Select Page

পরীমণি প্রসঙ্গে পরিশেষে: প্রজেক্ট প্রপোজাল পণ্ড 

পরীমণি প্রসঙ্গে পরিশেষে: প্রজেক্ট প্রপোজাল পণ্ড 

প্রকল্প-প্রচেষ্টা

এই রচনার দায় বা কৃতিত্ব প্রায় কিছুই আমার না। দায় হোক বা কৃতিত্ব, কিছুটা তার এই সম্পাদকের, তিনি লাগাতার লেগে ছিলেন। অনেকটা কৃতিত্ব খোদ পরীমণির নিজেরই। পরীমণি তারকা, অতিশয় বড় তারকা। বহুদিন পর বাংলাদেশের বিলীয়মান চলচ্চিত্র কারখানার সবচেয়ে বড় তারকা, এবং তারকা-ইমেজের দিক থেকে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধরনের। অন্য কিছুটা কৃতিত্ব হলো পরীমণিকে গ্রেপ্তারের জন্য যেসব পক্ষ সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের। সেই পক্ষ খোদ এত জটিল নানান রকমের পক্ষের সমাহার বলে আমার আন্দাজ যে তাঁদেরকেও কৃতিত্ব কম করে দিলে কারো ভাগেই কিছু তেমন পড়ে না। শেষে হিসাব-নিকাশ করে দেখলে কষ্ট করে এরকম একটা রচনা লিখে আমার কৃতিত্ব বলতে প্রায় কিছুই থাকে না। বাংলাদেশে রচনা করে পয়সা পাওয়া যায় না। কৃতিত্বও না থাকলে লেখকদের কোনো মোটিভেশন থাকে না। ফলে গোড়াতেই আমি কিছু কৃতিত্ব নেবার জন্য জটিল একটা রাস্তা নিলাম।

কোলাজ: রিমান্ড শেষে ও জামিন পাওয়ার পর পরীমণি

প্রকল্প আজকাল অত্যন্ত জরুরি একটা মধ্যবিত্ত পেশাকাজ। এর আরেক নাম প্রজেক্ট। আমি যে চাকরিটা করে খাই সেখানে প্রজেক্ট করে বেতনের বহুগুণ আয় করেন অনেক সহকর্মী – এরকম একটা কথা বহুদিন ধরেই আমি শুনে আসছি। কিন্তু এই কাজটা এমন জটিল যে আমি কোনোদিনই ঠিক কীভাবে যে কী করতে হয় তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি। প্রস্তাব-ট্রস্তাব লিখে দাতাদের কাছে যেতে হয় – তাও শোনা যায়। সেসব দাতারা তখন দেশের উন্নতির সংকল্পে ওই প্রকল্পদারকে নানান মাত্রায় টাকা দিয়ে থাকেন। তারপর গবেষণা বলে কিছু একটা বস্তু হয়। এবং অতি অবশ্যই শেষে একটা প্রতিবেদন হয়। যতদূর জানি, ওই প্রকল্প লেখা যতটা শক্ত, তার থেকে অনেক বেশি শক্ত সঠিক ফান্ডদাতাদের খুঁজে বের করা। তবে এও শুনেছি, কিছু ক্ষেত্রে, ফান্ডদাতারাই উন্নয়নের ব্রত পালন করতে গিয়ে পাগলের মতো এসব প্রকল্পের গবেষকদের খুঁজে বের করে তারপর ফান্ড গুঁজে দেন। আমার ক্ষেত্রে সেরকমও ঘটেনি। ফলে আমি করলাম কী! এই বিশেষ উপলক্ষে পরীমণিকে নিয়ে একটা গবেষণা-প্রকল্পের কল্পনা করতে শুরু করলাম। আমি মনে মনে কল্পনা করে নিলাম যে একজন ফান্ডদাতা আমাকে আচ্ছামতো ফান্ড দিয়ে পরীমণির আলোচিত ইস্যু নিয়ে একটা নিবিড় গবেষণা করতে হুকুম করলেন। ফান্ড পেলে হুকুম পালন না করার কোনোই কারণ নাই। ফলে আমি সেই প্রকল্পের প্রতিবেদন কী হতে পারত তা নিয়েও কল্পনা করে ফেললাম। আমি যেহেতু তেমন কোনো গবেষণা প্রকল্প করি নাই এ ভুবনে, তাই প্রতিবেদন কীভাবে সাজাতে হয় তা নিয়ে বিশেষ কোনো ধারণা নাই। এমনকি প্রতিবেদনের সূচিপত্র আগেই বানানো হয় কিনা তাও ধারণা নাই। মনে হলো আমার মতো প্রকল্প-আনাড়ি কারো পক্ষে আগেভাগেই অধ্যায় সাজিয়ে সূচিপত্র বানিয়ে নিলে সুবিধা বেশি।   

