Select Page

রূপসী বাংলার আবহমান ‘সাঁতাও’

রূপসী বাংলার আবহমান ‘সাঁতাও’

রূপসী বাংলার আবহমান এক ছবি ‘সাঁতাও‘। গ্রামের ছবি এখন যে হারে কমতে শুরু করেছে সেখানে এ ধরনের নিখুঁত গ্রামীণ জীবনের উপস্থাপন প্রশংসনীয়।

খন্দকার সুমন নির্মিত ছবি ‘সাঁতাও’। ট্যাগলাইন ‘memories of the gloomy monsoons’.

উত্তরাঞ্চলে ঝড়কে ‘সাঁতাও’ বলে। ছোটবেলায় মা, বাবা, ফুপুদের মুখে শুনতাম বলত ‘সাঁতাও আসছে’।

ছবির বড় একটা অংশ জুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং গৃহপালিত প্রাণীর প্রতি মাতৃমমতা প্রধানভাবে উঠে এসেছে। ফসল ফলানোর জন্য ত্যাগ, পরিশ্রম আর প্রাপ্তির আনন্দে  সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম যা কখনো শেষ হয় না।

‘সাঁতাও’ বা ঝড়ের সাথে বন্যার দৃশ্যায়ন ছবিতে গ্রাম-বাংলার জীবন সংগ্রামকে তুলে ধরেছে। পানির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা, ফসল হারানো, গবাদিপশুর অসহায়ত্ব, ত্রাণের জন্য অপেক্ষা এগুলো ছবিতে ডিটেইল এসেছে। পরিচালক বেশ সচেতনভাবেই দেখিয়েছেন।

– ও দুলাভাই, হারা কিন্তু গেট ধরছি

– কি দিতে হবে

– একদাম পাঁচ হাজার টাকা নাগিবে না হইল গেট ছাইড়বার নাই

আমাদের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে বিয়েবাড়ির গেট ধরার সময় এরকম কথাই হয়। অন্য অঞ্চলেও এটা থাকতে পারে। আঞ্চলিক বিষয়গুলো এভাবেই দর্শক রিলেট করতে পারে যেমন করাতে পেরেছে ‘সাঁতাও’।

রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের ডায়ালেক্টে ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন শব্দ যার মধ্যে আছে – ‘মুই’ (আমি), হারা (আমরা), ‘ভোক’ (ক্ষুধা), অ্যালাও (এখনও), অ্যাটে (এখানে), সৌগ (সব), নাকান (মতো), এইপোকে (এদিকে), আন্দা (রান্না), ভুঁই (জমি), কাশিয়া (কাশফুল),

সংলাপ খুবই হৃদয়গ্রাহী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ তার গৃহপালিত গরুর কাছে গিয়ে বলে-‘তোমরাই ভালো। পোয়াতি হইলেও বমি করা লাগে না, হামার করা লাগে। আইজ থাইকা হারা দুই পোয়াতি সুখী।’ তাকে দেখিয়ে গৃহবধূ আরো বলে-‘সাত মাসের পোয়াতি হইলে বাপের বাড়ি থাইকা সাধের ভাত আসে তোর তো নাই।’ বলার পর নিজের জন্য আসা সাধের ভাত খেতে দেয় গরুটিকে। এটা মন ভালো করে দেওয়া দৃশ্য ছিল। এছাড়া গৃহপালিত প্রাণীর প্রতি মাতৃহৃদয়ের মমতাও দেখার মতো ছিল। লালু নামের গরুটি যেন নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে ছবিতে।

ওকি হায় রে হায়

মনটায় মোর পিটা খাবার চায়

কয় স্যার আলো চাল বাইনা

কাইল বিয়ানে বানেয়া দ্যান মোক

কয়টা পিটা

এ গানের সুর, গায়কী আর অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় মন কেড়ে নেয়।

বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরার উৎসব ছবির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আঞ্চলিক নৃত্যের ব্যবহার চমৎকার ছবিতে। প্রতিদিনের সংগ্রামী জীবনযাপনের পর একটু চিত্তবিনোদনের জন্য নৃত্যগীতে মজে যাওয়া সংসারের দুজন মানুষ।

ছবির সিনেমাটোগ্রাফি খুবই চমৎকার। জলের ভেতর মাছের চলাচল, নদীতীরে ভেসে থাকা সারি সারি নৌকা, বর্ষামৌসুমে মাছ ধরা, নদীর ড্রোন শট, মুষলধারে বৃষ্টির দৃশ্য দেখার মতো ছিল।

প্রধান দুই চরিত্রে ফজলুল হক ও আইনুন পুতুল ন্যাচারাল অভিনয় করেছে। ফজলুল হক তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ ছবি দিয়ে পরিচিত মুখ। তার অভিনয়ের গুণ এ ছবিতে ভালোভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। আইনুন পুতুলের চরিত্রে ভালো অভিনয়ের সাথে কিউটনেসও যোগ হয়েছে। তার কথা বলার মধ্যেও মায়া আছে। চরিত্রায়ণে আইনুন পুতুলের চরিত্রটি এগিয়ে থাকবে ভিন্নধর্মী মায়ের মমতার উপস্থাপনে। অন্যান্য চরিত্রের অভিনয়শিল্পীরাও ভালো ছিল।

‘সাঁতাও’ সব মিলিয়ে আমাদের আবহমান গ্রামীণ জীবন ও মানুষের যথার্থ উপস্থাপন। নির্মাতা খন্দকার সুমন এ ছবির মতো আরো মানসম্মত কাজ উপহার দেওয়ার সক্ষমতা রাখবে এ প্রত্যাশা করা যায়।

আপাতত এ বছরের প্রথম সেরা ছবি এটাই।

রেটিং – ৮/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন