Select Page

বন্ধুত্ব ও ত্যাগের অসাধারণ গল্প ‘অবুঝ মন’

বন্ধুত্ব ও ত্যাগের অসাধারণ গল্প ‘অবুঝ মন’

আমার বাসা ছিলো উজালা স্টুডিও ও উজালা বোডিংয়ের পেছনে। আর মাত্র ৫০ গজ দূরে ছিলো উজালা সিনেমা। বোডিং ও স্টুডিওয়ের বিপরীতে স্টেশন রোডের ওপারে ছিলো চট্টগ্রামের বিখ্যাত সেই হল।

আমি তখন খুব ছোট, বয়স দশ-বারো হবে। উজালা সিনেমা হলের করিডরে কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবিটির পোস্টার দেখতাম, যার ওপর লেখা ‘আসিতেছে’।

ছবিটি দেখার আগ্রহ জাগে শিখা দিদির কারণে। জিআরপি থানার পেছনে ছিলো জিআরপি কলোনি। সেই কলোনির বাসিন্দা শিখা দিদি আর ওসির ছেলে আহসান প্রেম করতো। আমিই ছিলাম সেই প্রেমিক-প্রেমিকার পিয়ন, তাদের চিঠি আদান-প্রদান করে দিতাম।

শিখা দিদি আমাকে এই কাজে নিযুক্ত করে। বিনিময়ে দিদি আমার গালে একটি চুমু দিত আর আহসান ভাই নাবিস্কোর লেমনচুষ। এক সময় তারা পালিয়ে যায়। তখন কলোনিতে তোলপাড় শুরু হয়, কারণ তারা ছিলো ভিন্ন ধর্মের।

অনেকের কাছে শুনতাম ‘অবুঝ মন’ দুই ধর্মের দুই যুবক-যুবতীর প্রেমের গল্প। বালক বয়সে আমি এমন একটি প্রেমের পিয়ন ছিলাম, তাই ছবিটি দেখার আগ্রহ ছিলো প্রবল।

অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়। বনানী কমপ্লেক্স, জলসা, উজালা, রঙ্গম সিনেমায় ‘অবুঝ মন’ মুক্তি পায়। ছবিটি মুক্তির ষোলো বছর পরও দর্শকদের ভিড়, নারী দর্শকদের জন্য সিনেমা দেখা দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। আমি উজালা য় দেখি। কিন্তু ছবির গল্পে ধর্ম নয়, বন্ধুত্ব ও ত্যাগ আমাকে মুগ্ধ করে।

১৯৮৫ সালে আমি যখন ভাইয়ের কাছে আবদার করলাম, আমি সিনেমা দেখতে চাই! তখন তিনি আমাকে বললো, “আগে বড় হও তারপর, আর ছবি দেখবি কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’, তাহলে কিছু শিখতে পারবি।”

আমি অবাক হয়েছিলাম… সিনেমায় আবার শেখার কী আছে! সিনেমা তো বিনোদন-লারেলাপ্পা নাচগান। কিন্তু ‘অবুঝ মন’ দেখে আমার ধারণা পাল্টে গেলো।

বিনোদনের মাঝেও শিক্ষা আছে!

‘অবুঝ মন’ থেকে মানবতা শেখা যায়, বন্ধুত্ব শেখা যায়, ত্যাগ শেখা যায়। পাওয়ার আশায় আমরা কতো কর্ম-অপকর্ম করে থাকি। কিন্তু ত্যাগের জন্য আমরা একটু অগ্রসর হই না। না পেয়ে আমরা অপরাধী হয়ে যাই, অথচ ত্যাগ-ই আসল ভালোবাসা তা ক’জন জানি!

কাহিনি সংক্ষেপ: সদ্য ডাক্তারি পাশ করা মাসুম (রাজ্জাক) নিজ গ্রামে ডাক্তারি করতে চায়। বন্ধু বিজয় (শওকত আকবর) ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নাই। বাবা মারা যাওয়ার পর বিজয়ের আর্থিক সহযোগিতায় মাসুম ডাক্তারি পাশ করে। বিজয় চায় মাসুম বিলেত গিয়ে আরও পড়ুক, কিন্তু মাসুমের ইচ্ছে নিজ গ্রামে গিয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার।

মাসুমের মহৎ উদ্দেশ্যের কাছে বিজয়ের ইচ্ছে পরাজিত হয়। তখন কিছু ওষুধপত্র দিয়ে বন্ধুকে বিদায় জানায়।