সম্ভাব্য প্রতিবেদনের রূপরেখা

যেহেতু আমার সৃজনশীল সাহিত্যের রোগবালাই আছে, আবার আমার গাম্ভীর্যের বিষয়েও অনেক পাঠক ওয়াকিবহাল, আমার জন্য প্রতিবেদনের মুড বা টোন, ভঙ্গি বা স্বর, নির্ণয় মোটেই সহজ কোনো কাজ ছিল না গত বহুবছর। আজ এই সম্ভাব্য পরীমণি-প্রজেক্ট নিয়ে যে প্রতিবেদনটি হতে পারত, কেবল ফান্ড ও ফান্ডার পেলেই, সেটার ভঙ্গি বা স্বর কিংবা স্বরভঙ্গি কিছুই সহজ কোনো কাজ থাকছে না আমার জন্য। কিন্তু, গোড়াতেই যেমন জানালাম, এই রচনায় কিছু কৃতিত্ব নিতে চাইলে সহজ কোনো রাস্তাই আমার নাই। বরং সকল কৃতিত্ব সকলের আগেই ভাগেযোগে নেয়া হয়ে আছে বলে আমার পক্ষে কঠিন রাস্তাই একমাত্র উপায়। তাহলে প্রথমেই আমি অধ্যায় বিভাজনের চেষ্টা করতে পারি। মোটামুটি আটটি অধ্যায় সেই প্রতিবেদনটিতে থাকতে যাচ্ছে; মানে থাকতে পারত। 

এক।   পরীমণির নায়িকা হিসাবে উত্থান

দুই।   বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কারখানা

তিন।   ‘পরীমণির পুনর্জাগরণের পরিপ্রেক্ষিত কিংবা সিনেমার পুনর্জাগরণের পরীমণিয় পরিপ্রেক্ষিত

চার।   বোটক্লাব তথা তুরাগ কাণ্ড

পাঁচ।   লাইফস্টাইলের চ্যালেঞ্জ এবং খান্দানী হম্বিতম্বি

ছয়।   ‘মাদক! তাই নাকি? কিংবা ভাবমূর্তি আর মূল্যবোধ জর্জরিত বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতা

সাত।   মহাসমারোহে গ্রেপ্তার

আট।   মহামান্য আদালত কিংবা পরীমণির হাসিমুখ কিংবা বজ্র আঁটুনি কিংবা এরশাদের মরণোত্তর চিরসমাধি কিংবা সুবর্ণ জয়ন্তীতে উন্নয়নের নয়াদিগন্ত কিংবা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতি

পরীমণির গ্রেপ্তারের আগে তার বাসার সামনে ভিড়

পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে প্রতিবেদন বা অভিসন্দর্ভের অধ্যায় বিভাজন অত্যন্ত কঠিন বৌদ্ধিক এক কর্মকাণ্ড। দীর্ঘ সময় ধরে গালে হাত বসে দুর্ভাবনা দিলেও অনেক সময় সঠিক অধ্যায় মাথায় আসে না। তারপর বিষয়বস্তু যদিও আবছা-আবছা মাথায় এসে ভর করে, শিরোনাম দেয়া যারপরনাই কঠিন হয়ে পড়ে। আপনারা উপরের অধ্যায় শিরোনামগুলো আরেকবার পড়লেই সেকথা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন। এই এত ভাবনা দেবার পরও সবগুলো শিরোনামের বিষয়ে গাঢ় আস্থা রাখা যাচ্ছে না। অন্তত একটা অধ্যায়-শিরোনামে এবং অব্যয়টা দিতে হয়েছে এমন দুটো ভাবনার মধ্যে যা স্বতন্ত্র দুটো ভাবনা – লাইফস্টাইলের চ্যালেঞ্জ এবং খান্দানী হম্বিতম্বি। তাহলে, বোঝাই যাচ্ছে, এই দুটো স্বতন্ত্র বিষয়কেও একত্রে দেখার বা ভাবার, এমনকি লেখার, দরকার পড়তে পারে। অন্যদিকে একাধিক শিরোনাম ইতিহাসমূলক – যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়। এখানে ইতিহাসমূলক বললেই সব সমাধা হয়ে যাচ্ছে না। কোন ইতিহাসকে কে কীভাবে দেখছেন, তাঁর জন্য ইতিহাসসূত্রগুলো কী, তিনি কীভাবে সেই সূত্রগুলো থেকে একটা কাহিনি বানাচ্ছেন এগুলো সমূহ বিভিন্ন বিষয়।

খোদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কারখানা বিষয়ক একটা ইতিহাস অনুচ্ছেদ লিখতে গেলে ঢাকা শহরের অনেক মিত্রের সাথে আমার কোনোই বনিবনা হবে না। যখন তাঁরা ‘অশ্লীলতা সব খেয়ে ফেলল’ বলে বিলাপ করেছেন, আমি বলেছি ‘নির্দিষ্ট চুক্তির অভাব ও কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত প্রশাসন কারখানাটির প্রধান সমস্যা।’ এখন যখন তাঁরা বলবার চেষ্টা করতে থাকবেন যে ‘ওটিটি এসে তবু তো কিছু কাজ হচ্ছে’ আমি বলতে থাকব ‘এফডিসির জানাজাখানি না পড়ে এর বিলোপের কিছু পলিটিক্যাল ইকনমি তদন্ত করতে হতো আপনাদের’। এরকম নানাবিধ প্যাঁচ। তিন নম্বর, ছয় নম্বর এবং সর্বশেষ তথা আট নম্বর অধ্যায়ে এসে কিছুতেই একটা শিরোনাম দেয়া গেল না। এর মধ্যে পরীমণির পুনর্জাগরণ বিষয়টাই অপেক্ষাকৃত সহজে নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোন কোন আলামতকে তাঁর পুনর্জাগরণ হিসাবে দেখা চলে সেসব আলামতের বিষয়ে ঢাকাবাসীদের সঙ্গে গুরুতর ফারাক হতে থাকবে আমার, এখনই জানি তা। তাছাড়া পরীমণির পুনর্জাগরণকে চলচ্চিত্রের পুনর্জাগরণ হিসাবে দেখা চলবে কিনা সেই বিষয়েও আমাদের ঘোরতর বোঝাবুঝির ভিন্নতা থাকবে। যেমন, আমি ভেবেছি তারকামূল্যের সমাজমনোস্তত্ত্ব দিয়ে। তেমনি বহু লম্ফঝম্পকারী সেটাকেই ‘সিনেমা আবার দাঁড়িয়ে যাবে’ বলে চেঁচামেচি করতে পারেন; যেহেতু  কারখানাটির মৃত্যু বিষয়েই তাঁদের বোঝাবুঝি অত্যন্ত দুর্বল। ছয় নম্বর অধ্যায়ের নামকরণজনিত ঝামেলা বরং পাঠক অনায়াসেই বুঝবেন বলে আশা করে যাই আমি। কারণ, বাংলাদেশ আসলেই একটা মূল্যবোধের দেশ – ল্যান্ড অব ভ্যালুজ। মূল্যবোধ আর ভাবমূর্তি এখানে কিলবিল করতে থাকে, এখানকার ঘনবসতিপূর্ণ জনগণের মতোই। এখানে এইডসের সময়ে পর্যন্ত মন্ত্রীদের আলাপ করতে শোনা গেছে ‘মূল্যবোধের কারণে এইডসের কোনো ভয় নেই আমাদের।’ এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ সকলেরই জানা। বস্তুত মন্ত্রীবৃন্দ সেই অন্তর্নিহিত অর্থটিকেই আরেকবার উদ্ভাসিত করেছেন মাত্র। সেসব রাষ্ট্রনেতারা রক্ত সঞ্চালন কিংবা অন্যান্য উপায়ে রোগবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনাই মাথায় না রেখে কেবল একটা কর্মকাণ্ডতেই ‘মূল্যবোধ’-এর ধ্বজা ধরেছিলেন। আমার মতো নম্র সুনাগরিক প্রজা পর্যন্ত এই কথা শুনে বাংলা মুল্লুকের লোকজনের ওইসব কর্মকাণ্ডহীন জীবন আন্দাজ করে দুখি হয়ে পড়েছিল। ক্যাসিনো-ট্যাসিনো ‘আবিষ্কার’ হবার পর মূল্যবোধের বড়ি আবার সীমিত মাত্রায় সেবন করতে দেন মন্ত্রীবর্গ। ওটিটিতে কয়েকটা ছায়াছবি সম্প্রচারিত হবার পর আবার দেন প্রশাসকেরা। সেই ছায়াছবির দুয়েকটা দেখে ফেলেছিলাম এবং ওগুলো নিয়ে আলাদা করে আলাপ করার দরকারই পড়ত না, যদি না এই প্রশাসকেরা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ফলে মূল্যবোধ বা ভাবমূর্তি বাংলাদেশে নৈমিত্তিক একটা প্যাকেজ; এমন এক জটিল প্যাকেজ যেখানে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খাবার মতো ধর্মভাবনা ও লিবেরেল-ভাবনা একত্রে খিচুড়িকৃত হয়েছে। এসব কথামালার থেকে মোটের উপর সকলের বুঝতে হবে যে, বঙ্গাল মুল্লুকের এই দিকের অংশে মানুষজন গড়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকার বাইরে তেমন কিছু খান না এবং নেহায়েৎ প্রকৃতির বা বিধাতার ইচ্ছায় বউ-বরের (নিজ-নিজ) সাথে সন্তান উৎপাদনের সৎকর্ম-সম্পাদন করা ছাড়া যৌনসম্পর্ক বিষয়ে আমৃত্যু অনীহ থাকেন।

