Select Page

যার বন্ধু অসৎ, তার শত্রুর প্রয়োজন নাই

যার বন্ধু অসৎ, তার শত্রুর প্রয়োজন নাই

বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরিচালক এফ কবীর চৌধুরী। আশি দশকে আমি যখন সবে ছায়াছবি দেখা শুরু করি তখন তার ক্যারিয়ারে বসন্তকাল।

এফ কবীর চৌধুরীর ছবি-ই মানে হাউসফুল! টিকেট কাউন্টারে মারামারি-ধরাধরি-ধাক্কাধাক্কি! তার ছবির দর্শক ছিল বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ; দিনমজুর, শ্রমিক, মুটে, রিকশা চালক, বেবি চালক! সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে একটু বিনোদন মানে এফ কবীর চৌধুরীর ছবি।

সারাদিন রিকশা চালক যুবক কঠোর পরিশ্রম করে, অহংকারী যাত্রীদের গালমন্দ খেয়ে! দিনশেষে যখন এফ কবীর চৌধুরীর ‘আবেহায়াত’ দেখে, অঞ্জু ও ওয়াসীম অভিনীত ‘চাকবুম চাকবুম চাঁদনী রাতে’ অথবা ‘নরম গরম’ ছবি দেখতে গিয়ে মিঠুন-রাণী অভিনীত ‘প্রেমের খেলা অনেক হলো এবার সখি ঘরে চলো’ গান দেখে ও শুনে তখন শরীরের সকল ক্লান্তি দূর হয়ে স্বপ্নের জগতে চলে যায়।

একজন শ্রমিক স্ত্রীর বাজারের তালিকা পূর্ণ করতে না পেরে, স্ত্রীর কটুকথা শুনে রাগ করে বাহির হয়ে যায়। ভাবে আর ঘরে ফিরে আসবে না তখন কোনো হলে গিয়ে মি. চৌধুরীর ছবি দেখে। ছবিতে স্বামী ওয়াসিমের অভিমান ভাঙাতে স্ত্রী অঞ্জুর গান, ‘এই বৃষ্টি রাতে চলে যেও না…’ দেখার পর সকল রাগ পানি হয়ে যায়। সিনেমা শেষে পাখি তার নীড়ে ফেরে। স্ত্রী তরকারি গরম করে অপেক্ষা করছে যে!

এফ কবির চৌধুরী

মি. চৌধুরীর ছবি তাই খেটে-খাওয়া মানুষজন দেখতো বেশি। খেটে-খাওয়া মানুষদের তিনি ফ্যান্টাসি জগতে নিয়ে যেতেন!

এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত একটি ছায়াছবি ছাড়া সবই দেখেছি। তবে কোনো ছবি মনে রাখার মতো নয়। যতক্ষণ দেখি ততক্ষণ আনন্দ। হল থেকে বাহির হলে সব শেষ। আবার দেখলে আবার আনন্দ। আবার হল থেকে বের হলে সবশেষ।

মনে দাগ কাটার মতো না হলেও তার ছবি নামে শুধুই বিনোদন আর বিনোদন। গান আর গান; যেমন— ‘আকাশ থেকে পড়লো যে তালগাছের এক খাম্বা, গোলগাল মুখটা যে নাকটা যে তার লাম্বা’, ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা আমারই মনের জ্বালা, ‘চাচা ও চাচা আপনা জান বাঁচারে দুনিয়াটা লোহার খাঁচা’, ‘পদ্মাবতী বেদেনী আমার প্রাণ সজনী… এ কথা ভাবতে আমার সুখ লাগে’, ‘এই নিশি রাইতে তোমার কাছে যাইতে’র মতো এমন অনেক গান ছিল আশি দশকের জনপ্রিয়। পথেঘাটে, লঞ্চঘাটে, চায়ের দোকানে এইসব গান বাঁজতো।

প্রবাস থেকে স্বামী স্ত্রীকে চিঠি দিতো, এমন একজন স্ত্রীকে আমি চিঠি পড়ে শোনাতাম। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র।

“প্রাণের প্রিয়া,

তোমাকে ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না। দিন আমার যেমন-তেমন রাত আমার জাহান্নাম। সারারাত তোমার বিচ্ছেদের আগুনে জ্বলেপুড়ে মরি… (ব্যক্তিগত অনেক কথা নাইবা প্রকাশ করলাম)।

সামনের পৌষমাসে মিজি বাড়ির কালাচাঁন দুবাই আসবে। তারে এই গানের ক্যাসেটগুলো দিবা আমার জন্য।

নরম গরম, আবে হায়াত, জালিম… (সব ছবিই এফ কবীর চৌধুরীর) এই বইগুলোর (ছায়াছবিকে বই বলা হতো) গানের ক্যাসেটগুলো পাঠাতে। বক্করকে রিয়াজুদ্দিন বাজার বিনিময় ক্যাসেট দোকানে পাঠাবে, ওখান থেকে আনবে। ভালো থেকো, আমার জন্য চিন্তা করো না।

ইতি

তোমার প্রাণের প্রিয়তম”

তবে এফ কবিরের একটি ছায়াছবির কাহিনি আমার মনে ভীষণ দাগ কাটে, আমার জীবনের দিকনির্দেশনা হয়ে যায়। যার নাম ‘নীল দরিয়া’, এটি এফ কবীর চৌধুরীর শেষ ছায়াছবি। ছায়াছবিটি আমি দেখি ঊনত্রিশ বছর আগে। তখন আমার বয়স পনের বা ষোল বছর হবে।

‘নীল দরিয়া’র কাহিনি এমন—  জাহাজের ক্যাপ্টেন নাদিমের মা ও বোনকে নিয়ে সুখের সংসার। সহকর্মীদের একজন তার ঘনিষ্ট বন্ধু, যদিও চরিত্রের সে বিচারে সম্পূর্ণ নাদিমের বিপরীত।

নাদিমের কাছে নারী মানে মা, বোন, আর কোনো একজন প্রিয়তমা। নাদিমের বন্ধুর কাছে নারী মানে শারীরিক সম্পর্কের বস্তু। সে নারীকে অশ্লীলভাবে দেখে।

জাহাজে চাকরির সুবাদে নাদিমকে দেশে দেশে বন্দরে বন্দরে নোঙর ফেলতে হয়। অবসরে সেই বন্ধু নারীঘটিত আনন্দে মেতে উঠে। ডিসকো, নাইট ক্লাবে যায়। নাদিম নিজ রুমে উদাস থাকে। মাঝে মাঝে পকেট থেকে পার্স বের করে ছোটবোনের মায়াবী চেহারার ছবি দেখে।

একটি বন্দরে একবার জাহাজ নোঙর করে। নাদিমের সেই বন্ধু ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্রতীরবর্তী একটি পাহাড়ি অঞ্চলে চলে যায়। সেখানে পাহাড়ি তরুণী সুনেত্রাকে দেখে। সে সুনেত্রাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কুমারী মা বানায়। তারপর পালিয়ে যায়। এইসব নাদিম জানতো। নাদিম জানতো তার বন্ধু সুনেত্রাকে বিয়ে করবে না। শুধু টাইমপাস করছে। নাদিম যদি এইসব অপকর্ম পছন্দ করছে আবার বাঁধাও দিচ্ছে না। কারণ, সে বন্ধু যে!

এক সময় নাদিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব শত্রুতা রুপ নিল; যেদিন জানতে পারলো সে শুধু চরিত্রহীনই নয়, মাদক স্মাগলার। সে নিজ দেশে মাদক এনে যুবসমাজ ধ্বংস করছে। নাদিম এমন দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করে। শুরু হয় বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতা। সেই বন্ধু নাদিমের ছোটবোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। তারপর নাদিম প্রতিশোধ নিতে নিজেকে তৈরি করে।

এই ছবির কাহিনী থেকে আমি কৈশোর বয়সে যা শিখেছি— সুজন দেখে বন্ধুত্ব করতে হয়। যার বন্ধু চরিত্রহীন-অসৎ, তার শত্রুর প্রয়োজন হয় না।

যে বন্ধু চরিত্রহীন, সে যতই অন্তরঙ্গ হোক না কেন। তার কাছ থেকে নিজ পরিবারের নারী সদস্য নিরাপদ নয়। তাই চলার পথে বন্ধু অনেকেই হতে পারে। তবে তাদের থেকে নিজ পরিবারকে সতর্ক রাখতে হবে। আমি এই ছবি দেখার পর বন্ধুত্ব করতে সতর্ক হয়ে যাই।

যার চরিত্রে সমস্যা আছে। সেটা নারী বিষয় হোক বা দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্র বিষয় হোক। আমি সেই ব্যক্তির সাথে আমার পরিবারের পরিচয় করাই না। আমি ব্যক্তি জীবনে খুব যাচাই-বাছাই করে তারপর কারো সাথে অন্তরঙ্গ হই।

এই একটিমাত্র ছায়াছবির জন্য এফ কবীর চৌধুরীকে এখনো আমার মনে আছে। সারাজীবন মনে থাকবে হয়তো।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন