Select Page

রাখাল বন্ধু: ত্রিভুজ প্রেম, নোংরা রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

রাখাল বন্ধু: ত্রিভুজ প্রেম, নোংরা রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

আশি দশকের মাঝামাঝি উজালা সিনেমায় ‘রঙিন রাখাল বন্ধু’ দেখি। পরিচালক ইবনে মিজান ষাটের দশকে ‘রাখাল বন্ধু’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করে। আশির দশকেরটি সেই ছবির রিমেক; অভিনয় করেন সাত্তার, জিনাত, মনিকা। ত্রিভুজ প্রেম কাহিনি।

আমার বাসার কাছেই উজালা সিনেমা। দেখতাম প্রতিটা শোতে দর্শকদের ভিড়। নারী-পুরুষ উভয় সমানতালে ছবি দেখতে ভিড় জমাতো। ছবির চেয়ে ছবির গানগুলো বেশি জনপ্রিয়তা পায়। যখন আমি ছবিটি দেখি তখন বয়স দশ-বারো বছর হবে।

চার বছর পরের ঘটনা। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে উইলিয়াম শেক্সপীয়র রচিত ‘ম্যাকবেথ’ পড়ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল এই কাহিনি নিয়ে নির্মিত একটি সিনেমা দেখেছি। কিন্তু নাম মনে করতে পারছিলাম না।

১৯৯৪ সালে নেভাল অডিটোরিয়ামে আবারও ‘রঙিন রাখাল বন্ধু’ দেখি। কাহিনির শুরুতেই বুঝতে পারি, শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ থেকে নেওয়া কাহিনী।

কাহিনি সংক্ষেপ— সেনাপতি কায়সার যুদ্ধজয় করে তাঁবুতে ফিরছিলেন। সাথে আরেক যোদ্ধা। সেই যোদ্ধা সেনাপতি কায়সারের বন্ধু। পথে এক দরবেশের সাথে দেখা। দরবেশ কায়সারকে বলে, কায়সার একটি প্রদেশের সুবেদার হতে যাচ্ছে এবং কিছুদিনের মধ্যে শাহেনশাহ হবে। আরও বলে, কায়সারের বন্ধুর ছেলে দেলোয়ার বড় হলে সেও শাহেনশাহ হবে।

দুই বন্ধু এই ভবিষৎবাণী বিশ্বাস করে না। দরবেশকে পাগল ভেবে হেসে উড়িয়ে দেয়। আবার তারা চলতে থাকে। পথেই দেখা রাজদূতের সাথে। রাজদূত জানায়, শাহেনশাহ যুদ্ধজয় করায় খুশি হয়ে কায়সারকে সুবেদার পদে নিযুক্ত করেছে।

দরবেশের ভবিষৎবাণী সাথে সাথে সত্য হওয়ায় দুই বন্ধু অবাক হয়ে যায়। প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী যখন সত্য হয়, তখন পরের দুটিও সত্য হবে তা বুঝতে পারে তারা। পরের দুটি ছিল কায়সারের শাহেনশাহ হওয়া এবং কায়সারের বন্ধুর ছেলে দেলোয়ার বড় হলে শাহেনশাহ হওয়া।

কায়সার তাবুতে এসে শাহেনশাহর সাথে দেখা করে। শাহেনশাহ বলে, আমরা এখন রাজদরবারে ফিরে যাবো তবে রাতে তোমার মহলে রাত্রিযাপন করবো।

কায়সার দূতের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে স্ত্রীকে জানায় রাতে শাহেনশাহ মেহমান হবে। চিঠিতে আরো জানায় দরবেশের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা।

তখন কায়সারের স্ত্রীর মাঝে লোভ জন্ম নেয় স্বামী শাহেনশাহ হবে। প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী যখন সত্য হয়েছে, তাহলে দ্বিতীয়টিও সত্য হবে। কিন্তু কায়সারের স্ত্রী ধৈর্য্য ধারণ করতে পারছিল না। যুবরাজকে উম্মাদ হওয়ার ঔষধ খাইয়ে যুবরাজের নাম লেখা খঞ্জর দিয়ে শাহেনশাহকে হত্যা করা হয়। যাতে সবাই বুঝে যুবরাজ উম্মাদ হয়ে শাহেনশাহকে হত্যা করেছে। স্ত্রী কায়সারকে উস্কানি দিয়ে, সে শাহেনশাহ হয়ে যুবরাজের মৃত্যুদণ্ড দেয়।

এ দিকে কায়সার বন্ধুকে বলে তার ছেলে দেলোয়ারকে নিয়ে প্রাসাদে নৈশভোজে আসতে। বন্ধু আতংকিত হয়ে উঠে। কারণ, দরবেশের তৃতীয় ভবিষৎবাণী, দেলোয়ার শাহেনশাহ হবে। তাহলে দেলোয়ার কায়সারের জন্য আতংক।

কায়সার বন্ধুকে অভয় দিয়ে বলল, আমি দেলোয়ারকে আমার মেয়ে পরীবানুর জন্য মনোনীত করেছি। সে হবে আমার ভবিষ্যৎ জামাতা। কায়সারের কথায় বিশ্বাস করে যখন দেলোয়ারকে নিয়ে প্রাসাদে আসছিল তখন সৈন্যরা পথে আক্রমণ করে। বন্ধু বুঝতে পারে কায়সার পথের কাঁটা সরাতে চায়।

দেলোয়ারকে পালিয়ে যেতে বলে পিতা। তারপর সৈন্যদের সাথে একা লড়াই করতে করতে আহত হয়। মৃত্যু ভেবে সৈন্যরা চলে যায়। এলাকার দস্যুদল উদ্ধার করে নিজ আস্তানায় নিয়ে যায়।

দশ-বারো বছরের দেলোয়ার পালিয়ে বনে এসে নিজের দামী পোশাক খুলে, গায়ের অন্য পোশাক ছিড়ে গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামের গরুর পালের এক মালিকের কাছে গরু চড়ানোর কাজ নেয়। মানে রাখাল। সেই মালিকের একটি মেয়ে ছিল নাম ফুলবানু। ফুলবানু আর দেলোয়ার একসাথে বড় হতে থাকে। তারা যুবা হওয়ার পর ফুলবানু দেলোয়ারকে একতরফা ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা ছিল অনেক গভীর।

দেলোয়ার সারাদিন গরু চড়াত আর বাঁশি বাজাত। বাঁশির সুরে ফুলবানু নিজেকে দেলোয়ারের মাঝে হারিয়ে ফেলত। বাঁশির সুর শুনে শাহেনশাহ কায়সারের মেয়ে রাজকুমারী পরীবানুও প্রেমে পড়ে। দেলোয়ারকে প্রেম নিবেদন করে। তারপর দেলোয়ার ও পরীবানুর প্রেম শুরু হয়। পরীবানু বাবা ও ভাইয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাখাল দেলোয়ারের সাথে প্রেম করতে থাকে।

ফুলবানু প্রথম প্রথম মেনে নিতে পারে না। মনে মনে অনেক কষ্ট পায়। পরে বাস্তবতা মেনে নেয়।

রাখাল দেলোয়ারের সাথে রাজকুমারী পরীবানুর প্রেম ধরা পড়ে পরীবানুর ভাইয়ের কাছে। রাখালকে ধরে নিয়ে যায়। পরীবানুর ভাই রাখালকে কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে এবং এক পেয়ালা বিষ দেয় পান করতে। বলা হয়, তিনদিনের মধ্যে যেন বিষপান করে মারা যায়।

ফুলবানু রাখালকে মুক্ত করতে রাজমহলে যায়। পরীবানুর ভাইয়ের সাথে ছলনা করে মোহরযুক্ত আংটি নিয়ে কয়েদখানা থেকে রাখালকে মুক্ত করে বলে পরীবানুর সাথে পালিয়ে যেতে। রাখাল পরীবানুর সাথে পালিয়ে যায়।

ফুলবানু সেই বিষপান করে আত্মহত্যা করে, যাতে পরীবানুর ভাই ফুলবানুর ইজ্জ্বত নষ্ট করতে না পারে। রাখাল ও পরীবানুকে ধাওয়া করতে গিয়ে পরীবানুর ভাই নৌকা ডুবে মারা যায়।

রাখালের বাবা যিনি দস্যুদের সাথে ছিলেন। রাখালের সাথে এক হয়ে কায়সারের মহলে অতর্কিত হামলা চালায়। কায়সার জানতে পারে এই রাখাল সেই দেলোয়ার। তখন কায়সার বিষপানে আত্মহত্যা করে।

মৃত্যুর আগে উজিরকে বলে, যুদ্ধ বন্ধ করতে। এটা দরবেশের তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে। দেলোয়ারকে সম্বর্ধনা জানাতে। দেলোয়ার শাহেনশাহ হয়ে ফুলবানুর স্মৃতিতে বিশাল এক মিনার তৈরী করে।

ধন্যবাদ ইবনে মিজানকে শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথের ছায়া অবলম্বনে ‘রাখাল বন্ধু’ নির্মাণ করার জন্য। আবারও ধন্যবাদ আশি দশকে রিমেক করে আমাদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে আমি সাদাকালো এবং রঙিন উভয় দেখেছি। কিন্তু আমার বয়সী অনেক দর্শক সাদাকালোটি দেখার সুযোগ পায়নি।

সিনেমা আমার কাছে শুধু বিনোদন না, সিনেমা আমার কাছে গল্পের বই। যে গল্পে আমি বিনোদন খুঁজি সাথে সাথে শিক্ষা। এই গল্পের শিক্ষা হলো; যে বাঁকা পথে ক্ষমতায় আসে, তাকেও বাঁকা পথে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।

যদিও ‘রাখাল বন্ধু’ সিনেমা ত্রিভুজ প্রেম কাহিনী নির্ভর কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন আছে, এই দর্শন খুঁজতে হলে দর্শককেও দার্শনিক হতে হয়।

এই ছবিতে যে রাজনীতি দেখানো হয়েছে, সেই রাজনীতি, সেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সেই বিশ্বাসঘাতকতা এখনো চলছে রাজনীতিতে। শুধু রাজনীতির নাম বদলেছে। রাজতন্ত্র হয়েছে গণতন্ত্র।

ক্ষমতায় যেতে এবং ক্ষমতায় থাকতে কিভাবে পথের কাটা সরিয়ে ফেলা হয় তা দেখানো হয়েছে।

অতীতেও হতো, এখনো হবে, ভবিষ্যতেও হবে।

রাখাল বন্ধু মূলত ত্রিভুজ প্রেম কাহিনীর সিনেমা হলেও আছে নোংরা রাজনৈতিক কূটচাল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার কূটকৌশল। সিনেমাটি রাজনৈতিক সিনেমা বললে মোটেই ভুল হবে না।

শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

মন্তব্য করুন