তবে শেষ অধ্যায়ের এতগুলো শিরোনাম দেখে যদি আপনাদের আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত বা সন্ত্রস্ত বা মাথা-আউলা মনে হয়ে থাকে তা খুব একটা সুবিচার আমার উপর হলো না। বরং, যে কোনো অভিসন্দর্ভ বা প্রতিবেদন একটা পজিটিভ-টোনে (বা নোটে) শেষ করার গুরুত্বের বিষয়ে বহু পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ বা ভাড়াটে-গবেষক গলা ফুলিয়ে বহু বছর ধরে বলে আসছেন। এমনকি কখনো কখনো তাঁদের রীতিমত জনগণের করণীয় সম্বন্ধে ডাক্তার সাহেবদের মতো প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত লিখতে দেখা গেছে শেষ অধ্যায়ে। আমার জীবনে এমন কোনো সুকর্ম অতিশয় বিরল যেখানে আমি দাবি করতে পারি যে আমি সমাজের জন্য এরকম কিছু উপকার করতে পেরেছি। আজ পরীমণির অছিলায় সেটা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। ফলে, আমি চেষ্টা করেছি যাতে সর্বোচ্চ ইতিবাচক নোটে (বা টোনে) এই অধ্যায়টি লিখিত হয়ে থাকে। আর সেই সদিচ্ছার কারণে এর কোনো শিরোনামই নিজের হাতে ধরে আমি বাদ দিতে পারছি না। এটা ঠিকই যে ছয়টি শিরোনামের সবগুলোকেই আপনাদের হয়তো একই রকম প্রাসঙ্গিক লাগবে না। তবে সেটা প্রাথমিক বা লঘুবিচারেই কেবল মাত্র। যদি আমি খানিকটা ভাবতে সাহায্য করি, দেখবেন সবগুলোই অতিপ্রাসঙ্গিক। অবশ্যই, আমার নিজেরও অনেক পছন্দ ‘পরীমণির হাসিমুখ’। তিনি কারাগারে থাকার সময়কালকে পর্যালোচনা করলে, বাংলাদেশে তাঁর ভক্তদের আকুতি বিবেচনা করলে, বাহ্যত সারাক্ষণ অন্যসময়ে নারীবিদ্বেষী যেসব পক্ষ তারা পর্যন্ত জটিল ধরনের সমর্থন দেবার কারণে, এবং জামিন পাবার পর তাঁর জন-দরবারে হাজির হবার প্রক্রিয়ামালাকে বিশ্লেষণ করলে এটা গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়নকে ভুলে থাকাও তো কোনো ঠিক কাজ নয়! কিংবা সামগ্রিক স্বাস্থ্যনীতি (বা নিন্দুকদের মতে স্বাস্থ্যদুর্নীতি) পরীমণি ইস্যুর সাথে মিলিয়ে দেখা তো কম লোকে করেননি! ‘মহামান্য আদালত’ আর ‘বজ্র আঁটুনি’ কমবেশি একই নাম। তবে আদালত যেহেতু সকলের ভক্তিশ্রদ্ধার জায়গা এবং সার্বভৌম, এবং বিচার-বিভাগীয় স্বাধীনতা যেহেতু আধুনিক গণতন্ত্রের মূলকথা, তাই এই শিরোনামের সঙ্গে পরেরটার সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। যখন ‘বজ্র আঁটুনি’ বলছি তখন প্রশাসনের নানাবিধ দুর্বোধ্য ও দুর্বুদ্ধির কারকপক্ষের দিকে একটা ইঙ্গিত আছে যার অংশ হিসাবে কিছুতেই আদালতকে কখনোই আমাদের কল্পনা করার চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। আপনার সেসব কল্পনাকেও আমরা সুনাগরিক পক্ষ অবশ্যই আদালত-অবমাননা হিসাবে দাবি করতে থাকব। সেই অর্থে ইতিবাচক ভঙ্গিতে এই দুয়ের মধ্যে পরের শিরোনামটা খুব একটা ভাল কাজ করে না তা সত্য। অস্বীকার করব না যে, ‘এরশাদের মরণোত্তর চিরসমাধি’ কিংবা ‘সুবর্ণ জয়ন্তী…’ বেশ দূরের প্রসঙ্গ মনে হবার অবকাশ আছে। কিন্তু সত্যি কথা বললে, এরশাদ একজন মহীরূহবিশেষ। তিনি কেবল তিনি নন, তিনি একজন প্রতিষ্ঠান। তিনি হলেন সেইজন যিনি সামরিক শাসক হিসাবে প্রায় আরামসে গদি ছেড়ে দিয়েছিলেন, লোকজনকে ‘গণ অভ্যুত্থান’-এর গৌরব পেতে দিয়েছিলেন এবং তা নিয়ে রাগ দেখাননি, তারপর নতুন কোট বানিয়ে গোলাপফুল লাগিয়ে সংসদে বসেছিলেন এবং অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছিলেন। বিশ্বের দীর্ঘ রাষ্ট্রনীতিক ইতিহাসে এই ধরনের আরেকজন তুল্য ব্যক্তিত্ব আপনারা হাজির করতে পারলেই কেবল আপনাদের আপত্তি আমলে আনা যেতে পারে। এখানে মরণোত্তর সমাধি বলে দ্বিরুক্তি করা হয়নি। বরং, এরশাদের গদি-ছাড়াকে যে নেচেকুঁদে সামরিক/এরশাদ-শাসনের সমাধি ভাবা হলো, সেই ভ্রান্তিটাকে ঐতিহাসিকভাবে কিছুটা মেরামতির চেষ্টা আছে।

প্রিজন ভ্যানে পরীমণি

পরীমণি বিষয়ক প্রকল্প-প্রতিবেদনের শেষ অধ্যায়ে এরশাদ কেবল এই কারণে আসেননি যে নায়িকাদের বিষয়ে তাঁর জিজ্ঞাসু মন ছিল, বরং এই কারণে যে তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে আমি দেখে থাকি বাংলাদেশে জটিল সব ব্যবসায়ীদের একটা পরম আঁতাতের স্মারক হিসাবে। এই জটিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন পক্ষও আছেন যাঁদের নাম আমি মুখেও আনতে চাই না। আনা ঠিকও হবে না। আজকের পরীমণি কাণ্ডটিকে দেখতে আমাদের ওই ৯০ সালের ঘটনাটিকেও স্মরণ করা আমার তরফে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করার একটা আন্তরিক ও বিনম্র প্রচেষ্টা মাত্র। উপরন্তু, যাঁদের নাম আমি মুখে আনলাম না, সেই বিনয়ও (ও ভীতি) এখানে স্মর্তব্য বিশেষত ‘মহাসমারোহে গ্রেপ্তার’ অধ্যায়টির সঙ্গে যদি আমরা মিলিয়ে পড়ি। ‘সুবর্ণজয়ন্তী..’ বরং খানিকটা ভিস্যুয়াল উত্তেজনা থেকে এসেছে। আমি টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে দেখি কেবল ক্রিকেট-চ্যানেল কিংবা বড়জোর ক্রাইমপেট্রোল। যেহেতু পরীমণি পরিস্থিতি ইন্ডিয়ান ক্রাইমপেট্রোল বা ক্রিকেট-প্রচার কেউই কাভার করেনি, যা ও যতটুকু পরীমণি-পরিস্থিতি টেলিভিশনে দেখেছি তা পরিচিত লোকজনের লাগাতার ‘তথ্য সরবরাহ করে মাথা খারাপ করে দেবার সৎ মনোভাবের’ বদৌলতে। কাউকে কাউকে ফোনে বা ইনবক্সে নিরস্ত করতেও চ্যানেলে একটু-আধটু দেখা হয়েছে, দুই-তিন মিনিট। কিন্তু সকল বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোতেই ঊর্ধ্বপানের পর্দার বাম বা ডানদিকে সুবর্ণ লোগোখানি থাকার কারণে একটা ভিস্যুয়াল রিয়েলিটিটি আমাকে খুবই উদ্ভাসিত করেছে। ফলে ওটাকে উদ্ভাসমূলক বা উচ্ছ্বাসমূলক শিরোনাম হিসাবে দেখা চলতে পারে। তাই বলে মিলায়ে দিতে পারব না তা ভাববেন না।

অধ্যায়সমূহকে বিশদকরণ

যেভাবে আগাচ্ছিলাম আমার প্রজেক্ট নিয়ে তা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছ – যত পারা যায় সুচারু সূচিপত্র সমেত। তো অধ্যায় বিভাজনের পরের ধাপ তাহলে থাকে প্রতিটি অধ্যায়ের যতটা পারা যায় বিশদকরণ। এটা সূচিপত্র বানিয়েও হতে পারে, আবার বুলেটাকারে মূল পর্যবেক্ষণ বা যুক্তিগুলো আপাতত টুকে রেখেও হতে পারে। খুব যে তাতে ভিন্ন কিছু হবে তা মনে হয় না। কিন্তু এই পর্বকালে এসে তো এক মহাযজ্ঞের পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াল। একটা অধ্যায়ে কী রাখব আর কী রাখব না সেটা নির্ধারণই বিশ্রী রকমের একটা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। কোনটা রাখতে গেলে কী প্রামাণ্য দিতে হবে, কোনটা রাখলে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা ‘হয় নাই, হয় নাই, আন্দাজে বলতেছো’ বলবেন সেসব ভেবে রক্ত হিম হবার দশা। এত কিছু কীভাবে কোথায় রাখা হবে, কিংবা সেগুলোর ‘উপাত্ত’ কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে, কিংবা সেসব ‘উপাত্ত’ সংগ্রহ আদৌ কোনো সহজ কাজ হবে কিনা, কিংবা তাতে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিতে কেউ চাইতে পারেন কিনা, পরিশেষে প্রজেক্ট-ফান্ডার এতে টাকা দেবেন কিনা – সেসব দুশ্চিন্তা না-করার উপায় থাকছে না। উদাহরণ হিসাবে ‘বোটক্লাব তথা তুরাগ কাণ্ড’ অধ্যায়টি নিয়েই ভাবতে পারি।

