Select Page

প্রসঙ্গঃ শঙ্খচিল

প্রসঙ্গঃ শঙ্খচিল

Shonkhochil joint venture film by goutam ghosh with prasenjit kushum shikder mamunur rashid (8)এই যে গৌতম ঘোষ শঙ্খচিল নামের একটা সিনেমা বানাল এবং সেখানে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার সেন্টিমেন্ট তৈরী করল এবং দেখা গেল দেশের অধিকাংশই বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি।

একটা সময় ছিল আমরা গৌতম ঘোষকে সম্মান করতাম। তার সিনেমা মেকিঙয়ের প্রশংসা আমি এখনও করি। কিন্তু শঙ্খচিল নির্মান এই গুনি ব্যক্তিটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেলেও বাংলাদেশের মানুষের কাছে মারা খেয়ে গেল।

ছুডো একটা পোর্টাল থেকে শুরু করে জাতীয় দৈনিক ঘোষকে নিয়ম করে ছয় ইঞ্চি আট ইঞ্চি করে ভরতেছে। আমার ফ্রেন্ডলিষ্ট এত ব্রড এত ওয়াইড অথচ একটাও পজেটিভ রিভিউ আমি পেলাম না। গালাগালি আর নেগেটিভ রিভিউয়ের ছড়াছড়ি।

কেউ কেউ আবেগি কন্ঠে বলতেছে ‘গৌতম ফেলেনির কান্না শুনতে পায় নি, হিউমার করে বলতেছে, প্রতিদিন রাতে ভারতীয় দালাল ব্যবসায়িরা তার মাথায় হাগে (বাইশে শ্রাবন) । গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলতেছে, বুড়ো বয়সের ভিমরতি। আবার কেউ কেউ একটু রক্ষনশীল হয়ে বলতেছে, এই সিনেমা বানানো আর আমাদের স্মৃতিসৌধে লাথি মারা এক কথা।

বয়স বাড়লে মানুষ স্বাধীন হয়। তখন সে আরও সত্য প্রকাশ করে। যেমন এখন অমিতাভ বচ্চন কিছু সত্য স্বীকার করতেছে। সুনীল,হুয়ামুন এরাও গত হবার আগে আগে অধিকাংশ লেখাই যে ট্রাশ তা স্বীকার করেছেন এবং অনুরোধে ঢেকি গিলে আমাদের যে কিছু বাল ছাল উপহার দিয়েছেন, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আল্টিমেইটলি মানুষ মৃত্যুর আগে সম্মান নিয়ে মরতে চায়। কিন্তু ঘোষের জন্য করুনা হচ্ছে – সম্মানটা সে ধরে রাখতে পারলনা। তার সম্মান নামের শংখচিল বাংলাদেশের বর্ডার ক্রশ করে ইন্ডিয়ায় স্থায়ী হয়ে গেল। আগামিতে এদিকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব ক্ষীন। সে যে বাঙ্গালির কোথায় ঘা দিয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। কিন্তু বোঝা উচিত ছিল। অঞ্জন দত্ত ‘ মধ্য-মেধা ‘ বলতে কি এদের বুঝিয়েছেন ?

যাইহোক, ইতোমধ্যে, নির্বাসিত নামে তসলিমাকে নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে- আমাদের জাতীয় সঙ্গিত ব্যবহার করিয়ে- সাম্প্রদায়িকতার চুড়ান্ত লেভেল রিচ করে যথেষ্ট পরিমান উস্কানি দেয়া হয়েছে। কাজটা করছে কৌশিক গাঙ্গুলির বউ চুর্ণি গাঙ্গুলি। সেটাকেও আবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার দেয়া হয়েছে- এরকম একটা থার্ড ক্লাস ফর্মুলাটিক ফিল্মকে কিভাবে জাতীয় পুরস্কার দেয়া হল, সেটা নিয়ে অত বড় দেশটার কেউ প্রশ্ন তুলল না ?

শঙ্খচিল এ বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। এইটাও ঐ এক রকম। বাংলাদেশ যদি অখন্ড ভারতই হবে, তবে সে আলাদা হইছিল কেন ? স্বাধীনতা সংগ্রাম করছে কেন ?

যাইহোক, আগে আমরা আদর করে বলতাম ঋতুদা, গৌতম দা। ঋতুদা ঋতুদাই রয়ে গেল, কিন্তু শংখচিল দেখার পর গৌতম ঘোষ হয়ে গেল গৌতম ‘চোদ’ । সিরিয়াসলি, ক্যাম্পাসে একটু কান রাখলেই এই গৌতম চোদ শব্দটা শুনতে পাওয়া যাবে। এই ভাবমুর্তির কি করার দরকার ছিল কিছু ? আমারত শুনতে খারাপ লাগে।

[su_box title=”শঙ্খচিল নিয়ে আরও পড়ুন” box_color=”#0f86de”]|| বরাবরের মতোই দুই বাংলা আলাদা না || কাঁটাতার হয়ে বিঁধে আছে গৌতম ঘোষের শঙ্খচিল || [/su_box]

ঋতুপর্ন মারা যাবার সাথে সাথে আমি বলেছিলাম, এই ইন্ড্রাষ্ট্রি থাকবে না, ধ্বংস অনিবার্য। চেতনা না থাকলে হিসাব মেলেনা। সেইটাই হইছে। পশ্চীম বাংলার সিনেমা শীল্প এখন প্রায় আধমরা, নিভু নিভু। হিন্দি আর ইংরেজি আগ্রাসনে বাংলা সিনেমা মানুষ দেখেনা এখন আর। ওপারের আর্টিষ্ট খুব সিমিত এবং অহংকার করার মত মেধাবিও বটে,দুই বাংলা মিলে সিনেমা বানালে ভালো ব্যবসা হবে, ঐ সিমিত আর্টিষ্টরা খেয়ে পরে বেচে থাকতে পারবে আটলিষ্ট। এটা করুনা নয়, সমবেদনা। কিন্তু তাই বলে এইসব।

যুক্তিবাদিদের ধারনা, কিছু টাকা পয়সার জন্য গৌতম এরকম করেছে। কিন্তু টাকা পয়সার অভাবে এরকম করতে হবে কেন ? সিনেমা বাদ দিয়ে অন্য কাজ করবেন। কবি সুকান্তর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে তিনি বললেই পারেন,

সিনেমা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥

ইন্ডিয়া পেয়াজ খায় কম, সেখান থেকে প্রচুর পেয়াজ আসে এদেশে। কম দামে কিনি, আর আমরা প্রচুর পেয়াজও খাই। তাতে শরীর থাকে গরম, মাথা ও রক্তও থাকে গরম। আমার ভয় হয়, গৌতম বাংলাদেশে আসলে দু একজন সাংবাদিক না জুতা ছুড়ে মারেন। দু একটা শয়তান আছে, এরা চড় থাপ্পড়ও মেরে বসতে পারে।

ইদানিং দেশ বিভাগ নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা মর্ডান সেন্টিমেন্ট তৈরী হইছে। শংখচিল দেখার পর বিষয়টা আলোতে আসছে। কোলকাতা কেন ঢাকার সাথে নেই,আমি কেন চাইলে কোলকাতায় চিকিৎসা করাতে যেতে পারব না,আমি কেন কোলকাতায় ঘুরতে যেতে পারব না ? এগুলোই কি দেশ বিভাগের ক্ষত।

রেডকিলফ সাহেব যখন দেশ বিভাগ ঘোষনা করেন সেখানে দুই বাংলার নেতারা উপস্থিত ছিল। তাদের একেকজন ছিল বিশাল জ্ঞানী। তাদের প্রত্যেক ঘরে লাইব্রেরি ছিল। হেন কোন বই নেই যে তারা পড়েনি। এত বুদ্ধিমান হয়েও তারা কেন ভাগের সীধান্ত নিলেন ক্ষত হল সেটা। আমি কেন কোলকাতায় ঘুরতে যেতে পারবনা। পারবেন না কেন, যান ঘুরে আসুন। লাগবে খালি পাসপোর্ট। এটা কোন ক্ষত না।

ক্ষত হল ওইসময়ের দাঙ্গা। অসংখ্য মানুষ মারা গেছে সেইসময়ে। হিন্দুরা মুসল্মান মেরেছে, মুসলমানরে হিন্দুরে। কচু কাটা করা হয়েছে। রক্ত রক্ত। লক্ষ লক্ষ হিন্দু ওপার গেছে। মুসলমানরা এপার আসছে। এপার ওপার দুপারেই চলছে বাড়ি দখল,হত্যা,ধর্ষন,ডাকাতি। একটু খেয়াল করে দেখবেন আপনার পরিচিত প্রায় সকলেরই গ্রামে জায়গা আছে, খুব অল্প দামে কেনা সেসময়ে। অধিকাংশই দখল করা। এসব হল দেশবিভাগের ক্ষত।
দেশবিভাগের আসল ক্ষত বোঝার জন্য সুনীল পড়ুন। ঋত্বিক ঘটকের মুভি দেখুন। সল্পবাজেটের সিনেমা রাজকাহিনিতেও কিছুটা দেখানো হইছে। শংচিল হল দেশবিভাগের সেন্টিমেন্টাল ফিকশান। এটা বলিউডের ‘মাঝি-দ্য মাউন্টেন ম্যান’ এর একটা ফর্মুলাটিক আডাপশান। মাঝি-তে পাহাড় হল ফ্যাক্ট, এখানে ফ্যাক্ট হল কাটাতাড়। বাদবাকি সেম ক্রাইসিস।

৪৭ এর পরে কোলকাতার অনেকেই মনে করত, ১৯১১ সালের মত বঙ্গভঙ্গ আবার রোদ করা হবে। কিন্তু এই দাঙ্গা-টাঙ্গা করে, বাড়ি দখল সেড়ে, অভিনব এই ইমাজিন রিয়ালিটিতে ক্ষাপ খাইয়ে, নতুনভাবে জীবনটা কে ঘুছিয়ে নিতে না নিতে আমার প্রিপারেশান নিতে হয়েছে ভাষা আন্দোলনের জন্য। তারপরেই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। একের পর এক টিকে থাকার সংগ্রাম। মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতার সংগ্রাম। তখন আমি কোলকাতায় চিকিৎসা করাতে পারব না কেন, সেই প্রশ্নের সময় নয়। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের স্মৃতিসৌধের এই সাতটা স্তম্ভ। সাতটা প্রতিনিধি। সেখানে দেশবিভাগ নেই। তারপরেও থামেনি বুদ্ধিজিবী হত্যা, মুজিব হত্যা, সেনা অভ্যুন্থান, জিয়া হত্যা, স্বৈরতন্ত্রের পতন, শাহবাগ আন্দোলন। নিশ্বাস ফেলার সময় নেই আমাদের কাছে।

যেকোন সিনেমা বানাবার আগে গৌতম-দা একটু চিন্তা করে নেবেন, আমরা কি বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম ‘বাল’ ছেড়ার জন্য ?
নিশ্চয়ই না। সেটা মাথায় রেখে শিল্প নির্মান করেন, আমার দেশের জাতীয় পুরস্কারও পাবেন। আদর নেবেন, সোহাগ পাবেন। ইলিশ খাবেন।


মন্তব্য করুন