Select Page

দোষ দেবের নয়, দোষ আমাদের

দোষ দেবের নয়, দোষ আমাদের

dev-home

কলকাতার অভিনেতা হিরো দেব বলেছে ‘আসুন দুই বাংলা আমরা এক হয়ে যাই’ । তা দেব দাদা কি হঠাৎ আবেগ আপ্লুত হয়ে এই কথা বলেছেন, নাকি সুদূর প্রসারী চিন্তা চেতনা থেকে অন্য কেউ উনাকে দিয়ে এই কথা বলিয়েছেন, এটা শুধুই আবেগের কথা নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য – সেই বিষয়গুলো বোঝার জন্য পুরনো কিছু ঘটনা মনে করলাম।

৯০’র শুরুতে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যেমন এক নতুন শুরু হয় ঠিক তেমনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দর্শকরা আলমগির, জসিম, সোহেল রানা, কাঞ্চন দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত, পরিচালক এহতেশাম ৯১ তে ‘চাঁদনী’ ছবি দিয়ে একটা ব্রেক দেন নতুন মুখ যাচাই করার জন্য এবং এতে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে সফল হয়েছিলেন। এহতেশামের সফলতায় পরবর্তীতে নতুন মুখ নিয়ে আরও কয়েকজন পরিচালক চেষ্টা করলে শুরু হয় নতুনদের জোয়ার সাথে পুরনোরাও বেশ ভালোভাবে ছিলেন। নতুন পুরনো সবাই মিলে চলচ্চিত্র অঙ্গনকে রেখেছিলেন মুখরিত। কিন্তু তখনও কলকাতায় প্রসেনসিত, তাপস পাল, ভিক্টর ব্যানারজি’রা এগিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রগুলোকে কলকাতা কাট টু কাট, সিন টু সিনসহ সংলাপ, গান সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে ছবি নির্মাণ করে কলকাতার ছবিপাড়া চাঙ্গা রাখছিলেন তখনও, যা তারা বহুদিন ধরে করে আসছিল। সেই তুলনায় কলকাতার চেয়ে আমাদের চলচ্চিত্র ছিল এগিয়ে, এমনকি অনেক হিন্দি ছবির চেয়েও মাঝে মাঝে এগিয়ে থাকতো। সেই সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ভারতীয় কণ্ঠশিল্পীরাও অনেক গান গেয়েছিলেন যা জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৯৯৩ সালে পরিচালক এ জে মিন্টুর ‘বাংলার বধূ’ ছবির ‘আবুল মামা’ গানটির জন্য সুরকার আলম খান চিন্তা করেছিলেন তাঁরই ভক্ত ভারতের কুমার শানুকে। কুমার শানুর সাথে আলম খানের আলাদা একটা সম্পর্ক কারণ অখ্যাত কুমার শানু’কে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকে এনেছিলেন আমাদের আলম খান শিবলি সাদিকে’র ‘তিন কন্যা’ ছবিতে। সেই থেকে কুমার শানু আলম খান’কে আলাদা একটা সম্মান করতেন আর আলম খানও কুমার শানু’কে স্নেহ করতেন। কিন্তু পরিচালক এ জে মিন্টু নাকচ করে দিলেন, তিনি চাইলেন বাংলাদেশের কেউ গানটি গাইতে, তাই শেষ পর্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের শিল্পী ও সুরকার প্রনব ঘোষ। ১৯৯৩ সালে পরিচালক ফজল আহমেদ বেনজীরের ছবি ‘প্রিয় শত্রু’তে প্রসেনজিত’কে নিয়েছিলেন পরিচালক যেখানে অভিনয় করে প্রসেনজিত খুব উচ্ছসিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে নিয়মিত অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশও করেছিলেন। প্রযোজক পরিচালক আজিজুর রহমান বুলির ‘রঙিন প্রান সজনী’ ছবিতে অভিনয় করেন তাপস পাল সেই সময়ে। তিনিও একই ভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের বাজারে কলকাতার ছবি প্রদর্শনীর জন্য আহবান জানান। কিন্তু সেইসময় সরকার পক্ষ থেকে কোনরুপ সাড়া না পাওয়ায় সেই বিষয়ে তখন আর কোন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। তবুও সেইসময় ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুযোগ পেতেন তবে তা কখনই বাংলাদেশকে তুচ্ছ করে তাঁদেরকে সুযোগ দেয়া হতো না এবং মিডিয়াও তখন তাঁদেরকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার সাহস পায়নি। ঋতুপর্ণা, ইন্দ্রাণী হালদার, ভাগ্যশ্রী, চাঙ্কি পাণ্ডে, আরবাজ খান সহ অনেকেই সেই সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ঋতুপর্ণা তো পরবর্তীতে কলকাতার ছেড়ে নিয়মিত বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করতে মরিয়া হয়ে উঠেন। আমাদের যখন সালমান, সানী, রুবেল, রিয়াজ, মান্নাদের যুগ তাঁদের তখনও প্রসেনজিত, তাপস পাল, মিঠুন চক্রবর্তী’র যুগ চলছিল। ‘৯৩ সালে পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নির্মাণ করেছিলেন যেখানে রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা’র মতো অভিনেতা ও অভিনেত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার সেই ছবিকে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কারও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে ভারতের ছবি আনার দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারেনি তখন শুধুমাত্র সরকারের সাড়া না পাওয়ায় । তখনও কলকাতা ভেতরে ভেতরে চাইতো তাঁদের চলচ্চিত্রকে এদেশের বাজার দখল করতে । তখন সারাদেশে বাংলাদেশের সিনেমাহল ছিল প্রায় ১২০০’র মতো অথচ এরচেয়েও বড় সীমানা নিয়েও কলকাতার ছবি সাফল্য পাচ্ছিল না। বাংলাদেশের নতুন চলচ্চিত্রগুলো ৪ সপ্তাহে যদি ১৫০-২০০ সিনেমা হলে মুক্তি পেতো তাহলে মূলধন সহ লাভ তুলে আনতো সেখানে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে যেতে পারছিল না। এমনকি আমাদের দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের তুমুল জনপ্রিয়তা সেই কলকাতায় প্রভাব ফেলেছিল যার ফলে কলকাতার সুমনের অ্যালবামের প্রচার ও চাহিদা বাড়ানোর জন্য আমাদের ‘ফিডব্যাক’ এর ‘জোয়ার’ অ্যালবামটি পর্যন্ত কলকাতার বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল ‘এইচএমভি’। অথচ সেই সুমনের গান আমরা আমাদের বাজারে প্রসার ঘটাই। নচিকেতা, সুমন,অঞ্জন দত্ত, মহিনের ঘোড়াগুলো’র অ্যালবাম কলকাতার বাজার ছাড়িয়ে আমাদের বাজারে জনপ্রিয়তা পায় অথচ আমাদের ফিডব্যাক, এলআরবি, মাইলস এর জনপ্রিয়তা কলকাতায় থাকলেও সেখানকার মিডিয়া তা চেপে যেতো ।

৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর খুব ধীরে ধীরে সুক্ষভাবে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প সহ পুরো মিডিয়ায় ধস নামে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সহজ প্রবেশ, সিনেমায় কাটপিস ঢুকিয়ে হল থেকে মহিলা দর্শকসহ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে হলবিমুখ শুরু হলে চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের শুরু করা হয়। কলকাতায় তখনও দেব ,জীৎ’রা আসেনি। আমাদের ফেরদৌস’কে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র ছবির কারণে কলকাতায় জনপ্রিয়তা পাইয়ে দিলে ফেরদৌস কলকাতায় ছবিতে নিয়মিত হয়ে যান আর কলকাতায় সেই সুবাধে নতুনদের আগমন শুরু হয়।

২০০৩ সালে চিত্রনায়ক মান্না অশ্লীল, কাটপিস সমৃদ্ধ ছবির বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন শুরু করেন ফলে অশ্লীল ছবির প্রযোজক পরিচালক’রা কোণঠাসা হয়ে পরে। ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের পর র‌্যাব গুলিস্থান, কাকরাইলের ছবির অফিসগুলো থেকে কাটপিস সমৃদ্ধ প্রিন্ট আটক করে। যার ফলে চলচ্চিত্রে আবার একটা পরিবর্তনের আভাস পেয়েছিল সবাই। নতুন পুরনো অশ্লীল ছবিগুলোকে সরকার নিষিদ্ধ করতে থাকলে শুরু হয় আগের মতো সুস্থধারার বিনোদনধর্মী ছবি নির্মাণের ।

চলচ্চিত্রে যখন আবার একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো ঠিক তখন মান্নার মৃত্যু , ফেইসবুক , ব্লগের নতুন জনপ্রিয়তায় একটি পক্ষ ফেইসবুক ও ব্লগে ভারতীয় গান, ছবি শেয়ার করার হিড়িকে আর অন্ধ অজ্ঞ এক প্রজন্ম বাংলাদেশের ছবিকে পচানো শুরু করলে ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গায় ধাক্কা খেলো। ফেইসবুকে ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত মনে হতো যেন ভারতীয় ছবি, গান প্রচারের প্রতিজগিতায় নেমেছে আমাদের নতুন প্রজন্মের একাংশ আর সেই একাংশ বাংলাদেশের ছবিকে না জেনে ভুলভাবে উপস্থাপিত করা শুরু করলো। সেই সাথে মিডিয়ায় ভারতীয়দের জয়গান একচেটিয়া প্রভাব আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে নতুন আরেকটি যুদ্ধে অবতীর্ণ করলো। নিজেদের মধ্যে এই যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখে কলকাতাবাসীর মনে আশা জাগলো যে বহুদিনের ইচ্ছেটা এবার হয়তো পূরণ হতে যাচ্ছে যার ফলে বাংলাদেশের দর্শক ও মিডিয়ার কাছে জনপ্রিয় কলকাতার নায়ক দেব’কে দিয়ে সরাসরি প্রস্তাব করে দেখলেন যে আমাদের প্রতিক্রিয়া কি? কারণ দাদাবাবু’রা এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে খেয়াল করেছেন যে বাংলাদেশের একটি শ্রেণী কলকাতাকে কিভাবে মাথায় তুলে রাখে যা দেখে তাঁদেরকে আরও সাহসী করে তুললো আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করে নিজেদের বাজার প্রতিষ্ঠিত করতে । কলকাতার ছবি বাংলাদেশে ঢুকার এরচেয়ে বড় সুযোগ, সুবিধা এর আগে আর কখনও আসেনি তাই এই সুযোগটা তাঁরা কাজে লাগাতে মরিয়া হবে এটাই স্বাভাবিক। দোষ দেবের নয়, দোষ কলকাতার নয় দোষ আমাদের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের, দোষ আমাদের মিডিয়ার, দোষ আমাদের নতুন প্রজন্মের অন্ধ এক গোষ্ঠীর যারা দৃষ্টিশক্তি থাকতেও অন্ধ হয়ে থাকে ভারত/ কলকাতাকে সব উজাড় করে দিতে ।।

লেখক: ফজলে এলাহী (পাপ্পু), কবি ও কাব্য তার ব্লগ নাম।


২ টি মন্তব্য

  1. অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই ‘বিএমডিবি’ কর্তৃপক্ষকে এই লিখাটি এখানে ঠাই দেয়ার জন্য । পুরো লিখাটা আমার স্মৃতির পৃষ্ঠা থেকে নেয়া যা আমি দেখেছিলাম সেই ৯০ দশক থেকেই । আমাদের চলচ্চিত্র অনেক এগিয়ে ছিল কিন্তু একটি মহল সেই শিল্পটাকে কৌশলে ধ্বংস করে দিয়েছে । আমাদের সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে ।

  2. Nezam Uddin

    কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে ভারতের ছবি আনার দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারেনি তখন শুধুমাত্র সরকারের সাড়া না পাওয়ায় । তখনও কলকাতা ভেতরে ভেতরে চাইতো তাঁদের চলচ্চিত্রকে এদেশের বাজার দখল করতে । তখন সারাদেশে বাংলাদেশের সিনেমাহল ছিল প্রায় ১২০০’র মতো অথচ এরচেয়েও বড় সীমানা নিয়েও কলকাতার ছবি সাফল্য পাচ্ছিল না।

    এটাই! একমাত্র সরকারী নীতিগত সাপোর্ট পাচ্ছে বলেই ভারতীয় সিনেমা এদেশের মার্কেটে ঢুকার পায়তারা করতে পারছে।

মন্তব্য করুন