বোটক্লাব যদি কেবল বোটক্লাব হতো তাহলে এক কথা। ঢাকায় যেমন একটা জাহাজবাড়ি ছিল যার সঙ্গে সমুদ্রের কোনো সম্বন্ধ ছিল না; কেবল পাশে ধানমণ্ডি নালা (বা মতান্তরে লেক) ছিল। কিন্তু এখানে ক্লাবটি খোদ নদীর উপরে স্থাপিত, যে নদীর নাম আবার তুরাগ। তুরাগ নদী এমনিতেই স্বর্ণগর্ভা। এর পেটের মধ্য থেকে কত কী যে বেরোল। খুব নিরীখ করে ভাবলে হয়তো ইষ্টগর্ভা নামও দেয়া যায়। তুরাগ নদীর আশপাশে বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চলগুলোতে যে হারে ইঁটের ভাঁটা গড়ে উঠেছে তাতে ইষ্টগর্ভা নামটা আমাদের ইষ্টপূরণেও সহায়তা করতে পারে। তারপর আছে প্লট। কিছু জমির প্লট তুরাগের পেট থেকেই উদিত হয়েছে। একদম পেট থেকে। এর মধ্যে পেট্রোল পাম্প ছাড়াও দুয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকতে পারে। গিয়ে আবার দেখতে হবে। ওদিকে সারাক্ষণ বালিমালি তোলা-ফেলা তো আছেই। নাগরিক আত্মারা ঢাকায় পিষ্ট হয়ে গেলে তাঁরা ইষ্টদর্শনে না গেলেও, এই নদীরই বুকের উপর লাগাতার রেঁস্তোরাগুলোতে পুষ্ট হতে যান। আবার শুনেছিলাম, এই নদীর সীমানা নির্ধারণের সময় বর্ষাকালের ভরাযৌবনা সীমানা (আদৌ নদীটার জান আছে ধরে নিয়ে) নির্ধারণ করে খুঁটিপোতা হয়নি। হয়েছে সুবিধামতো জায়গায় যাতে আরো প্লট উদিত হয়। সব মিলে একটা বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপারসাপার। তার মধ্যে, বোটক্লাবে গিয়ে পরীমণি নাকি এমন এক কর্মকর্তার নাম বলেছেন যিনি কেবল জনগণকে নিরাপত্তা দেবার জন্যই দিনরাত্রি কাজ করে যাচ্ছেন। আর মাঝেমধ্যে মাস্ক পরতে বলছেন লোকজনকে। সেই কর্মকর্তার নাম ওই ক্লাবের সাথে পেঁচায়ে ফেলে পরীমণি সত্যনিষ্ঠা করেছেন নাকি ক্লাবটির দিকে বিষ্ঠানিক্ষেপে ব্রতী হয়েছেন সেই বিষয়ে খোদ ক্লাব কর্তৃপক্ষই যথেষ্ট নিশ্চিত হতে পারেননি। আমরা তো সাধারণ মানুষ!

আদালতে পরীমণি

