বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল ‘ক্যাপ্টেন এহতেশাম’ এর গল্প
উপরে একটি পরিবারের সদস্যদের তোলা একটি দুর্লভ ছবি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। ছবিটি আজ থেকে প্রায় ৬ দশক আগে তোলা। যাদের পরিচয় হলো বা থেকে (বসাবস্থায়) চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক এহতেশাম, মাঝের শিশুটি হলো ফয়সাল (এহতেশাম সাহেবের নাতি), নাজমুন্নেসা বেগম (এহতেশামের স্ত্রী), চিত্রনায়ক নাদিম (এহতেশামের জামাতা) ও ফারজানা (এহতেশামের মেয়ে / চিত্রনায়ক নাদিমের স্ত্রী)। নামগুলো শুনে আপনাদের কাছে হয়তো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে তাই না? পরিচিত মনে হওয়ারই কথা। কারণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের খবরাখবর যারা রাখতেন তাঁদের কাছে এহতেশাম, নাদিম, ফয়সাল এই তিনটি নাম খুবই পরিচিত। আর নিচের ছবিটি হলো বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল প্রয়াত প্রযোজক ও পরিচালক এহতেশাম সাহেবের পারিবারিক ছবি। বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল এহতেশাম নিয়ে আজ দুটো কথা আপনাদের জানানোর শুরুতেই পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
১৯৫৬ সালে প্রয়াত আব্দুল জব্বার খানের ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) এর চলচ্চিত্র শিল্পের যে শুরুটা হয়েছিল আজ সেটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নামে পরিচিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সেইদিনের শুরুর পর থেকে যারা এই শিল্পটাকে পরিপূর্ণভাবে একটা ‘ইন্ডাস্ট্রি’তে রুপ দেয়ার লক্ষ্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তাঁদের মধ্য এহতেশাম নামটি আছে সবার শীর্ষে।
এহতেশাম যার পুরো নাম হলো আবু নূর এহতেশামুর রহমান। ১৯২৭ সালের ১২ই অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোঃ ইউসুফ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক এবং মা মোছাম্মত কানিজ ফাতেমা ছিলেন সাধারন গৃহিণী। ১৯৫০এর দশকে চলচ্চিত্র প্রদর্শক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে নিজেই ‘লিও ফিল্মস’ নামে নিজেই একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন যে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ছবি ছিল ‘এদেশ তোমার আমার’। ‘এদেশ তোমার আমার’ দিয়েই এহেতশাম প্রযোজনা ও পরিচালনায় আসেন এবং নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবীর পর্দা অভিষেক, সঙ্গে ছিলেন ও আনিস (খান আতাউর রহমান), এটি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র পর তার প্রথম বাংলা ছবি। এইভাবেই প্রথম থেকেই পূর্ববাংলার চলচ্চিত্রের একজন কাণ্ডারি হিসেবেই এহতেশামের পথচলা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর এহতেশাম এর ‘’এ দেশ তোমার আমার ‘’ ছবিটি শুভমুক্তি লাভ করে। এই ছবির মাধ্যমে শুধু একজন কিংবদন্তী খান আতাউর রহমান ও সুমিতা দেবীকে বাংলা চলচ্চিত্র পায়নি সাথে পেয়েছিল জহির রায়হান ও কামাল আহমেদ এর মতো চিরস্মরণীয় দুই চিত্র পরিচালক ও অসাধারন মেধাবিদের। জহির রায়হান ও কামাল আহমেদ ছিলেন এহতেশামের সহকারী হিসেবে। যে জহির রায়হান মূলত এ জে কারদারের (জাগো হুয়া সাভেরা) সহকারী পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও খুব দ্রুত গুরু পূর্ণ পরিচালকের নাম লিখান যার পরবর্তী ইতিহাসটা সবারই জানা। ‘এদেশ তোমার আমার ‘ ছবিটি মুক্তির পরপরেই দর্শকদের কাছে দারুন সাড়া পরে আর এই ছবির মাধ্যমেই বাংলা চলচ্চিত্র রোমান্টিক ধারার গল্পে প্রবেশ করে। একটি ছবি দিয়েই এহতেশাম বাংলা চলচ্চিত্রকে কতগুলো পরিবর্তন এনে দিলেন নিজেরাই তা হিসাব করে দেখুন। কিন্তু তারপরেও এহতেশামের মন ভরেনি তাই তিনি রোমান্টিক গল্পের মধ্যে জীবনমুখী চলচ্চিত্রের ধারা চালু করার জন্য পরিচালক সুভাষ দত্ত , অভিনেতা রহমান ও অভিনেত্রী শবনম’কে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন আর একে একে তৈরি করতে থাকেন ‘রাজধানীর বুকে’, ‘চকোরী’, ‘নতুন সুর’, ‘চাঁদ ও চাঁদনী’ ,’ পিচ ঢালা পথ ‘, ‘সাগর’ , ‘চান্দা’, ‘শক্তি’ র মতো অসাধারন সব শৈল্পিক চলচ্চিত্র। এহতেশাম উপমহাদেশের তৎকালীন সময়ের চলচ্চিত্রের রীতিনীতি আমুল পরিবর্তন করেন বা সেই রীতিনীতিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলেন। যে রহমান ছিলেন এহতেশামের প্রথম ছবিতে খলনায়ক সেই রহমান’কে তিনিই পরের ছবিতে নায়ক চরিত্রে দর্শকদের সামনে হাজির করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন । এরপর রহমান ও শবনম হয়ে যান পচিম বাংলার চিরসবুজ জুটি উত্তম সুচিত্রা’র মতো প্রিয় একটি রোমান্টিক জুটি।
পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র তৈরির জন্য নিজের ছাত্র স্নেহের জহির রায়হান’কে বেছে নিয়েছিলেন। জহির রায়হান’কে সব ধরনের সহযোগিতা করে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন ‘সঙ্গম’ নামের উর্দু ছবিটি যা শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয় পশ্চিম পাকিস্তানেও মুক্তি পেয়েছিল। অর্থাৎ এহতেশাম পূর্ববাংলার চলচ্চিত্রকে নিজেদের সীমানার বাহিরে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন যার ফলশ্রুতিতে এই দেশের মেধাবী পরিচালকদের ছবি পশ্চিম পাকিস্তানের দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেন যা পশ্চিম পাকিস্তানে খুব প্রশংসিত হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিচালক’রা যে শুধু বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র ছাড়াও যে উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারে সেটা তিনি দেখিয়ে দিলেন। যার ফলে দুই পাকিস্তানেই কাজ করার সুযোগ লাভ করে আমাদের পরিচালক’রা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলায় প্রথম উর্দু ছবি ‘চান্দা’ ২য় উর্দু রঙিন ছবি ‘সাগর’ এর পরিচালকও ছিলেন এই এহতেশাম। এহতেশাম শুধু যে একজন পরিচালক প্রযোজক ছিলেন তা নয় তিনি হাতে ধরে তৎকালীন সময়ে নতুন চিত্রগ্রাহক, ল্যাব এর প্রিন্ট মাস্টার, লাইটম্যান, কালার মিক্সিং, সম্পাদনা’র মতো কাগিগরি অনেক কাজ নিজ হাতে শিখিয়েছিলেন। এহতেশাম ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ‘কে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের উৎসাহিত করেছিলেন এবং তার উদ্যোগে বেশ কিছু যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ হয়। ‘চান্দা’ ছবির মাধ্যমে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কিংবদন্তী অভিনেতা নাদিম’কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যিনি পরবর্তী সময়ে উর্দু ছবির একচ্ছত্র দাপট অর্জন করেন। পরবর্তীতে নাদিমের সাথেই এহতেশামের একমাত্র মেয়ে ফারজানা’র বিয়ে দেন যাদের সন্তান ফয়সাল পরবর্তীতে পাকিস্তানের জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়।
এহেতশামের হাত ধরে শুধু একজন রহমান, শবনম, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান আসেনি এসেছিল পরিচালক কামাল আহমেদ, আজিজুর রহমান, আই আর খান, শিবলি সাদিক, ইবনে মিজান, নারায়ন ঘোষ মিতা, আমজাদ হোসেন এর মতো কিংব্দন্তি তুল্য চিত্র পরিচালকগণ, এসেছিলেন রবিন ঘোষ এর মতো সঙ্গীত পরিচালক, আরও এসেছিলেন নাদিম, শাবানা, নাঈম, শাবনাজ, শাবনুর এর মতো সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীরা। এহতেশাম এই বাংলা চলচ্চিত্রকে একটি শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন যার ফলশ্রুতিতে এই দেশের চলচ্চিত্র শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করেন। তিনি চেয়েছিলেন শিল্প ও বাণিজ্য দুটোতেই যেন বাংলা চলচ্চিত্র এগিয়ে যায় । বোম্বের জনপ্রিয় শিল্পীদেরও তিনি যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অভিনয়ের জন্য অনুপ্রানিত করতেন ফলে রাজেশ খান্না, শর্মিলি ঠাকুর, প্রেম চোপড়ার মতো অভিনেতা অভিনেত্রীরা বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করেন। যতবার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংকটের মুখে পড়েছিল ততবারই এই এহতেশাম তাঁর নিত্য নতুন চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এগিয়ে যাওয়ার চাকা সচল রেখেছিলেন। তাঁকে শ্রদ্ধা ভরে অনেকে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধি দিয়েছিলেন আর ৯০’র অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাঁকে ‘দাদু’ বলে সম্বোধন করতেন । অর্থাৎ তিনি হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ক্যাপ্টেন এহতেশাম’ যা অন্য কেউ আর কোনদিন হতে পারবে না।
২০০২ সালে এই মহান কীর্তিমান প্রযোজক ,পরিচালকের মৃত্যু হয়। আজ চলচ্চিত্র নিয়ে অনেকে অনেক কথাই বলেন ,অনেকে অনেক ধারার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন কিন্তু আজো এই চলচ্চিত্র শিল্প একজন এহতেশাম কে পায়নি। আজকের তরুন প্রজন্মের কেউই এই কীর্তিমান মানুষটি সম্পর্কে জানে না। সবাই চলচ্চিত্র নিয়ে বড় বড় কথা বলে অথচ কেউ একজন এহতেশামের কথা বলে না। আমরা হচ্ছি সেই অকৃতজ্ঞ জাতি যারা একজন ক্যাপ্টেন এহতেশাম’কে ভুলে গেছি। এমন অকৃতজ্ঞ জাতির চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংস হবে নাতো কারটা হবে আপনারাই বলুন?
লেখকঃ ফজলে এলাহী পাপ্পু
তথ্য ও ছবি সংগ্রহ, সহযোগিতায়, কৃতজ্ঞতায়ঃ Projonmo Sanu
1st off all, You use my photo collection without any reference.
2nd there are lot off mistake
Mistakes are – 1) চিত্র নায়ক ফয়সাল (এহতেশাম সাহেবের নাতি),
2) ১৯৫০ সালে তৎকালীন নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন অভিনেতা ও প্রদর্শক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।
3) ‘এদেশ তোমার’ দিয়েই এহেতশাম চলচ্চিত্রের জন্য নায়িকা হিসেবে সুমিতা দেবী ও আনিস (খান আতাউর রহমান) নামের একজোড়া তরুন তরুণীকে পরিচয় করিয়ে দেন।
4) জহির রায়হান এহতেশামের সহকারী পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু
5) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র তৈরির জন্য নিজের ছাত্র স্নেহের জহির রায়হান’কে বেছে নিয়েছিলেন। জহির রায়হান’কে সব ধরনের সহযোগিতা করে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন ‘সঙ্গম’ নামের উর্দু ছবিটি
6) এহতেশাম শুধু যে একজন পরিচালক প্রযোজক ছিলেন তা নয় তিনি হাতে ধরে তৎকালীন সময়ে নতুন চিত্রগ্রাহক, ল্যাব এর প্রিন্ট মাস্টার, লাইটম্যান, কালার মিক্সিং, সম্পাদনা’র মতো কাগিগরি অনেক কাজ নিজ হাতে শিখিয়েছিলেন।
7) তার উদ্যোগের ফলে এই দেশে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ শুরু হয়।
8) তাঁর নতুন চিন্তার ফলে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশই প্রথম ফোক ফ্যান্টাসি ছবি নির্মাণ করে।
9) তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঋত্বিক ঘটক, শেখ নিয়ামত আলী’র মতো বিকল্পধারার চলচ্চিত্র পরিচালক’রা বাংলা চলচ্চিত্রে বিকল্পধারার ছবি নির্মাণ করেছিলেন।
10) তাঁর সাহসি ও সঠিক নেতৃত্বের কারণে তাঁকে চলচ্চিত্রের শিল্পী কলাকুশলী সবাই শ্রদ্ধা ভরে ‘ক্যাপ্টেন’ উপাধি দিয়েছিলেন
Pls make creation off all that
You can call me 01711249462