Select Page

সম্পর্ক ও শিল্পের দ্বন্দ্বে হাহাকার ‘গহীনের গান’

সম্পর্ক ও শিল্পের দ্বন্দ্বে হাহাকার ‘গহীনের গান’

গহীনের গান’ দেখতে গিয়ে মনে হবে সংলাপগুলো সব মুখস্ত করে ফেলি। প্রচুর ভাবাবেগ, মায়া আর বাস্তবতা জড়ানো সিনেমার প্রতিটি সংলাপ। আসিফ আকবরের ৯টি আলাদা গানকে এক সুতোই বাঁধতে সক্ষম হয়েছে সিনেমাটির গল্প।

না, সিনেমা দেখতে গিয়ে একবারও মনে হবে না একী এত গান কেন! তার চেয়ে বরং গানগুলোকে বড়ই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। গল্পের আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে গানগুলো। মানুষের জীবন জুড়ে প্রতিদিন এত এত গল্প তৈরি হয়। আর এই গল্পদের বুনে চলে কোনো শিল্পী। সুরের জাদু মিশিয়ে জীবনের গল্প ফেরি করেন তিনি। একজন মানুষের অনুভব করা গল্পটা ছড়িয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। গল্পটা আর একজনের হয়ে থাকে না, কোটি কোটি মানুষের গল্প হয়ে যায়।

দেখার ভঙ্গির উপর নির্ভর করে সবকিছু। ছবিতে আসিফ আকবর ও তানজিকা আমিনের রসায়নের কথা ধরা যাক। একই ঘরের মধ্যে থেকেই যাদের মাঝে যোজন যোজন দূরুত্ব। যার একটিই মাত্র কারণ একে অপরকে সঠিকভাবে না বোঝা।

সবচেয়ে বড় হয়ে ধরা দেয় আসিফের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তানজিকা আমিনের একটি প্রশ্ন, ‘তুমি তোমার গানকে বেশি ভালোবাসো, নাকি আমাকে?’ আসিফের উত্তর, ‘গান আমার জীবন, তুমি একটা গল্প। গল্প ছাড়া গান হয় না।’ তবুও কোথাও একটা ফাঁক থেকে যায়। যেই কারণে আর প্রিয় মানুষটিকে ধরে রাখা সম্ভব হয় না।

এই সিনেমায় খুব বড় একটি চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন হাসান ইমাম। বৃদ্ধ বয়সে তার একা থাকার গল্পটা নাড়িয়ে দেয় মন। সেই কবে স্ত্রী তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। অনেক কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের বড় করে তোলার পর বাবাকে ফেলে এখন তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এই বুড়ো মানুষটি এক সময় চিত্রশিল্পী ছিলেন।

এই চিত্রশিল্পীর জীবনের কোনো কোনো অংশের সঙ্গে মিলে যায় সিনেমার নায়ক কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের গল্প। এই মানুষটির স্ত্রীও তার কাছে সেই একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন ‘তুমি তোমার ছবি ভালোবাসো নাকি আমাকে?’

একজন শিল্পী তার কাজকে এতটাই ভালোবাসেন সবচেয়ে কাছের মানুষটিও কনফিউশানে পড়ে যায় তার কাছে নিজের অস্থিত্ব নিয়ে। ভাবতে থাকেন এই বুঝি শিল্পীর জীবনে সে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লো। অথচ সব গল্পের মূলে হয়তো তিনিই মিশে আছেন। শেষে ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে দেয় ভালোবাসার ঘর।

সিনেমাটির একটি বড় বাঁক জুড়ে আছে আমান রেজা ও তমা মির্জা। ভালোবাসার বন্ধন আর অপ্রাপ্তির গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন তারা। না পাওয়ার এই গল্প কাঁদিয়ে ছেড়েছে দর্শকদের।

সাদাত হোসাইনের পরিচালনায় মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘গহীনের গান’। সিনেমাটির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি নিজেই। ছবির মূল অস্ত্র গান হলেও এগিয়ে গেছে সংলাপগুলো। কয়েকটি সংলাপের কথা বলা যেতে পারে যেগুলো প্রায় প্রতিদিনই বুকের গহীনে বয়ে বেড়াই আমরা।

তানজিকার একটি সংলাপ এমন, ‘আমরা সবাই ভালো, অনুভব করতে পারি না অথবা চাই না।’ হাসান ইমামের সংলাপ, ‘কারো কী কেউ থাকে?, থাকে না। মানুষ নিজেই কেবল নিজের থাকে।’ তমা মির্জার সংলাপটি এমন, ‘জগতের সব গল্প তো একই, ভালোবাসা আর ঘৃণার গল্প।’ আসিফ আকবরের একটি সংলাপের সারমর্ম, দায়িত্ব বেড়ে যাবে বলে কাছের মানুষদের মন থেকে জানতে চায় না মানুষ।

এই সংলাপগুলো হৃদয় ছুঁয়েছে। তাই গল্প ও সংলাপের জন্য সাহিত্যিক সাদাত হোসাইনকে দশে দশই দিতে হয়। আর চলচ্চিত্র নির্মাণে এসে সাদাত একটু ধীরগতির গল্প বলার দুর্বলতায় দশে ৬ পাবেন।

অভিনয়ের দিকে ফেরা যাক। এই প্রথমবার বড়পর্দায় নায়ক হলেন আসিফ আকবর। একজন পরিপক্ষ অভিনেতাই মনে হয়েছে তাকে। প্রথবমার চচ্চিত্রের ক্যামেরার আসিফ এতটা সরসভাবে ধরা দেবেন ভাবেতে পারেননি অনেকেই। তার অভিনয়, সিনেমার গানগুলোর মতোই সুন্দর। কিন্তু আসিফের মেকাপ নিয়ে অনেক দর্শকই প্রশ্ন তুলেছেন। ন্যাচারাল অভিনয়ের আসিফ উতরে গেলেও তাকে উপস্থাপনের কিছুটা ঘাটতি চোখে পড়েছে।

তানজিকা আমিন বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। যদিও ভারী সাজগোজের আড়ালে তাকে সহজাত মনে হয়নি অনেক সময়। আর হাসান ইমাম চমকে দিয়েছেন অভিনয় করে। তার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যটি মনে রাখার মতই। এছাড়া হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে কাচের জগ, গ্লাস ভেঙে ফেলার দৃশ্যটিও মনে দাগ কেটে যায়।

আমান রেজাও নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যেটুকু জায়গা পেয়েছেন তার মধ্য থেকেই। তবে তমার অভিনয়ের প্রশংসা আলাদা করে না করাটা হবে এড়িয়ে যাওয়ার অন্যায়। তমা ছবিটিকে টুইস্ট দিয়েছেন, শক্ত হাতে হাল ধরেছেন ‘গহীনের গান’র। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী এই অভিনেত্রী নিজের চরিত্রটি নিয়ে খেটেছেন তার ছাপ অভিনয়ে স্পষ্ট। তমার কিছু কিছু এক্সপ্রেশন সংলাপ ছাড়াই অনেক অর্থবহুল হয়ে উঠেছে।

এছাড়া হাসান ইমামের যুবক বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কাজী আফিস ও তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুলনা আল হারুন। তাদের অভিনয়ও ছিলো দারুণ।
সিনেমায় আসিফের গাওয়া প্রতিটি গানই হৃদয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। কয়েকটি গানের অংশ এমন- ‘তোর জন্য কান্না পাচ্ছে খুব, তোর জন্যই কান্না চেপে রাখা, আমার অশ্রু ভাসায় যদি তোকে, তাই তো এমন অশ্রু চেপে থাক’ কিংবা ‘আমি তোমার জন্য বাঁচি, আমি তোমার জন্য মরি, সে তো নতুন কিছু নয়, আমি তোমায় চাইতে পারি’, ‘ও বাবা আমার হাতটা একটু ধর, বুড়ো মানুষ গায়ে ভীষণ জ্বর’, ‘এমনও বরষা তারে পড়ে মনে, দিন কাটে তাহার স্মরণে’।

বাংলাঢোল প্রযোজিত এই সিনেমাটি ব্যাপ্তি পৌনে দুই ঘণ্টা। ছবির শক্তিশালী দিকটি সিনেমাটোগ্রাফি। সিনেমার কোনো কোনো কোনো চিত্রকল্প গভীর কোনো কবিতার মতো। বিদ্রোহী দীপন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ক্যামেরা হাতে।

পুুরো ছবির আবহসংগীত ছিলো বেশ প্রশংসনীয়। আবহসংগীত দিয়ে এক অন্যজগতে নিয়ে চলে যান রেজাউল করিম লিমন। লিমন রোজারিও বেশ ভালোই করেছেন সম্পাদনার কাজটি। ছবিটির কালার গ্রেডিং এর মান বেশ উন্নত ছিল। ছবির লোকেশনগুলো বেশ নান্দনিক, কস্টিউম ডিজাইন ছিলো বেশ সাবলীল।

ছবির ৯টি গানের বেশির ভাগই লিখেছেন, সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন তরুণ মুন্সী। দুটি গান লিখেছেন রাজীব আহমেদ আর একটি লিখেছেন পরিচালক নিজে। ‘বন্ধু তোর খবর কি রে’ গানটির সুর করেছেন পল্লব স্যানাল ও সংগীত পরিচালনা করেছেন পার্থ মজুমদার। গানের কথা সুর ও সংগীতে মিলেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া।

এক নজরে
সিনেমামার নাম : গহীনের গান
ধরন : মিউজিক্যাল রোম্যান্টিক ড্রামা
কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: সাদাত হোসাইন
প্রযোজনা: বাংলাঢোল
অভিনয়: আসিফ আকবর, তানজিকা আমিন, সৈয়দ হাসান ইমাম, তমা মির্জা, আমান রেজা, কাজী আসিফ রহমান, তুলনা আল হারুন প্রমুখ।
শুভমুক্তি: ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯


মন্তব্য করুন