কিংবা ‘মহাসমারোহে গ্রেপ্তার’! এই অধ্যায়টিকেই বা সহজে বিশদ করা যাচ্ছে কীভাবে! এই পরিমাণ হৈচৈ করে গ্রেপ্তার করতে যাবার মনোস্তত্ত্বই যদি ভাবতে বসি আমরা তাহলে সেটা কি মনোস্তত্ত্ব হবে নাকি সমাজতত্ত্ব হবে নাকি সমাজমনোস্তত্ত্ব হবে তাও নির্ধারণ করা সহজ নয়। কে বা কে-কে সাংবাদিকদের এই পরিমাণ অংশকে জানালেন যে ‘আমরা গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছি কিন্তু’! তাঁরা এই জানানোর সময়ে কি সাধারণ প্রেসনোটের মতো করে আগিয়েছিলেন নাকি গভইনফোর মতো এসএমএস করেই নিখিল বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন? এই জানানোটা কি আন্তঃবাহিনী সাধিত হয়েছিল? সেসব মহা-গৌরববাহী বাহিনী কি কোলাকুলি করতে করতেই কাজ করেছেন নাকি নিজেদের মধ্যে ভালোরকম ক্যাচাল ছিল? গ্রেপ্তারের কোনোরকম আগাম খবর কি কেউ পরীমণিকে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন নাকি করেননি? আচ্ছা যদি ধরেও নিই যে সাংবাদিকদের জন্য কন্টেন্ট গুরুত্বপূর্ণ, পরীমণিকে জানানোর থেকে, কিন্তু বাহিনীসমূহের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দয়ালু ধরনের কেউ কি কখনো জীবনে কাউকেই আগাম কিছু জানান নাই? আচ্ছা যদি কেউ কাউকেই কিছু না-জানিয়েও থাকেন, পরীমণির বন্ধুদের মধ্যে কারোরই তুরাগ কাণ্ডের পর মনে হয় নাই যে বাসার কিছু বোতল-শিশি সরানো ভালো? সেই বাসাটাই বা কার? পরীমণির তো বটেই, অন্তত রেফরেন্স হিসাবে কার বা কার-কার? এই শিশিবোতলগুলো ঠিকঠাক মতো গোণা হয়েছিল কিনা? আমি তো এমনকি এও জানি না যে এসব বোতলের আদালতে যেতে হয় কিনা, বা প্রবেশাধিকার আছে কিনা! এই অধ্যায়ে হাজার রকমের প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে; আমি মাত্র সামান্যই উল্লেখ করলাম। আবার ‘মাদক! তাই নাকি?’ অধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে-জুলিয়েই এগুলো দাঁড় করাতে হবে। এভাবে দেখা যাচ্ছে, যত ভাবতে চাই, ততই আরো গহীনে পেঁচায়ে যাই। একটা অধ্যায় নিয়েই পুরা প্রতিবেদনের পরিশ্রম হবার পরিস্থিতি। একটা মহাতালগোল ও বিচিত্র সব পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়ে পড়ছি যার কারণে প্রজেক্টটা ঠিকমতো দাঁড় করাতে গেলে অত্যন্ত বিশালাকার একটা কাজে পরিণত হতে যাচ্ছে। উপরন্তু, আমার আশঙ্কা হচ্ছে ফান্ডারদের আর কোনোই আগ্রহ থাকবে না।

ফলত…

জীবনে একটা প্রজেক্ট অন্তত ঠিকঠাকমতো নিজে থেকে করতে পারার যে সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা আমার নিজেরই বাতিল করতে হলো। এই বিপুল পরিমাণ জিজ্ঞাসা একটা গবেষণায় ভরে দিতে গেলে বহু লম্বা সময় লাগবে। জানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। নিজের চাকরি-বাকরি করার সময়ে টানাটানি পড়বে। গবেষণা-সহকারীবৃন্দকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। আর ফান্ড না পাবার কারণে তাঁদেরও বিশেষ কোনো উৎসাহ না-থাকবে। এভাবে একটা প্রজেক্ট শুরু করার কোনোই মানে হয় না। সেজন্য অত্যন্ত কাছাকাছি কনচেপচুয়েলাইজেশন বা ইনসেপশনে থাকা সত্ত্বেও আমি এই প্রজেক্ট আর দাঁড় করাচ্ছি না। বরং মনোযোগ দিয়ে গ্রেপ্তারের আগে, গ্রেপ্তারের সময়ে, গ্রেপ্তারের পরে, জামিনের পরে পরীমণির দাঁড়িয়ে-থাকা ভঙ্গিগুলো আরো মনোযোগ দিয়ে, আরো সংবেদ দিয়ে, আরো অভিনিবেশ দিয়ে দেখার একটা সুযোগ হিসাবে নিলাম। পণ্ডিতেরা বলেছেন অক্ষমতাকে সক্ষমতায় রূপান্তর ঘটানোই আসল ম্যাজিক। আমার এই প্রজেক্ট-অকর্মণ্য দশাকে আমি পরীমণির দিকে আরো সূক্ষ্মভাবে তাকানোর অবকাশ হিসাবে নিলাম।

কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসছেন পরীমণি

তিনি আইকন! এটা নতুন কোনো কথা হলো না। কিন্তু তিনি অত্যন্ত জটিল ধরনের আইকন। তিনি বাংলাদেশের মৃত চলচ্চিত্র কারখানার জীবিত চলচ্চিত্র-আইকন। তিনি মিসোজিনিস্ট বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত সাইবার প্রজাদের জন্য সমর্থনপ্রাপ্ত ‘একরোখা নারী’ আইকন। তিনি নাগরিক উচ্চম্মন্য সাংস্কৃতিক দশার সঙ্গে নেগোসিয়েশন শিখতে-থাকা বেনাগরিক আইকন। তিনি মনোলিথিক ‘ভালো মেয়ের গল্পপ্রবাহে’ ডিভিয়েন্ট-তথাপি-সমাদৃত আইকন। তিনি বিশাল এক পাওয়ার নেক্সাসের অবোধগম্য আইস-টিপ আইকন। তিনি নবীনা; এবং সম্ভবত দীর্ঘ দীর্ঘ সময় বিস্মৃত থাকবার এক অনাগত কালের গাঢ় বেদনাপর্বের আগাম আইকনও।  

(১০, ১৫, ১৬ অক্টোবর ২০২১।। আদাবর, ঢাকা। ৩.১৯ পিএম। প্রকাশিত: ম্যাজিক লণ্ঠন, সংখ্যা ২২, জানুয়ারি ২২)


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন