Select Page

যখন ‘চন্দ্রাবতী কথা’য় আসি

যখন ‘চন্দ্রাবতী কথা’য় আসি

চন্দ্রাবতী কথা’ নিয়ে যখন লিখছি সিনেমাটা তখন তার জার্নির একটা বড় সময় পার করে ফেলেছে, পেতে শুরু করেছে পুরস্কারও। ২০১৪-২০১৫ সালের বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় অনুদানপ্রাপ্ত এই ছবি যখন মুক্তি পায় ২০২১ সালে, আমার লেখাটাও তখন কিছুটা দেরিতে লিখতেই পারি।

জয়ানন্দ যখন বলছেন, ‘অমৃত ভাইবা গরল খাইছি’ তখন স্ক্রিনপ্লে’তে একটা অনুশোচনাবোধ তৈরি হয়ে যায়। সেই অনুশোচনাবোধ একটা সম্পর্কের বোঝাপড়া তৈরি করতে গিয়েও শেষে এসে আটকে যায় এক নারীর কবিতা লেখার অদম্য বাসনা-ব্রততে এসে। সেই নারীর নাম চন্দ্রাবতী। সিনেমার নাম ‘চন্দ্রাবতী কথা’।

মধ্যযুগের সময়ে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের নানা উপাখ্যান এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর সাহিত্যচর্চা, প্রেম, সাধনা-কন্ট্রিবিউশনের গল্প (মূলত ময়মনসিংহ গীতিকার কবি নয়ানচাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী পালা’ অবলম্বনে) নিয়ে এই গল্প দাঁড়িয়েছে।

ষোড়শ শতকের পূর্ব বাংলার হাওড় অঞ্চল। এ অঞ্চলের কবি দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্যের কন্যা চন্দ্রাবতী’র প্রেম হয় অপর কবি জয়ানন্দের সাথে। চন্দ্রাবতীকে সাত পাকে বাধার প্রতিজ্ঞা করে জয়ানন্দ। কিন্তু সেই বিয়ে শেষমেশ হয়নি। বেদনাহত চন্দ্রাবতী তাঁর বাবার নির্মিত শিব মন্দিরে নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং মাতৃভাষায় ‘রামায়ণ’ পালা রচনায় ব্রতী হন। নিজে উপেক্ষিত হয়েছেন। মহাকাব্য রামায়ণে উপেক্ষিত হয় সীতা। তাই তাঁর রচিত রামায়ণ পালায় উপেক্ষিত সীতা হয়ে ওঠেন মূল চরিত্র। এদিকে অনুশোচনায় পুড়ে ফিরে আসে জয়ানন্দ। ধ্যানমগ্ন চন্দ্রার মনে ঠাঁই হয় না ফিরে আসা জয়ানন্দের। জয়ানন্দ চন্দ্রার ধ্যান ভাঙতে না পেরে নিজের জীবন অবসান ঘটান। ধ্যান হতে উঠে চন্দ্রাবতী, জয়ানন্দের আত্মাহুতির ব্যাপারে জ্ঞাত এবং মর্মাহত হন। মর্মাহত চন্দ্রাবতী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন রামায়ণ পাঠ আর পালা লিখনে।

আপনি যদি কেবল এইটুকুতেই এই সিনেমাকে মূল্যায়ন করে ফেলেন তবে তা নিছক ভূলই নয়, সিনেমার প্রতি অন্যায়ও হবে। এই সিনেমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো ভাষা। টাইম ট্রাভেল। ষোড়শ শতককে ধরার চেষ্টা করা। সিনেমার শুরুতেই দেখানো হয় চন্দ্রাবতীকে নিয়ে একজনের মূল্যায়ন, যেখানে চন্দ্রাবতীকে বলা হচ্ছিল আড়ালে থেকে যাওয়া মূল্যবান কিছু একজন হিসেবে। চন্দ্রাবতীর বাংলা সাহিত্যে অবদানকে আমরা ধরতে পারিনি, সেই সময়কার একটা পশ্চাৎপদ সমাজে একজন নারী রামায়ণের রচনা করছেন নিজ ভাষায় তা তো আর চারটেখানি কথা নয়। পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী সেই সময়কে ধরার, ভিজ্যুয়ালাইজ করার একটা মতো চিন্তা করেছেন তাইই সাধুবাদ প্রাপ্য এমন নয়।

এই সিনেমার গল্পকে দাঁড় করাতে গিয়ে তার দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা, সেই সময়ের পুঁথি-চিত্র, মানুষ, ন্যারাটিভ নিয়ে যে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা তা বুঝতে হলেও আগে আপনাকে এই সিনেমা দেখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান সময়ে হাওড় অঞ্চল নিয়ে যে ফ্যান্টাসি তা ভ্রমণ নির্ভর, নিসর্গভিত্তিক; আর এন রাশেদ চৌধুরীর হাওড় অঞ্চলের স্টোরিটেলিং সেই সময়ে চন্দ্রাবতীর চোখে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে রামায়ন নিয়ে। আপনি যখন স্ক্রিনে এই সিনেমা দেখবেন তখন অবশ্যই মাথায় চিন্তা আসবে ভাটি অঞ্চলের জীবন কীভাবে এই অবধি এলো সে ব্যাপারে।

১০৫ মিনিটের এই স্টোরিটেলিংয়ে পরিচালক ৪টা ভিন্ন ভিন্ন গল্পকে একসাথে ফাংশন হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। আদতে সিনেমার নাম ‘চন্দ্রাবতী কথা’ হলেও চন্দ্রাবতী এখানে ৪টা গল্পের একটা গল্পে স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয়েছে। চারটি গল্পই নিজস্বতা থাকুক বা না থাকুক স্বাধীন ছিল বেশ। এদেরকে চন্দ্রাবতীর অংশ হিসেবে দেখানোর যে অভিপ্রায় খুব সম্ভবত সেটা ব্যর্থ হয়েছে।

চন্দ্রাবতীর যে ডেডিকেশন নিয়ে সাহিত্যসাধনা তাকে ফুটানোর জন্য এন রাশেদ চৌধুরী সে সময়ের ন্যারাটিভ বোঝাতে কিছু ফিকশনাল ক্যারেক্টার আনতে চেয়েছেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে চন্দ্রাবতী আর মূল উপজীব্য থাকতে পারেনি। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। এক. হয় পরিচালক এই উপাখ্যান সবার জানা ভেবে ছোটখাটো অনেক গল্পকে এড়িয়ে গিয়েছেন, দুই. (অথবা) তিনি বিশেষ করে চেয়েছেন এই ডকুমেন্টেশন হিসেবে এই কাজকে তুলে আনতে। যদিও এই দুটো ব্যাপারই আবার নাকচ করে দেওয়া যায় সোনাইয়ের গল্প বলার ধরন নিয়ে। বয়াতি যখন সোনাইয়ের গল্প বলে যাচ্ছিলেন স্ক্রিনপ্লে’তে তা খুব কম ডিউরেশনেই বেশ লম্বা সময়ের গল্পকে ধারণ করছিল। রাশেদ চৌধুরী তাহলে করতে চেয়েছেন কী? সে প্রশ্নটা নাহয় থেকেই যাক।

আরও পড়ুন: ‘চন্দ্রাবতী কথা’র জন্য বাহবা

মিউজিকে সুরকার ছিলেন কলকাতার সাত্যকি ব্যানার্জি। বেশ ভালো সিলেকশন বলা যায়। অ্যানশিয়েন্ট মিউজিককে ধরতে গেলে যে বাদ্যযন্ত্র এবং সংগীত আবহ নির্মাণ করা লাগে সাত্যকির তাতে বেশ ভালো দখলই আছে। ডাফ, সারিন্দা, উদ, ডাম্বুরা, দোতারা, রবাব এমনসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে এই সিনেমায়। নেপথ্য কণ্ঠও দেন তিনি। বেশ দারুণ ছিল সিনেমার পর্দা উঠতেই বয়াতির দলের যে জারি গান তার কম্পোজিশন। পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া ধরনের অনুভূতি দিচ্ছিল। বাকি গানগুলোও দারুণ। গান পরিচালনায় ছিলেন কমল খালিদ।

সিনেমার লোকেশানের জন্য যে সকল জায়গা বেছে নেওয়া হয়, বিশেষ করে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের অঞ্চল তা বেশ উল্লেখযোগ্য একটা ভূমিকা রাখে এই গল্পকে এস্টাবলিশ করতে। আউটডোর লোকেশানগুলো ছিল এমন যাতে আপনি সেই সময়ের লেস নয়েজকে ধরতে পারেন। বুঝতে পারেন মানুষ কম থাকার ব্যাপারটা। ইনডোর সেটগুলোয় ফ্রেমটা ধরা হচ্ছিল দেয়াল ঘেঁষে। সচরাচর তো আমরা সাবজেক্টকে মাঝখানে রাখতে চাই। সে জায়গায় এটা বেশ দারুণ ছিল। বিশেষ করে চন্দ্রাবতী পূজা করছে, ঠিক তখনই বৃষ্টির সিনের ফ্রেমটা এমন একটা অ্যাঙ্গেল থেকে ধরা হয় তা দেখতে মনোরম লাগছিল। কিংবা অশোক আর চন্দ্রাবতীর মাঝখানে দেয়ালের শট। ট্রলি শট নেওয়া হচ্ছিল। বেশ অনেকগুলো প্যান শট। কিন্তু তাতে স্ক্রিনপ্লে স্লো হয়ে যাচ্ছিল। আর ন্যারেট করা গল্প বলে তাতে আরও বিরক্তি আসছিল। তবুও ইউনিক সিনেমাটোগ্রাফির ছাপ নিয়ে আসায় কাশেফ শাহবাজী হাততালি পাওয়ার দাবি রাখেন। কিন্তু বারবার ফ্ল্যাশব্যাক/সিন চেইঞ্জ/অবজেক্ট আর সাবজেক্টের ভেতরের কনভারসেশনে তারতম্য দর্শককে বারবার ফোকাস সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। দর্শক একটা ডিলেমায় পড়বেন আসলে গল্পটা কাকে নিয়ে বলা হচ্ছে।

এডিটকে এক কথায় যদি বলতে হয় তবে ‘মোটামুটি’ বলাই শ্রেয়। এই সিনেমার কালার গ্রেডিংয়ে খুব বেশি তারতম্য দেখা গেছে। গোটা সিনেমায় কেমন যেন আকাশ নেই। আপনার মন হবে সারাবছরই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে। মাঝে মাঝ সবুজ গাছপালাকেও মনে হবে হলুদাভ রঙয়ে ছেয়ে গেছে৷ হ্যাঁ, এটা বোঝা যায় চারটা গল্পকে চার ধাঁচের কালারে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চারটে গল্পই যখন একসাথে মিশে যাচ্ছিল তখন কালার কী করবেন? আবার সকালের নরম রোদে চন্দ্রাবতী যখন সাধনা করছেন তার একটু পরেই জয়ানন্দকে দেখা গেল কিছুটা ব্ল্যাকিশ ধাঁচে। অথচ একই লোকেশন। এমন তারতম্য দেখা যাবে অনেকগুলো জায়গাতেই। কিন্তু বেশকিছু আউটডোর শট আছে, বৃষ্টির শট আছে, এবং সাউন্ডের মিক্সাপের সঙ্গে লাইটিংয়ের ভারসাম্য আছে যার কারণে ডিমইন আর ডিমআউটগুলো দেখতে বিশেষ সমস্যা হচ্ছিল না। আর অনন্য একটা কাজ ছিল একেকটা পিরিয়ডিক্যাল ব্যাপার বোঝাতে পুঁথি-পদের পোস্টার নিয়ে ফেইডইন করা।

স্ক্রিনপ্লেতে বেশ কিছু জায়গায় খুঁত দেখা গেছে। খুব সম্ভবত এডিট এবং ডিরেকশনের সমন্বয় হয়নি কিছু জায়গায়।

