Select Page

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে নারী ও নারীত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণে মানুষে ধারণকৃত সাপের বিচিত্ররূপ

01

সাপ প্রকৃতির একটি অংশ। প্রকৃতির অংশ হিসেবে সাপ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এসেছে বহু বিচিত্ররূপে। কখনও যৌনতার প্রতীক, কখনও সংহারদেবী, কখনও উদ্ধারকর্তা, কখনও ইচ্ছাপূরণের নিমিত্ত হিসেবে চলচ্চিত্রে সাপকে রুপায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাপ এসেছে কখনও চরিত্র হিসেবে এবং কখনও মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে। এই সকল কাহিনীর মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় ও কল্পনাশ্রিত বিষয় যেমন প্রাধান্য পায়, তেমনি পৌরাণিক, লোকজ ও অলৌকিক বিষয়ও স্থান পায়। সাপ নিয়ে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রে মূলত মনসা-মঙ্গলের নানা উপকরণ যুক্ত হয়ে থাকে। মনসা হচ্ছে সর্পদেবী লক্ষ্মীর অন্য এক রূপ ও নাম।

মনসা-মঙ্গলের কাহিনী মূলত, দুই নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কাহিনী। মনসা আর বেহুলা। যেখানে বাংলার নারীদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, তারা আজন্ম নিগৃহীত। যা নিখাদ নারীর অনিশ্চিয়তা থেকে নিশ্চিত গন্তব্যের কথা বলে। মনসার জন্ম কোন নারীর গর্ভে হয়নি। শিবের বীর্য পদ্ম পাতায় রাখলে, সেখান থেকে তা পদ্ম নাল বেয়ে পাতালে নেমে যায়; সেখান থেকেই মনসার জন্ম হয়। মনসার জন্ম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না। সেকারণে তার চাই সন্তানের দাবি প্রতিষ্ঠা। এই দাবিতে সে অনড়। একই সাথে চাই মানব সমাজে দেবীরূপে নিজের অধিষ্ঠান। মনসার চাওয়ার ভেতর দিয়েই নারীর চাওয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান। নারী অধিকার চায়। মনসার চাওয়াটা হল নারীর কর্তাসত্তাকে সমাজ চেতনায় স্পষ্ট করে তোলা। মনসার ভেতর বাইরে শিব ছাড়া অন্য কিছু নেই। এখানে শিব নারী হয়ে উঠল। শিব একই সাথে প্রকৃতি আবার পুরুষও। সেই অর্থে মনসার জন্মের ভেতর দিয়ে মানব জন্ম পুরোটাই উপলব্ধ হয়।

অপরদিকে, বেহুলা তার বাসর রাত থেকে শুরু করে স্বামীর সেবাসঙ্গী হয়। স্বামী আরামে ঘুমিয়ে পড়ে। বেহুলা পাহারা দেয়। মৃত স্বামীকে নিয়ে দেবপুরীতে যায়। স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে মুগ্ধ করে। নাচ এখানে প্রতীকি বিষয়। যেটা একটা প্রক্রিয়া বা তৎপরতা। সেটা মানবজীবনের মূর্ত প্রতীক। সংগ্রাম, ত্যাগ আর পরিশ্রমের। যার মধ্য দিয়ে সে নিজের জীবন সঙ্গী স্বামীকে উদ্ধার করে। তাকে আবার বাঁচিয়ে তোলে। এর ভেতর দিয়ে জীবনের ছাপ, কর্মের ছাপ পরিস্কার। নারীই সাজিয়ে দিচ্ছে জীবনকে। নারী তার নারীত্বের প্রকৃতি, দাবি ও কর্তাসত্তার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করে। মনসা-মঙ্গল তাই মন থেকে দূর হয়ে যায়নি।

আর তাইতো চলচ্চিত্র নির্মাতারাও সাপকে তাদের চলচ্চিত্রে এনেছেন প্রধানত এর গ্রহণযোগ্যতার দিকটি বিবেচনা করেই। তাছাড়া সাপকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের গানের কথা ও সুর এত লোকপ্রিয় হতো যে, সেসব গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। শুধু সাপ নয়, যারা সাপখেলা দেখায়, যারা সাপ ধরে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তারাও চলচ্চিত্রের বিষয় হয়ে এসেছে। এসব কাহিনীর সঙ্গে বাঙালি দর্শকসমাজ পূর্ব থেকে পরিচিত। ফলে এসব চলচ্চিত্র বাণিজ্য করেছে বহুল পরিমাণে।

এই ধারার চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে মর্ত্যের মানুষের প্রতি দেবকুলের অনৈতিক আচরণ; মানুষ কর্তৃক মানুষের ওপর অত্যাচার দমন করার জন্য সাপের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য ক্ষমতাবানরা যেমন সাপ ব্যবহার করেছে, তেমনি দুর্বলকে উদ্ধার করা বা বাঁচানোর জন্যও সাপ ব্যবহৃত হয়েছে। সাপ নিজেও কাউকে কেটেছে, আবার সেই সাপই বিষ চুষে নিয়েছে। মঙ্গলকাব্য থেকে উৎসারিত ‘বেহুলা’ ও ‘পদ্মাবতী’ এ দুটি চলচ্চিত্রে সাপ এসেছে পুরাণ থেকে। উভয় চলচ্চিত্রেই সাপ মর্ত্যের মানুষের ক্ষতি করতে যেমন তৎপর, লোকগাথাভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘আমীর সওদাগর’ ও ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র আবার লোকজীবনের প্রসঙ্গকে ভিত্তি করে নির্মিত। এখানে সাপ প্রকৃতির এমন একটি অংশ হিসেবে এসেছে, যে অংশ লৌকিক মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী। ‘পদ্মা গোখরা’য় সাপ এসেছে আধুনিক সাহিত্যকর্মের সূত্রে। এখানে সাপকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান হিসেবে দেখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নির্মিত হয়েছে শতবর্ষের প্রাচীন এবং গ্রামগঞ্জে বহুল অভিনীত একটি যাত্রাপালা থেকে। এখানে সাপ ব্যবহৃত হয়েছে বেদেজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।

