Select Page

যে বাস্তবতা আমরা কখনো বলতে চাই না

যে বাস্তবতা আমরা কখনো বলতে চাই না

ঠিক কতগুলো বাংলা সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছিলাম তা গুনে সঠিকভাবে বলতে পারবো না। একটা দশকের প্রায় সবগুলো মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা হলে দেখেছিলাম। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমার দেখা সিনেমাগুলোর মধ্য একটা সিনেমা দেখাতে যার গল্প ও সংলাপ পুরোপুরি বাস্তব জীবনের সাথে মিলে যায়; তাহলে বলবো কাজী হায়াতের ‘ধর’-এর কথা।

সিনেমাটির পুরোপুরি বাণিজ্যিক, কিন্তু গল্প ও সংলাপ এ দেশের সুশীল বোদ্ধাদের ‘আর্ট ফিল্ম’কেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন গল্প ও দুর্দান্ত সংলাপ আজ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশের কোন ধারাতেই দ্বিতীয়টি দেখিনি। যারা ‘ধর’ দেখেনি তারা পোস্টার দেখে কল্পনাও করতে পারবেন না সিনেমাটি কেমন! কী রকম শক্তিশালী গল্প আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তা অনুভব করতে পারবেন না। পোস্টারের আড়ালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও সাহসী একটি চলচ্চিত্র লুকিয়ে যা কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না। 

সত্যি বলতে কী, আজ থেকে ২৩-২৪ বছর আগে হলে যাওয়ার সময়ও বুঝতে পারিনি আমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে! সিনেমা শুরুর প্রথম সেকেন্ড থেকে ১৩৫ মিনিট পর্যন্ত অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মনে হয়েছিল, আমি সম্ভবত ঢাকার কোন এক বস্তিতে এসে পড়েছি এবং গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে বিচরণ করছি। 

সমাজের নির্মম একটি বিষয়কে তুলে ধরা গল্প ও পুরোপুরি বাস্তব মেশানো সংলাপের কারণে কাজী হায়াতের অন্য সিনেমাগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে ‘ধর’। গল্প-সংলাপে তিনি একদমই সুশীলতা দেখাননি। একজন পরিচালক যখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নির্মাণ করেন তখন তার ছাপ সিনেমার প্রতি পরতে পরতে দেখা মেলে। ‘ধর’ তেমনই একটা চলচ্চিত্র যেখানে তিনি প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী কারো পরামর্শে কোন দৃশ্য ধারণ করেছেন বলে মনে হয় না। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের চিন্তাকে উজাড় করেছিলেন।

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ পর্যন্ত এমনভাবে বলেছিলেন যে গল্পটির শুরু থেকেই দর্শক পর্দায় বুঁদ হয়ে যায় অর্থাৎ সিটে বসামাত্রই গল্পের ভেতরে নিজেকে সম্পৃক্ততা করে ফেলে। এক সেকেন্ডও বোরিং লাগার ফুরসৎ নেই। প্রতিটি দৃশ্য ও সংলাপের ভেতর বাস্তব জীবনের চারপাশকে খুঁজে পায় যা সে এতদিন দেখেও না দেখার ভান করতো, শুনেও না শুনার ভান করতো। কিন্তু আজ সেই সমাজ, পরিবেশ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে সিনেমা। 

সংলাপগুলোকে শিক্ষিত, সুধীজনদের কাছে খুবই অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মনে হবে কিন্তু একটি সংলাপও অবাস্তবমনে হবে না। বরং প্রতিটি সংলাপকেই খুব চেনা-জানা মনে হবে; যা হয়তো আপনি সুশীলতার মুখোশ পড়ে ‘অশ্লীল’ বলছেন। জন্ম-পরিচয়হীন এক টোকাই কখনো শিক্ষিতজনদের মতো কথা বলে না; এই সত্যটা যারা সিনেমা দেখার সময় অস্বীকার করে তারা সুশীল বা বোদ্ধা নামের ভন্ড। একটা সিনেমার গল্প তখনই সার্থক হয় যখন দর্শক শুরুর দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত নিজেকে যুক্ত করতে পারে, উপভোগ করতে পারে ও এ সময় তার মনের ভেতর নানা প্রশ্নের ঝড় উঠতে থাকে। দর্শকের আবেগ, অনূভুতি, বিবেক সবকিছু একত্রে নাড়া দিতে থাকে। মনের ভেতর প্রশ্ন জাগতে থাকে, চরিত্রগুলো বাস্তবে আমাদের আশেপাশে দেখেছি কিন্তু নিজেদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, পারিবারিক আবহের কারণে তা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে সংকোচ বোধ করি কিংবা তাদের কাছে ঘেঁষতে ভয় করি।

