Select Page

সারেন্ডার: কর্ম ব্যক্তিকে একদিন উপার্জিত গন্তব্যে নিয়ে যাবেই

সারেন্ডার: কর্ম ব্যক্তিকে একদিন উপার্জিত গন্তব্যে নিয়ে যাবেই

সারেন্ডার’ ছবির শিক্ষামুলক গল্প শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই এই লেখা

শনিবার, ২৫ এপ্রিল ১৯৮৭। সেদিন ছিল চট্টগ্রাম লালদিঘীর ময়দানে ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় ‘জব্বইজ্যার বলিখেলা’। সেদিন বিকেল তিনটার শো-তে আমি লায়ন সিনেমায় ‘সারেন্ডার’ দেখি।

জহিরুল হক বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন ছবি ‘রংবাজ’-এর পরিচালক। দুর্ধর্ষ খলনায়ক জসিম আশি দশক থেকে অ্যাকশন নায়ক হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আর জহিরুল হক-জসিম যদি একসাথ হয় তাহলে বুঝতে হবে জমজমাট অ্যাকশন ছবি। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ বা বোন হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে কাহিনী হবে এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ছবি দেখে সারপ্রাইজড! সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্পের ছবি।

‘সারেন্ডার’ ছবির শিক্ষামুলক গল্প শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না, তাই এই লেখা।

জসিম মেধাবী ছাত্র। সদ্য এমএ পাস করেছে। চাকরির জন্য অফিসে অফিসে ঘুরছে। ঘরে অসুস্থ্ মা। বাবা মৃত। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। মাসের পর মাস ঘরভাড়া বাকি। বকেয়ার জন্য বাড়িওয়ালা প্রতিদিন তাগাদা দিতে থাকে। জসিম টুকটাক গৃহশিক্ষকতা করে চলছে।

ক্লাসমেট শাবানার সাথে জসিমের প্রেম ছিল। শাবানা বলে জসিম যেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। জসিম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে শাবানার বাবা অপমানজনক ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। জসিম শাবানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে। আসার সময় বলে, জীবনে যদি কোনদিন তোমার উপকার করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

বিনাচিকিৎসায় মা মারা যায়। কাফনের কাপড় কেনারও পয়সা ছিল না জসিমের। মায়ের মৃত্যুর পর জসিম নিজেকে বদলে ফেলে। অসৎ পথ অবলম্বন করে।

বাবর, মিজু, মাহবুব, নান্টু এ চারজন জসিমের ক্লাসমেট ও বন্ধু। তারাও অভাব ও বেকারত্বের কারণে অসৎ পথে ছিল। জসিম তাদের নিয়ে একটি গ্যাং তৈরি করে।

জসিমের বিশেষত্ব হলো, সে যেকোন তালা খুলতে পারতো। এমনকি আধুনিক নাম্বারিং তালাও। যা পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলতে হয়। জসিমের নেতৃত্ব একের পর এক ডাকাতি করতে থাকে গ্যাং। জসিম বিনা পাসওয়ার্ডে তালা খুলতে থাকে।

একবার ডাকাতি করতে গিয়ে তাদের হাতে তিনজন খুন হয়। বাবা, মেয়ে ও মেয়ের প্রেমিক। তখন পুলিশ তাদের ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রিণ্টমিডিয়া তোলপাড় হয়ে যায় তাদের চাঞ্চল্যকর ডাকাতির খবরে।

তখন জসিমের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। জসিম সঙ্গীদের বলে আর ডাকাতি করবে না। যা টাকা ডাকাতি করে জমানো হয়েছে। তা দিয়ে ব্যবসা করবে। কিন্তু চার সঙ্গী আরেকবার ডাকাতি করতে চায়। শেষবার, তারপর আর নয় ভালো হয়ে যাবে।

জসিম সঙ্গীদের কথায় রাজি হয়। একটি গোডাউন ডাকাতি করার সময় জসিম যখন নাম্বারিং তালা বিনা পাসওয়ার্ড খুলছিল তখন সাইরেন বেজে ওঠে। গোডাউন কেয়ারটেকার পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে বাবর, মিজু, মাহবুব মারা যায়। জসিম ও নান্টু পালায়। তারপর নান্টু আর জসিম অসৎপথ ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। নান্টু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

এক সময়ের কুখ্যাত ডাকাত জসিম শহরের ধনী ব্যবসায়ী হয়। কেউ জসিমের অতীত সম্পর্কে জানে না। একটি পানির জাহাজ কিনতে গিয়ে বুলবুল আহমেদের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় জসিমের। বুলবুল আহমেদের বাড়িতে যেয়ে দেখে সাবেক প্রেমিকা শাবানা বুলবুল আহমেদের স্ত্রী। বুলবুল-শাবানার শিশুপুত্রের সাথে জসিমের খুব ভাব হয়। জসিম শাবানার পুত্রকে খুব ভালোবাসতো।

একদিন শাবানা ব্যাংকের লকার থেকে স্বর্ণালংকার আনতে গিয়ে শাবানার শিশুপুত্র লকারে আটকা পড়ে। লকারের মূল গেইটে নাম্বারিং আধুনিক তালা। যার পাসওয়ার্ড শুধু ম্যানেজার জানে। ম্যানেজার ঐ মূহূর্তে ব্যাংকক যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে আসে। জসিম বিমানবন্দরে এসে দেখে ব্যাংককের ফ্লাইট আকাশে ওড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বলে গেইট ভাঙতে সময় লাগবে। কিন্তু ভিতরে অক্সিজেন শূন্যের কোটায়। বাচ্চা যে কোনো সময় মারা যাবে।

অবশেষে জসিম বিনা পাসওয়ার্ডে তালা খুলতে যায়। জসিম জানতো তালা খোলার সাথে সাথে জসিমের অতীত সামনে আসবে। জসিম গ্রেফতার হবে। তবুও খুলতে যায় কারণ শাবানার শিশুপুত্র মারা যাবে তা জসিম চায় না। শাবানাকে একদিন বলেছিল সুযোগ পেলে শাবানার উপকার করবে।

জসিম তালা খুলে শিশুপুত্র উদ্ধার করলো। পুলিশ জসিমকে গ্রেফতার করতে এলো। জসিম অতীতের অপরাধ স্বীকার করে সারেন্ডার করলো নিজেকে।

ছবি শেষে আমি কৈশোর বয়সে থমকে গিয়েছিলাম। ছবির কাহিনী নায়ক জসিমের। তার চরিত্র আমার ভাবনায় আসতো। ভাবাতো।

এই ছবির শিক্ষামুলক দিকগুলো, সমাজের প্রতি গল্পের ম্যাসেজ আমাকে ভাবাতো। এইবার আমার ভাবনাগুলো বলি।

জসিম ও ওর বন্ধুরা অভাব আর বেকারত্বের কারণে অসৎ পথে আসে। ছবিতে যদিও নাটকীয়তা আছে তবে বিষয়টি মিথ্যে নয়। এটা আমাদের সমাজের বাস্তবরূপ। অভাব আর বেকারত্বের কারণে যুবসমাজ অসৎ পথ অবলম্বন করার হাজার হাজার ঘটনা আছে।

আমাদের সমাজে যোগ্যরা সহজে চাকরি পায় না। অযোগ্যরা বড়বড় পদে বসে। স্বজনপ্রীতি আর ঘুষ বাণিজ্যের কাছে যোগ্য যুবকরা পরাজিত হয় হতাশায় মাদকাসক্তি হয় বা অসৎ পথের পথিক হয়। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

গ্যাং দ্বারা তিনটি খুন হলে শহরে ঘটনাটি আলোচিত হয়। পুলিশ তৎপর হয়। তখন জসিমের শুভবুদ্ধি হয়। জসিম চায় না আর ডাকাতি করতে। কিন্তু অতিলোভী চার বন্ধু আরেকবার করতে চায়। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তিন সঙ্গী মারা যায়।

যদি জসিমের শুভবুদ্ধির সাথে তারাও একমত হতো তাহলে এমন পরিণাম হতো না। আমরা যখন অপরাধ করতে থাকি। তখন আমাদের বিবেক বা আমাদের সঙ্গীর বিবেকে শুভবুদ্ধির উদয় হয় যা প্রভূ আমাদের সতর্ক করে, ভালো হওয়ার সুযোগ দেয়। আমরা অনেকেই সেই শুভবুদ্ধির সম্মান করি না। যার ফলে আমরা পাপিষ্ঠ হিসেবে চরম পরিণাম ভোগ করি।

জসিম নিজের অপরাধের অতীত লুকিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সাবেক প্রেমিকার শিশুপুত্রের উসিলায় জসিমের অতীত প্রকাশ পায়। আমাদের সমাজে এমন অনেক আছে যারা অতীত ও বর্তমান লুকিয়ে সাধু সেজে আছে। তাদের অতীত বা লুকানো বর্তমান একদিন কোনো না কোনো উসিলায় প্রকাশ পায়। আর যদিও না পায় শেষ বিচারের দিন প্রকাশ পাবে।

সবচেয়ে যে বিষয় আমাকে ভাবায়– জসিম প্রেমে ব্যর্থ হয়েও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়নি। যখন শাবানার কাছ থেকে বিদায় নেয় তখন বলেছিল, যদি কোনোদিন তোমার উপকার করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করবে। জসিম কথা রেখেছে। নিজের জীবনবাজী রেখে শাবানার উপকার করে। এরই নাম ভালোবাসা। যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে প্রেমিক বা প্রেমিকার ক্ষতিসাধন করে তা কিন্তু ভালোবাসা নয়।

ব্যক্তির কর্মফল ব্যক্তিকে একদিন তার উপার্জিত গন্তব্যে নিয়ে যাবেই! যদি এই দুনিয়াতে না হয় তাহলে অবশ্যই সেই দুনিয়াতে হবেই। তাই আসুন আমরা ভালো কাজ করতে না পারি কিন্তু মন্দ কাজ যেন না করি।

সোমবার, ১৩ জুলাই ২০২০


About The Author

আকবর খসরু

চলচ্চিত্রপ্রেমী ও লেখক

Leave a reply