানো দরকার ছিল, তিনি সেটাই দেখিয়েছেন নিপুণভাবে। সিনেমায় অন্য এক মৌসুমীকে পাওয়া গেলো। গ্রামের গৃহবধূর চরিত্রে তিনি সত্যিই দারুণ অভিনয় করলেন। শুভাশিস ভৌমিকের সম্পর্কে এদেশের মানুষ জানে ইত্যাদির সেই চরিত্র। কিন্তু তিনি যে অভিনয়ে কত বড় মাপের, তার সবচেয়ে বড় ঝলক দেখালেন দেশান্তরেই।

অশোক ব্যাপারীর অভিনয় শুরু থেকে একটু আলাদা। বাপের ভিটা ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবার সেই মুহূর্তে উঠানের মাটি নিয়ে তিনি যা করলেন, দেখার সময় আড়ষ্ট হয়ে যেতে হয়। মামুনুর রশীদের উপস্থিতি কম থাকলেও তিনি যেমন, তেমনই দেখা গেলো। রিফাত চৌধুরীকে মনেই হয়নি রিফাত চৌধুরীকে দেখছি। এটা অন্য কেউ। অসামান্য।

তবে একজনকে চিনতে পারলাম না, কন্যার বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যে কর্তার কাছে আহমেদ রুবেল গেলেন, কখনও তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমার মনে হচ্ছিল, এক ঋষিকে দেখছি।

এবার আসি টাপুর ও রোহানের ব্যাপারে। দুজনেই দুই তারকা দম্পতির সন্তান। ছোটবেলা থেকেই তারা এসবের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা কি এত সহজ? রোহান বরাবরের মতোই সাবলীল, সুন্দর। তবে নজর কাড়লো টাপুর। সদ্য বয়ঃসন্ধিকাল পেরোনো একটা মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মানিয়ে নেয়া, দেশ ভাগের সময় দেশান্তরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সাত পুরুষের ভিটায় থেকে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকার বেলায় যে অভিনয়ে দর্শককে আটকে রাখা যায়, টাপুর দেখালো তাই। পাশাপাশি জানান দিলো তার বিপুল সম্ভাবনা। রূপের সঙ্গে গুণের মিশেলে যে কী হয়, টাপুর সেই আশা জাগিয়েছে প্রথম সিনেমাতেই। এছাড়া মোমেনা চৌধুরী কিংবা আশেপাশের আরও অনেকে মুগ্ধ করেছেন পুরো সিনেমা জুড়েই।

আশুতোষ সুজন আজকাল ‘ব্যাচেলর পয়েন্টে’ অভিনয় করছেন জুয়েল ফুপার ভূমিকায়। তার সম্পর্কে প্রজন্মের অনেকে জানে সেই ‘ক্যারাম’ নাটকের গ্যাডিবাঁকা মজিদ হিসেবে। তবে এই আশুতোষ সুজন অসামান্য একজন গীতিকার, সুরকার, গায়ক। এই আশুতোষ সুজন একজন দুর্দান্ত গল্পকার। এই আশুতোষ সুজন ‘দেশান্তর’ সিনেমার পরিচালক। দেশান্তর সিনেমায় আশুতোষ সুজন নিজের জাত চেনালেন। সিনেমা দেখছিলাম সব পরিচিত জনেরা একত্রে। বের হবার সময় প্রিয় সাহিত্যিক ও নাট্যকার শুভাশিস সিনহা ও মঞ্চের দুর্ধর্ষ শিল্পী জ্যোতি সিনহার সঙ্গে সিনেমাটা নিয়ে কথা হচ্ছিল । কথা একটাই ‘কী অসামান্য সিনেমা বানিয়েছে, আহা’।

সময় পেলে দেশান্তর আবারও দেখব। আপনারাও দেখুন। আমি সামান্য বাড়িয়ে বলি নাই। দেখার পর মনে হবে কমিয়ে কেন বললাম? জয় হোক বাংলা সিনেমার। আশুতোষ সুজনের হাতে নির্মিত হোক আরও অসামান্য সব ক্ল্যাসিক।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লুৎফর হাসান

কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও লেখক

মন্তব্য করুন