২৭ মিনিটে এক কলসি থেকে আরেক কলসিতে দুধ ঢালার সময় পরিমাণ খুব কমই লাগছিল। ওটা তো কাঁধে বহনের মতো ভারি ছিলো না। ২৮.৩৮ মিনিটে জয়ানন্দ কলম নাড়ছিল সেখানে দুইটা আলাদা শট মিক্স করতে গিয়ে আটকে যায়। অবশ্য লাইটিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডের স্মুথনেস ওটাকে বুঝতে দেয়নি। ২৯ মিনিটে জয়ানন্দ যখন হাওড়ের পাড়ে দৌড়াচ্ছিলেন তখনো অসামঞ্জস্য দেখা যায়। ৫৯ মিনিটে ফাল্গুন/চৈত্র মাসের যে কোকিলের কণ্ঠে ব্যাকগ্রাউন্ড বাজছে সেখানে পাগল জয়ানন্দ যখন মাটিতে পা ঘষছিলেন তখন মাটি ভেজা।

জয়ানন্দের স্কিন টোনের ঔজ্জ্বল্যের কারণে তার হাতের এক অংশে টিশার্টের হাতার জায়গাটুকু উজ্জ্বল আর বাকিটুকুতে স্পষ্ট আলাদা কালার। অথচ সিনেমার গল্পে তো তার গোটা বসনই একটা কালার হওয়ার কথা কস্টিউম অনুসারে।

জয়ানন্দ চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনয় বেশ ভালোই। ভয়েসওভারের সঙ্গে তার ঠোঁট মিলানোর জোরের একটা ব্যালান্স পাওয়া যাচ্ছিল। এ ছাড়া পাগল চরিত্রে কিংবা ওই যে তার যে প্রথমে কনফিউজড এবং পরে অনুতপ্ত হিসেবে নিজেকে প্রেজেন্ট করা সেটা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। চন্দ্রাবতী চরিত্রে অভিনয় করেছেন দিলরুবা দোয়েল। দোয়েলের অভিনয়/চাহনি সবকিছুতেই একটা পরিপক্বতার ছাপ বিদ্যমান। এই ক্যারেক্টারের জন্য যে চ্যালেঞ্জ দরকার তা তিনি নিতে পেরেছেন ভালোভাবেই। যদিও কিছু কিছু জায়গায় তার ডাবিংয়ের সময়ে উচ্চারণে অতিরিক্ত শুদ্ধতা দেখা যায়। কাজী নওশাবা সোনাই চরিত্রে শুরুতে কিছুটা আড়ষ্ট মনে হলেও পরে ওটাকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন। দ্বিজবংশী চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, অশোক চরিত্রে তনয় বিশ্বাস এবং তার গুরু চরিত্রে বলরাম বিশ্বাস, বয়াতি চরিত্রে খোকন বয়াতির অভিনয় অসাধারণ ছিল। এই সিনেমায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল বয়াতির কণ্ঠে আর ভাবে চন্দ্রাবতীর চোখে সীতাকে পড়তে পারা।

এন রাশেদ চৌধুরী তার এই কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেই আমার ধারণা। তিনি নিছক একটা সিনেমা বানাননি। সেলুলয়েডে ধারণ করেছেন একটা সময়কে যার চিহ্ন খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। তার গবেষণা, তার এই কাজকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য যে ডেডিকেশনের ছাপ গোটা সিনেমাজুড়েই পাওয়া যায় সেখানে এমন কিছু ভুল-ত্রুটি কিংবা সীমাবদ্ধতা বাদ দিয়ে আমাদের বিচার করা উচিত এই কাজ কতটুকু গুরুত্ব নিয়ে আসবে। সেই নিরিখে ভেবে দেখলে ‘চন্দ্রাবতী কথা’কে একটা মূল্যবান সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে আমাদের।


About The Author

সাইদ খান সাগর

সিনেমাকর্মী

Leave a reply