গল্পে মান্না, ডিপজল, ববিতা, একা, সাগির, মিজু আহমেদ সবাই এই সমাজের বাস্তব একেকটি চরিত্র, যারা সমাজপতিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন— ওই সমাজপতিরা অর্থবিত্ত, ক্ষমতার বলে সমাজের একটা নির্মম সত্যকে পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে; অথচ ওই নির্মমতা তাদের হাতেই তৈরি হয়, নিজ স্বার্থে জারজদের ব্যবহার করে কিন্তু উঠতে বসতে ওদের ঘৃণা করে। অর্থাৎ সমাজপতিদের মধ্যেই আছে জারজের জন্মদাতা, আশ্রয়দাতা কিন্তু মানুষ হিসেবে পরিচয়টুকুও কেড়ে নিয়েছে তারা। ‘ধর’-এর সংলাপগুলো এতটাই গরম যে আপনাকে প্রতিটা মুহূর্ত শ্রবণশক্তিকে সজাগ করে শুনতে হবে।  বিশেষ করে মান্নার মুখে বলা প্রতিটি সংলাপই এই দেশ, সমাজ ও সমাজপতিদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা অসংগতি, ভন্ডামিকে  ব্যঙ্গ করে। সুশীলদের কাছে যা মনে হবে অশ্লীল কিন্তু প্রতিটি সংলাপই যৌক্তিক।

আমার কাছে এই ছবির মান্নার কান্নার দৃশ্যগুলো হলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ইউনিক ও এপিক কান্নার দৃশ্য। কান্নারত সংলাপগুলো দর্শকের নীরব চোখগুলো যেমন ভিজিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি হল থেকে বেরোনোর পর বারবার মান্নার মুখটা চোখে ভাসছিল।  এমনকি যখন লেখাটি লেখছিলাম তখনো বারবার সেই কান্নাভেজা মুখটি ভেসে উঠছে। হলের ভেতর শ’পাঁচেক দর্শকদের মনের ভেতর মান্নার হাহাকারগুলো যেন সব উল্টেপাল্টে দিয়ে পুরো পরিবেশে অবিশ্বাস্য এক গুমট ভাব এনে দিয়েছিল সেদিন। একটা চলচ্চিত্র দর্শকদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেই শক্তি ‌‘ধর’ দেখিয়ে দেয়।

ছবিটির প্রাণ হলো মান্না আর তাকে প্রতি পরতে পরতে শক্তি জোগায় ডিপজল। দুজনের প্রতিটি কথোপকথন আপনাকে রিপিট করে পুনরায় শুনতে বাধ্য করবে; হলে দর্শকদের সে সুযোগ ছিল না তবুও মান্না-ডিপজলের একাধিক সংলাপ প্রথম শোনাতেই তাদের মনে ঢুকে যায়।  এই যেমন; মন্ত্রী মিজু আহমেদের বাসায় বসে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মিটমাট করার আলোচনার মাঝখানে মান্নার বলে ওঠা, ‘ওস্তাদ, চলো, এই বালের মিটিংয়ে থাকলাম না’ কিংবা মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বের হয়ে ডিপজলকে উদ্দেশ্য করে মান্নার বলা, ‘ওস্তাদ ঐ লোক কি তোমার ওস্তাদ? ঐ লোক যদি নেতা হয় তাহলে দেশের গোয়া মারা সারা। আমি হইলাম জাউরা আমার ওস্তাদ তুমি, তুমি একটা গাঞ্জাখোর আর তোমার ওস্তাদ হইলো ঐ মন্ত্রী, গাঞ্জাখোরের ওস্তাদ যদি মন্ত্রী হয় তাহলে দেশের গোয়া মারা হইবো নাতো কি উন্নতি হইবো?’

পুরো সিনেমায় মান্নার সংলাপগুলো ছিল এই দেশ, সমাজ ও সমাজপতিদের ওপর ক্রোধ আর ঘৃণায় ভরা; কিন্তু বাস্তবে শিক্ষিতজনেরাও লুকিয়ে লুকিয়ে বলে কিন্তু প্রকাশ্য তা অস্বীকার করে। মান্না পুরো আড়াই ঘণ্টা সেসব ভন্ডদের মুখে চপটাঘাত করে গেছে, সমাজপতিদের নষ্টামিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

কাজী হায়াৎ না থাকলে হয়তো ‘ধর’-এর মতো এত শক্তিশালী একটা চলচ্চিত্র বাংলাদেশ পেতো না। যারা এর গল্প ও সংলাপকে অশ্লীল বলে তারা সমাজের বাস্তবতাকেই অস্বীকার করে। 


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন