Select Page

‘ভালো’ সিনেমা যখন প্রোপাগাণ্ডা মেশিন

‘ভালো’ সিনেমা যখন প্রোপাগাণ্ডা মেশিন

২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল ‘দহন’, প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে এসেছে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার নাম। পরিচালনায় তরুণ মুখ রায়হান রাফী। মূল চরিত্রে আরেক তরুণ মুখ সিয়াম, সঙ্গে সবেমাত্র শিশুশিল্পী থেকে নায়িকা হওয়া পুজা চেরী। সেইসাথে ছিল জাকিয়া বারী মম, ফজলুর রহমান বাবুর মতো তারকা শিল্পীরা।

‌‘পোড়ামন ২’ রিলিজের ৫ মাসের মাথায় ‘দহন’। রোম্যান্স থেকে সরাসরি পলিটিক্যাল ফরমেটে নিজেদের খুব সুন্দরভাবে পরিবর্তন করে ফেলায়, রাফী-সিয়াম-পুজারা পেলেন দর্শক-সমালোচকদের ভুয়সী প্রশংসা। সিনেমাটির বিষয়বস্তু, গত দশকে নিয়মিত ঘটে যাওয়া যানবাহন অগ্নিকাণ্ডকে ঘিরে। বড়পর্দায় সাধারণ মানুষ পুড়ে ছাই হচ্ছে, এমন দৃশ্য দর্শককে ব্যাপকভাবে আবেগতাড়িত করেছে। রাজনৈতিক নোংরা খেলা কতটা ভয়াবহ, তা সাধারণ মানুষের কিছুটা হলেও বোধগম্য হয়েছে।

এই সিনেমায় কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে বড় করা হয়নি, কিংবা কোনো নির্দিষ্ট দলকে খাটোও করা হয়নি। এদিক থেকে দেখলে মনে হয়, রাফী ও তার টিম সিনেমা হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক পণ্য বানাতে চাননি! কিন্তু এরপরও ‌‘দহন’ শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক পণ্য বা প্রোপাগাণ্ডার হাতিয়ার হিসেবেই আমাদের মাঝে আসন গেড়েছে। কীভাবে? বলছি…

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর। ‘দহন’ তখনো বেশ কয়েকটি হলে চলছে। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগেরদিন, অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ডজনখানেক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে একযোগে চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ার করা হলো। কোনো চলচ্চিত্রের টিভি প্রিমিয়ার খুবই সাধারণ বিষয়। এটা হরহামেশাই হয়। কিন্তু একদম মাপা টাইম ধরে নির্বাচনের আগের দিন প্রিমিয়ার করা, এতোগুলো চ্যানেলে, তাও আবার এমন এক সিনেমা যা এখনো হল থেকে পুরোপুরি নামেনি… এতো ফ্যাক্ট একইসাথে কখনোই কাকতালীয় হতে পারে না।

‘দহন’ তৎকালীন সরকার তাদের নির্বাচনের স্বার্থে প্রমোট করেছে। মেটাফোর হিসেবে দেখাতে চেয়েছে ২০১৪ সালে সংঘটিত একাধিক বাসে অগ্নিসংযোগকে। অথচ এরকম পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড সরকারি কিংবা বিরোধী, উভয় দলই ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় একাধিকবার করেছে। সবকিছু বিবেচনায়, ‘দহন’ একটা সময় পর্যন্ত ফ্রেশ ফিল্ম ছিল, যতদিন সিনেমাহলে চলেছে। রাজনৈতিক পণ্য না হয়েও রাজনীতির বাজারে বিক্রি করা হয়েছিল এরকম ভালো নির্মাণের একটি চলচ্চিত্রকে।

হঠাৎ করে ‘দহন’-এর কথা মনে পড়ার কারণ অবশ্য ভিন্ন। সম্প্রতি পাশের দেশ ভারতে একটা লো বাজেটের হিন্দি সিনেমা, ৩৫০ কোটি রূপি বাজেটের প্যান ইন্ডিয়ান ফিল্মের ঘাড়ে ওঠে টক্কর দিচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, এই সিনেমার হাইপ ও বিজনেস তত ভালো হচ্ছে। দর্শক অশ্রুসিক্ত হচ্ছে, সমালোচকরা প্রশংসা করছে। সিনেমাটির নাম ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। সত্য ঘটনা অবলম্বনে চিত্রায়িত এই সিনেমাটি মাত্র ১৩ কোটি রূপি খরচ করে নির্মিত। কিন্তু প্রতিদিন যেরকম বক্স অফিস ফিগার আসছে, ধারণা করা হচ্ছে এই সিনেমা ১৫০-২০০ কোটি পর্যন্ত দৌঁড়াবে অনায়াসে।

এখানেও সত্য ঘটনাকে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখানো হয়নি। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী বলছেন, যা ঘটেছিল, তাই দেখানো হয়েছে। শুধু একজনের চোখ দিয়ে নয়, একাধিক মানুষের চোখ দিয়ে পুরো ঘটনাটির এপিঠ-ওপিঠ দেখানো হচ্ছে।

কিন্তু এই সিনেমাও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পণ্য হওয়া থেকে রেহাই পায়নি। অবশ্য অনেকেই বলছেন, এ ‘ভালো’ ছবিটি নির্মাণের উদ্দেশ্য এটিই। আর পণ্য হবে না-ই বা কেন? কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বর্তমানে ওই দেশের ক্ষমতায়। সিনেমায় দেখানো হয়েছে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মারছে মুসলিম জিহাদীরা। এমন লোভনীয় সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?

সরকারি দল নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব রাজ্যে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’কে ট্যাক্স ফ্রি ঘোষণা করা হয়েছে। পার্লামেন্ট সদস্যরা যেনো সিনেমাটা হলে গিয়ে দেখতে পারে, এজন্যে সরকার তাদেরকে অফিসিয়ালি সাধারণ ছুটি দিচ্ছে। হাতেগোনা কয়েকজন সমালোচক এই সিনেমার সমালোচনা করেছিল। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও নির্মাতা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছবিটি নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। আবেগতাড়িত দর্শক তাদের তো গালাগাল দিচ্ছেই, এখন আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের এক হাত দিচ্ছেন। নিজেই সিনেমার প্রমোশন করছেন বুঝুন কী ভয়াবহ অবস্থা!

অথচ যেই অঞ্চল নিয়ে এই সিনেমা, সেই কাশ্মীরের সিনেমাহলগুলোতে এই সিনেমাকে ট্যাক্স ফ্রি ঘোষণা করার খবর শোনা যায়নি। সিনেমার মূল বিষয়বস্তু হলো গণহত্যা। গণহত্যা অন্যায়, সেটা যারাই করুক। কিন্তু এখন গণমানুষের কাছে এই সিনেমার মূল বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু পণ্ডিতদের গণহত্যা’। ‘দহন’ এ মূল বিষয়বস্তু ছিল পেট্রোলবোমা সন্ত্রাস। কিন্তু পরে গণমানুষের কাছে সিনেমার বিষয়বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে ‘তৎকালীন বিরোধীদলের পেট্রোলবোমা সন্ত্রাস’। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম… পরিচালক ও তার টিম বক্তব্য রাখতে চেয়েছেন একরকম, কিন্তু গণমানুষের কাছে বক্তব্য পৌছে গেছে আরেকরকম।

মোগল শাসনামল থেকে এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম রেষারেষি চলমান। ভারতে এই রেষারেষির পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশেও আছে, তবে সেটা হয় ভারতের দেখাদেখি। মানে ভারতে কোনো মুসলিম ঘরে আগুন লাগলে বাংলাদেশের হিন্দুঘরে আগুন লাগে, অনেকটা এরকম। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের সরকার পক্ষের উচিত জনগণের নৈতিক শিক্ষার উন্নতি নিয়ে কাজ করা। এরকম ভালো সিনেমাকে প্রোপাগাণ্ডা বানানো কোনো ভালো কাজ নয়…


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

মন্তব্য করুন