নাগিনী নিমেষে নারীতে রূপান্তরিত হচ্ছে এই ফ্যান্টাসি আমাদের মনকে আমোদিত করে। নায়িকাদের কপালের টিপটাও হয়ে উঠে ক্ষুদ্র একটি সাপের রেখা।

বস্তুত বৃহত্তর লোকসমাজের মনের একটি বিশেষ রূপ পাওয়া যায় এসব চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত সাপের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে। প্রায় সব চলচ্চিত্রেই সাপ দুষ্টের দমনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাপবিষয়ক কল্পকাহিনীর এখনও বাংলা চলচ্চিত্রে কদর আছে। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের কাহিনীর মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ কতকগুলো নীতিকথা দর্শক সমাজের সামনে তুলে ধরে। সাপ নিজেও যে ক্ষমতা ও ভয়ের প্রতীক, তাও স্পষ্ট হয় সাপকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে। সাপ বাংলা চলচ্চিত্র মাধ্যমে বহুমাত্রিক একটি চরিত্র ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

উল্ল্যেখযোগ্য চলচ্চিত্র সমূহঃ 

‘মহুয়া’ (১৯৬৬), ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ (১৯৬৮), ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’ (১৯৬৯), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৬৯), ‘নাগিনীর প্রেম’ (১৯৬৯), ‘মলুয়া’ (১৯৬৯), ‘আমীর সওদাগর’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ (১৯৭০), ‘নাগ-নাগিনী’ (১৯৭৯), ‘শীষনাগ’ (১৯৭৯), ‘নাগিনী কন্যা’ (১৯৮২), ‘নাগ পূর্ণিমা’ (১৯৮৩), ‘নাগরানী’ (১৯৮৩), ‘পদ্মাবতী’ (১৯৮৪), ‘রসের বাইদানী’ (১৯৮৪), ‘চন্দনদ্বীপের রাজকন্যা’ (১৯৮৪), ‘জিপসি সর্দার’ (১৯৮৪), ‘সতী নাগকন্যা’ (১৯৮৫), ‘নাগমহল’ (১৯৮৬), ‘চাঁদ সওদাগর’ (১৯৮৬), ‘পদ্ম গোখরা’ (১৯৮৭), ‘নাগিনা’ (১৯৮৭), ‘মহুয়া সুন্দরী’ (১৯৮৭), ‘নাগজ্যোতি’ (১৯৮৮), ‘সর্পরানী’ (১৯৮৮), ‘বেহুলা লখিন্দর’ (১৯৮৮), ‘জলপরী’ (১৯৮৯), ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ (১৯৮৯), ‘সাপুড়ে মেয়ে’ (১৯৮৯), ‘সাগরকন্যা’ (১৯৮৯), ‘নাচে নাগিন’ (১৯৯১), ‘রাজার মেয়ে বেদেনী’ (১৯৯১), ‘শীশমহল’ (১৯৯১), ‘বনবাসে বেদের মেয়ে জোসনা’ (১৯৯১), ‘রূপসী নাগিন’ (১৯৯২), ‘নাগিনী সাপিনী’ (১৯৯২) প্রভৃতি।

জনপ্রিয় কিছু গানের ভিডিও লিংকঃ

তুমি ফুল মনেরও সেরা ফুল – দুই নাগিন

চুপি চুপি মন কেড়ে নিয়েছে – দুই নাগিন

গোখরা রে গোখরা ছাড় তোর নখরা – নাগিন

কাল নাগিনী – পদ্মাবতী

আমি দিওয়ানা হইলাম – দুই নাগিন

নাগ নাগিনী লইয়া সাপ খেলা দেখাই – বেদেনীর প্রেম

কি সাপ দংশিল – বেহুলা

খা খা বক্ষ্মীলারে কাঁচা ধইরা খা – অরুণ বরুণ কিরণমালা

তুমি যেখানে আমি সেখানে – নাগ পূর্ণিমা

দোহাই লাগে সুজন – পদ্মাবতী

ঘোমটা খুলে দিলাম – পদ্মাবতী

নয়ন জুড়ে – পদ্মাবতী

তুমি আমার বারো মাসের গান – রসের বাইদানী

আমি রসের বাইদানী ভাই – রসের বাইদানী

আমার ষোল বছর হইলো – নাগ জ্যোতি

আমার কোন দুঃখ নাই – নাগ জ্যোতি

একটি গন্ধমের লাগিয়া – নাগ জ্যোতি

জনম ধরি যতন করি রাখিও মোরে পরানে – নাগ জ্যোতি

বেদের মেয়ে জোছনা – বেদের মেয়ে জোছনা

আমি নাগিনী আমি সাপিনী – নাগিনী সাপিনী

নাগ নাগিনী দোহাই লাগে – নাচ নাগিনী নাচ

বন্ধু তুমি ছাড়া কেউ নাই – বাঁশি ওয়ালা

তুমি যে আমার বন্ধু – রাঙা বাইদানী

ও বেহুলা সুন্দরী – বেহুলা

মনটা যদি খোলা যেতো সিন্দুকেরই মতো – চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা

তথ্যসূত্রঃ গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হক, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প: সঙ্কটে জনসংস্কৃতি, (ঢাকা: শ্রাবণ, ২০০৮)।


মন্তব্য করুন