রাষ্ট্রচিন্তার ছবি ‘স্বপ্নের পৃথিবী’
স্বপ্নের পৃথিবী;পরিচালক বাদল খন্দকার; শ্রেষ্ঠাংশে সালমান শাহ, শাবনূর, ববিতা, আসাদ, দিলদার, অমল বোস, জহির উদ্দিন পিয়ার, কাবিলা, রাজিব প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান বৃষ্টি রে বৃষ্টি আয় না জোরে, তুমি আমার মনের মানুষ; মুক্তি ১২ জুলাই ১৯৯৬
আমরা যারা ছাত্রজীবন পার করে এসেছি মনে করে দেখবেন সামাজিক বিজ্ঞান নামে একটা বই ছিল। বইটিতে অনেকগুলো অধ্যায় থাকত পরিচ্ছেদসহ। অন্যতম একটি অধ্যায় ছিল পৌরনীতি। পৌরনীতি-র পরিচ্ছেদভিত্তিক আলোচনায় ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ নামে একটা টার্ম ছিল। রাষ্ট্রের ধারণা দিতে এ টার্মটি ব্যবহৃত হত। আদর্শ রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় আদর্শ শাসন ও শান্তিকামী জনগণের কথা বলা হয়। এ দুটির সংমিশ্রণ ঘটলে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্রচিন্তার এই দর্শন নিয়ে অনেক শিল্প সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিনেমা। সিনেমায় আমাদের দেশে রাষ্ট্রচিন্তার ধারণা থেকে অসাধারণ একটি বাণিজ্যিক কাজ ‘স্বপ্নের পৃথিবী।’
‘স্বপ্ন’ বিষয়টি সবাইকে তাড়া করে। জীবনে ভালো থাকা বা ভালোভাবে বাঁচা, ভালো চাকরি করা, ভালো ভবিষ্যতের আশা করা এগুলো মানুষের সহজাত। সবার কল্পনায় আলাদা করে একটি পৃথিবী সাজানো থাকে। এ পৃথিবীতে যার যার অবাধ ভাবনার স্বাধীনতা। একটি শান্তিকামী শোষণহীন সাম্যবাদী রাষ্ট্রের চিন্তা থেকে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবি নির্মিত হয়েছে।
বাবার শোষণের শাসন থেকে মুক্তি পেতে নিজেই শোষিত মানুষের সাথে এক হয়ে লড়াই করে যায় এক যুবক। এই যুবকটি ছবির প্রধান চেতনা। তার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের, ক্ষেত্রবিশেষে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বলতে গেলে নিজের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নিজেরই বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং সেটাই পরিবর্তনের চাবিকাঠি। সালমান শাহ সেই চেতনার নাম। তার বাবা রাজিবের লাগামহীন অত্যাচারের শাসন থেকে সে বেরিয়ে আসে নিজের সাম্যবাদী চেতনায়। তার কাছে মানুষই আসল কথা।
পিতা-পুত্রের প্রতীকটি ছবিতে গভীরভাবে শোষক আর বিপ্লবের বড় একটি ক্যানভাস। রাজিব যখন বিদেশ ফেরত ছেলেকে বংশের রেওয়াজ মেনে নিম্নবিত্ত মানুষের পেতে দেয়া পিঠের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে আদেশ করে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে সালমান। নিজের তৈরি করা নিয়ম তখন নিজেকেই কশাঘাত করে রাজিবকে। সালমান বলে দেয় এটা ঠিক নয়। খাবার টেবিলে বসেও সে বাবার সাথে তর্কে যায় যে তার বাবার ভুল একদিন ভাঙবে।
বিপ্লব বা রীতি ভাঙার প্রথম শর্তই হচ্ছে নিজে বিপ্লবে শামিল হওয়া। কার্ল মার্কস যেমন শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সেই রাষ্ট্রের চেতনার মধ্যে সালমানের চরিত্রকে আনা যায়। সে চলে যায় সেইসব মানুষের কাছে যাদের লাইফস্টাইলের সাথে তাকে মানিয়ে চলতে হবে। প্রথমত তারা তাকে বিশ্বাস করে না। অমল বোস যে ছিল রাজিবের খাস লোক তার জামাতা, মেয়েকেও রাজিব হত্যা করে। তাই রাজিবের ছেলেকে বিশ্বাস করতে চায় না। বিশ্বাস করতে চায় না আসাদ-ববিতাও। সালমানের তখন অন্য একটা পরীক্ষা করতে হয়। হাত কেটে রক্তের রংকে আলাদা করতে বলে কিন্তু সেটা তো কারো পক্ষে সম্ভব না। অতঃপর সালমান তাদের বিশ্বাস অর্জন করে। সালমানের আইডেনটিটি হয় ‘রাখাল।’ রাখাল বিষয়টাও খুব সূক্ষ্ম অন্তত নিম্নশ্রেণির একজন প্রতিনিধি হবার জন্য উপযুক্ত। রাখাল সালমানের সাথে প্রেম হয় শাবনূরের। প্রেম নিয়ে একটা গভীর চিন্তা আছে ছবিতে। কার সাথে কার প্রেম এটুকু ভাবলেই চলে। ষড়যন্ত্র তারপরেও চলে। সালমানকে নিম্নবিত্তের কাছে চরিত্রহীন প্রমাণ করাতে ধর্ষণে অভিযুক্ত করা হয় কাবিলাকে দিয়ে। রাজিবের ষড়যন্ত্রকে ভুল প্রমাণ করে সালমান কারণ তার রক্তে শোষিত মানুষের জন্য দরদ আছে।
বিপ্লবের পদ্ধতি কালে কালে বদলায় কিন্তু ভাষা একটাই থাকে সেটা হচ্ছে গর্জনের ভাষা। গীতায় একটি শ্লোক আছে- ‘ধর্মসংস্থাপনার্থায়া সম্ভবামি যুগে যুগে’। যুগে যুগে বিপ্লবের প্রয়োজন পড়ে পরিস্থিতির বিচারে। সালমান ও রাজিবের খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যে বাকযুদ্ধ চলে ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী সিকোয়েন্স ছিল এটা। কথাগুলো এমন—
রাজিব : বেয়াদবি কোরো না, মাসুম। তুমি যাদের সাথে হাত মিলিয়েছ তারা শুধু নিতেই জানে। ওরা প্রয়োজন ফুরালে তোমাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে।
সালমান শাহ : আপনি ভুল ভাবছেন আব্বাজান। এখনো সময় আছে আপনার শোষণ আর অহংকার ছেড়ে এদেরকে বিশ্বাস করুন। নয়তো এমন এক দিন আসবে আপনার প্রাসাদের প্রতিটি ইট খুলে ওরা আপনাকে একদিন নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
সালমান ও রাজিব পিতা-পুত্রের অভিনয় তখন মন্ত্রমুগ্ধ করবে যে কাউকেই।
অত্যাচারীর দেয়ালে পিঠ ঠেকলে নিম্নশ্রেণির উত্থান ঘটে। রাজিব নিজের আদর্শকে জয়ী করতে শেষ পদক্ষেপে অমল বোস, আসাদ, ববিতা-দের ভিটাছাড়া করলে তারা পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ববিতার ছেলেটি পানি তৃষ্ণায় পানি আনতে গেলে জহির উদ্দিন পিয়ারের গুলিতে ছেলেটি মারা যায়। সালমান চূড়ান্ত বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হয়। সালমানকে বাঁচাতে শাবনূরকে আগুনের উপর দিয়ে হাঁটতে নির্দেশ দেয় রাজিব সেটা ছিল তার অত্যাচারের চূড়ান্ত দিক। সালমানের ঐ সময়ের সংলাপ- ‘চৌধুরী, তুমি কি মানুষ?’ লক্ষ করার বিষয় তখন সে ‘আব্বাজান’ বলে না। ঘৃণা আর সম্মানের এটাই তফাত। সালমানের মা রেহানা জলিরও রক্ষা হয় না রাজিবের হাতে। নিম্নশ্রেণির উত্থানেই রাজিবের পতন ঘটে গণপিটুনিতে।
সালমান শাহ-র ফ্যাশনেবল কস্টিউম ছবির স্ট্রং পার্ট। মাথায় ব্যান্ডেনা, গামছা (রাখাল যে লুকে বাঁশি বাজায়), রাজকীয় গোঁফসহ এন্ট্রি সিনে ভারিক্কি লুকে আনকমন লাগে। সালমানের অন্য অনেক ছবির মতো এ ছবিতেও স্পেশালি তার নাম শেষে দেখায়। সালমান যে বিশেষ কিছু ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে এটা প্রমাণিত। সালমান-শাবনূর অসাধারণ অভিনয় আর জুটিপ্রথায় অন্যতম সেরা কাজ এ ছবি।
কমেডি পার্টে দিলদার-নাসরিন অসাধারণ। দিলদার নাসরিনের গৃহশিক্ষক হয়ে যায় নাসরিনদের বাড়িতে। পড়াতে গিয়ে ধরা পড়ার ঘটনা ঘটে। গরুছাগলের থাকার ঘরে আশ্রয় নিলে পেশাব করে দেয় দিলদারের গায়ে তখন দিলদারের সংলাপ ছিল-’বৃষ্টি আসার আর সময় পাইল না’..😃
রোমান্টিক ও স্যাড পার্টে ছবির দুটি গান উল্লেখযোগ্য। ‘বৃষ্টি রে বৃষ্টি আয় না জোরে’ এ গান সারা ঢালিউডে একটাই আছে। বৃষ্টির গানের মধ্যে প্রথমেই থাকবে। সালমান-শাবনূর রোমান্সে মাস্টারপিস গানটি। ‘তুমি আমার মনের মানুষ’ স্যাড ভার্সনে অসাধারণ।
কেউ যদি ‘স্বপ্নের পৃথিবী’কে রোমান্টিক ছবি বলে তবে খুব হালকা মেজাজের কথা হয়ে যাবে। এটি রাজনৈতিক ছবি এবং রাষ্ট্রচিন্তার গভীর দর্শনে নির্মিত। আজকের বৈরী বিশ্বে দেশে দেশে যখন শাসন, শোষণ, প্রতিবাদ এসব ঘটনা ঘটতে দেখি তখনই এ ছবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রত্যেক নিপীড়িত জাতিই চায় তাদের জন্য রাষ্ট্র যেন হয়ে ওঠে স্বপ্নের পৃথিবী।