বদির প্রস্থান
বাকের, বদি ও মজনু। পাড়ার মাস্তান তারা, তবে একটু অন্য কিসিমের। বেশ শত্রু জুটেছিল, তার মধ্যে ভয়ংকর খারাপ লোকও ছিল। তাদের চক্রান্তে তিনজনেই ফেঁসে গেল খুনের মামলায়।
ত্রিরত্নের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারছেন আইনজীবী। তখন পরিবারের কথা ভেবে রাজসাক্ষী হতে রাজি হলো বদি। এ যেন বাংলা নাটকের জুদাস! বাকেরের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল মানুষ। বদিকে কি তারা ঘৃণা করতো? না।
মাইরের মধ্যে ভাইটামিন আছে— এ নাটকে বদির আলোচিত সংলাপ ছিল এটি। যা অনেক দিন মানুষের মুখে মুখে ছিল।
এভাবে বিটিভির আইকনিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এ শুরু থেকে হাস্যরস জোগালেও শেষ ট্র্যাজেডি নামে বদির হাত ধরে। বাকের ভাই তাকে ক্ষমা করে, দর্শকও এ করুণা মেনে নেই। এটা কোনো দৈব দুর্বিপাক নয়, এখানকার সাধারণ মানুষের সাধারণ ট্র্যাজেডি এমন।
দর্শক সেটা জানত বটে!
যিশুর নাম আসলে যেমন জুদাস চলে আসে, তেমনি বদি ছাড়া বাকেরকে ভাবা যায় না!
শনিবার সকালে মারা গেলেন ‘বদি’ চরিত্রের আবদুল কাদের। অবশ্য তার সাম্প্রতিক অবস্থা দেখে এটা অনুমানই করা গিয়েছিল। তার অসুস্থার খবর চাউর হওয়ার পর থেকে দুই যুগ পর আবারও বদি চরিত্রটি আলোচনায় উঠে আসে।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও বরকত উল্লাহ নির্দেশিত এ নাটকের আলোচিত অন্য দুই চরিত্র বাকের ভাই ও মজনু করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর ও লুৎফর রহমান জর্জ। দর্শক আজও তাদের ওই নাটকের চরিত্রেই ডাকে। মাঝে একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও হয়। সেখানে দুই যুগের ব্যবধানে এক ফ্রেমে দেখা যায় বাকের, বদি ও মজনুকে।
‘কোথাও কেউ নেই’ ছাড়াও মাটির কোলে, নক্ষত্রের রাত, শীর্ষবিন্দু, সবুজ সাথী, তিন টেক্কা, যুবরাজ, আগুন লাগা সন্ধ্যা, প্যাকেজ সংবাদ, সবুজ ছায়া, কুসুম কুসুম ভালোবাসা, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, আমাদের ছোট নদী, দুলাভাই, অজ্ঞান পার্টি, মোবারকের ঈদ, বহুরূপী, এই মেকআপ, ঢুলি বাড়ি, এক জনমে, জল পড়ে পাতা নড়ে, খান বাহাদুরের তিন ছেলে ইত্যাদি। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও পরিচালনায় নির্মিত। বলা যায়, বিশ্বাসঘাতক বদির পর আবদুল কাদেরের ইমেজ উদ্ধার করেন হুমায়ূন। একাধিক নাটকে আবদুল কাদেরকে তিনি ‘দুলাভাই’ চরিত্রে নিয়ে আসেন। ফলত টিভি নাটকে ‘কমন দুলাভাই’-এ পরিণত হন কাদের। করেছিলেন আমজাদ হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, ইমদাদুল হক মিলনসহ নামি লেখক ও নির্মাতাদের নাটকও।
সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থতার খবরে আলোচনায় আসেন আবদুল কাদের। চলতি মাসে তার অবস্থার গুরুতর অবনতি হয়। যেতে হয় বিদেশেও। উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ ডিসেম্বর চেন্নাইয়ে নেওয়া হয় তাকে। ১৫ ডিসেম্বর তার ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন, ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শারীরিক দুর্বলতার কারণে কেমোথেরাপি যাচ্ছিল না। গত সপ্তাহে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন ২১ ডিসেম্বর তার শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার কিছুটা ভালো ছিলেন আবদুল কাদের। কিন্তু এরপর অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
নাটকের মতোই বাকের আর বদির সম্পর্ক ভীষণ আন্তরিক ছিল। বদির অসুস্থতার খবর শুনে মন খারাপের কথা জানিয়েছিলেন বাকের ভাই। ওই সময় মাত্র করোনামুক্ত হাসপাতাল চেয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। এক স্ট্যাটাসে নিজের খবর দেওয়ার পর বলেন, মনটা খারাপ হয়ে গেল দীর্ঘদিনের পথ চলার সঙ্গী নাট্যাভিনেতা আবদুল কাদেরের অসুস্থতার খবর পেয়ে। ভেলোর থেকে ঢাকায় ফিরে এখন চিকিৎসাধীন। আমাদের সবার প্রার্থনা যুক্ত হোক তার অরোগ্য ও মঙ্গল কামনায়। সবার সুস্থতা ও মঙ্গল কামনা করছি। নতুন বছরে সব বিপদ কেটে যাবে, হাসবে বাংলাদেশ এবং হাসবে পৃথিবী এই একমাত্র কামনা।
কয়েক দিন আগে আবদুল কাদেরকে ফোন করে সাহস জোগান নূর। তখন চেন্নাই থেকে আবদুল কাদেরের পুত্রবধূ জাহিদা ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে জানান, আসাদুজ্জামান নূর তার শ্বশুরকে বলেছেন, তিনি ঢাকায় এলে আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারা সব সময় তার পাশে আছেন। তার জন্য অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে সবকিছু প্রস্তুত রাখা হবে। জাহিদা আরও জানান, কাদের কারো সঙ্গেই কথা বলতে চাইছিলেন না। কিন্তু ‘নূর আংকেলের’ ফোনে কিছুটা সাহস পেয়েছেন।
এক নজরে আবদুল কাদের: ১৯৫১ সালে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবার নাম আবদুল জলিল ও মা আনোয়ারা খাতুন।
আবদুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি অর্থনীতিতে সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরির পর ১৯৭৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাটাতে চাকরি করেন। সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর।
১৯৭২-৭৪ পরপর তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২ সালে আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন মহসিন হলের নাটক সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান ‘বলুন দেখি’তে চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে পুরস্কার পাওয়া আবদুল কাদের ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সাল থেকে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য এবং চার বছর যুগ্ম সম্পাদকের ও ছয় বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৭৩ সাল থেকে রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু হয় তার।
টেলিভিশনে আবদুল কাদের অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এসো গল্পের দেশে’। আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের একমাত্র সংগঠন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদের (টেনাশিনাস) সহসভাপতি ছিলেন। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।
থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনার এক হাজারের বেশি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, স্পর্ধা, দুই বোন ও মেরাজ ফকিরের মা। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের নাটক থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এ অভিনয়। এ ছাড়া দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, দুবাই এবং দেশের প্রায় সব কটি জেলায় আমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় করেছেন। টেলিভিশন নাটক ছাড়াও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আবদুল কাদের।