সহপাঠিনী রাবেয়া (সুজাতা) মাসুমকে খুব ভালোবাসে। এ ভালোবাসা ছিলো একতরফা। মাসুম কখনো সাড়া দেয়নি। তবুও রাবেয়া নীরবে ভালোবেসে যায়। এই বিশ্বাস যে, তার ভালোবাসা খাঁটি হলে একদিন মাসুম কাছে টেনে নিবে। আর মাসুম গ্রামে চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় রাবেয়া। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে; আর মাসুমের জন্য নীরবে তপস্যা করতে থাকে, একদিন মনের মানুষ তার হবে।

এদিকে ট্রেনে করে মাসুম গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলো। ট্রেনের কামরায় পরিচয় মাধবী ব্যানার্জির (শাবানা) সঙ্গে। পরিচয় হওয়ার পর জানতে পারে মাধবী তার এলাকারই জমিদারের মেয়ে।

মাসুম গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতে থাকে, এমনকি অনেককে ওষুধও দিয়ে থাকে।

মাধবী জমিদারের একমাত্র সন্তান। বাবা অসুস্থ হওয়ায় সে জমিদারের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। মাসুম জমিদার বাড়ি আসে খাওয়ার পানির সমস্যা নিয়ে। মাধবীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয়। দু’জনার মাঝে বেশ কথাবার্তা খুনসুটি হয়। মাসুমের পরোপকারী মনোভাব ও মানবতাবোধ মাধবীকে মুগ্ধ করে। আর মাধবীর সৌন্দর্য ও সুন্দর মন মাসুমকে মুগ্ধ করে। তারা একজন আরেকজনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে।

তাদের প্রেম প্রকাশ পায়, কিন্তু সামাজিক কারণে তাদের মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জমিদার। মাসুমকে মেয়ের জীবন থেকে সরে যেতে অনুরোধ করলে সে সরে যায়। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আহত হৃদয় নিয়ে শহরে ফিরে যায়।

জমিদার মাধবীকে বিজয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়। মাধবী বাসর রাতে জানায়, সে একজনকে ভালোবাসে। তাই সে বিজয়ের হতে পারবে না। নববধূ থেকে উপেক্ষিত হয়ে আহত হৃদয় নিয়ে বিজয় ফিরে যায়।

রাবেয়ার কাছে ফিরে আসে মাসুম। এরপর একদিন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখে মাধবী বিজয়ের স্ত্রী। কিছুদিন পরে বিজয়ও জানতে পারে গোপন থাকা বিষয়টি। এখন মাধবী চায় মাসুমের কাছে ফিরতে। বিজয় চায় মাধবীকে মাসুমের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু মাসুমের কাছে মাধবী বন্ধুর স্ত্রী। বিজয়ের অধিকার নষ্ট করার কোনো অধিকার তার নাই।

শুরু হয় দুই বন্ধুর ত্যাগের প্রতিযোগিতা!

কার দুর্ঘটনায় বিজয় অন্ধ হয়ে যায়। মাসুম সকল বাঁধা অতিক্রম করে বিজয়কে একটি চোখ দান করে। এরপর বিজয়ের হাতে মাধবীকে তুলে দিয়ে রাবেয়ার সঙ্গে মাসুম চলে যায়।

আজকাল যেখানে প্রেমের জন্য বন্ধু বন্ধুকে খুন করে। মা-বাবার সঙ্গে অশ্লীল দুর্ব্যবহার করে পুত্র-কন্যা। স্ত্রী স্বামীকে খুন করে, স্বামী স্ত্রীকে খুন করে। আসলে এগুলো কী প্রেম না সাময়িক যৌন তাড়না?

প্রেম তো হলো মাসুমের প্রেম। প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতো মাধবীকে। কিন্তু বন্ধু ও উপকারী বিজয়ের সঙ্গে মাধবীর বিয়ে হওয়াতে মাসুম বন্ধুত্ব বড় করে দেখেছে। অন্ধ বিজয়কে নিজের চোখ দিয়ে আলোকিত করেছে। তারপর মাধবীর সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে নিজে প্রস্থান করেছে। মাসুমের এই ত্যাগ বড় প্রেমের দৃষ্টান্ত। শারীরিক মিলনই প্রেমের গন্তব্য না, ত্যাগ অনেক বড় গন্তব্য।

চার চরিত্রের চারটি বিষয় লক্ষণীয়

রাবেয়া: যে মাসুম-কে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো। কিন্তু জোরজবরদস্তি করেনি। ক্ষণিকের বিরহে উতলা হয়নি। নিজের প্রেমের তপস্যা করে তাপসী হয়েছে। একসময় তার প্রেম সফল হয়। সে মাসুমকে নিজের করে পায়। নিয়তি মাসুমকে রাবেয়ার কাছে নিয়ে আসে।

নিয়তির কাছে আমরা সব সময় পরাজিত, কিন্তু এই পরাজয়ে যে জয়ের আনন্দ আছে, তা আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করতে পারি না।

রাবেয়া চরিত্রে ‘রূপবান’ কন্যা-সুজাতা অসাধারণ অভিনয় করেছে, অসাধারণ বললে কম বলা হবে।

বিজয়: বন্ধু মাসুমকে সাত বছর আর্থিক সাহায্য করেছে, অভিভাবকের বুকে রেখেছে। ধর্ম নয়, মানবতাকে বড় করে দেখেছে। বন্ধুত্বকে বড় করে দেখেছে। নিজ স্ত্রী বন্ধু মাসুমের প্রেমিকা ছিলো, জানতে পেরে স্ত্রীকে মাসুমের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে। এমন মহান বন্ধু কয়জনের ভাগ্য মিলে।

লোভ লালসার কাছে যাদের বন্ধুত্ব আত্মহত্যা করে, তারা কি বিজয়ের বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান আর ভালোবাসার কথা জানে?

বিজয় চরিত্রে শক্তিমান অভিনেতা শওকত আকবর সুপার হিরো যেন।

মাসুম: পরোপকারী ডাক্তার, যে অন্যের উপকার করতে নিজের ক্ষতি হাসতে হাসতে মেনে নেয়।

বিজয়ের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতায় মাসুম এমবিবিএস ডাক্তার। কিন্তু অর্থের পেছনে না ছুটে নিজ গ্রামে গরিবদের সেবায় নিয়োজিত হয়।

যখন জানতে পারে নিজের ভালোবাসার মাধবী বন্ধু ও উপকারী বিজয়ের স্ত্রী হয়েছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও (বিজয় চাইতো মাসুমই গ্রহণ করুক মাধবীকে, মাধবীও মাসুমের কাছে আসতে চাইতো) মাসুম মাধবীকে গ্রহণ করেনি। বন্ধুত্বের অমর্যাদা করেনি। বরং অন্ধ বিজয়কে নিজের একটি চোখ দিয়ে মাধবীকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়, এই ত্যাগে কষ্ট নেই সুখ আছে, আনন্দ আছে।

আজকালকার অস্থির প্রেমিকদের মাসুম চরিত্রটি দেখা উচিত, বোঝা উচিত।

এ চরিত্রে রাজ্জাক… কী আর বলবো, তিনি তো নায়করাজ, ওনার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে বলার যোগ্যতা আমার নাই। যিনি এই উপাধি দিয়েছে, তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

মাধবী: রূপসী ও জমিদার কন্যা হয়েও মাসুমের মানবতা, পরোপকারী মন, শিক্ষার কদর করেছেন। প্রেমে পড়েছেন, ভালোবেসেছেন।

ভালোবাসতে ধন সম্পদ নয়, চরিত্র প্রয়োজন। মাসুম ছিলো চরিত্রবান। মাসুমের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য ছিলো, মানবতাবোধ। তাই মাসুমের প্রতি অনুরক্ত হয়েছেন।

মাধবী চরিত্রে বিউটি কুইন শাবানা, অতুলনীয় অভিনয়।

আমার ভাই আমাকে বলেছিলেন, “আগে বড় হও তারপর, আর ছবি দেখবি কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’, তাহলে কিছু শিখতে পারবি।”

ধন্যবাদ জানাই আমার ভাইকে, আমাকে উপদেশ দেওয়ার জন্য। আমি ছবিটি দেখেছি এবং অনেক কিছু শিখেছি।

আজকালকার অস্থির প্রেমিক-প্রেমিকাদের উপদেশ দেব, তারা যেন ‘অবুঝ মন’ দেখে। বিশেষ করে তারা, যারা নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে না পেরে পরিবার ও সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন