![অনুদান পাওয়ার সাত বছর পর মুক্তি পাচ্ছে ‘আজব কারখানা’](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2024/06/ajob_karkhana1_bmdb_image.jpg?resize=150%2C150&ssl=1)
সালতামামি ১৯৮৩ : ভিডিও ক্যাসেট থেকে ‘নকল সিনেমা’ ছিল আলোচনায়
সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৯৮৪ সালের শুরুতে চলচ্চিত্র নিয়ে বিশেষ অ্যালবাম প্রকাশ করে। যেখানে সামগ্রিকভাবে ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের নানান বিষয় ও সামগ্রিক অবস্থা উঠে আসে। এ বছর ৪৪টি সিনেমা মুক্তি পায়। বলা হয়ে থাকে, ‘অধিকাংশ ছবি বিষয় এবং আঙ্গিকে নিম্নমানের’। অবশ্য বাণিজ্যিক সিনেমা নিয়ে বরাবরই নাকউঁচু ভাব ছিল সাময়িকীটির।
![](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2023/10/bangla_movie_1983_bmdb_image.jpg?resize=1024%2C576&ssl=1)
কোলাজ: ১৯৮৩ সালের আলোচিত দুই সিনেমা নাজমা ও লাইলী মজনুর দৃশ্য
ওই বছর চলচ্চিত্রের কোন্দলও উঠে আসে। বলা হয়, এ বছর চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের যথারীতি ব্যবসায়িক কোন্দল চরমে পৌঁছালে এফডিসি তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানকে এভাবে আর কখনো বেসরকারী সেক্টরে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।
১৯৮৩ সালে রঙিন ছবি নির্মিত হয়েছে ছয়টি। তবে এসব ছবি আন্তজাতিক বাজারের উপযোগী নয় বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। এছাড়া বাংলা- দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন কোনো ছবিও এ বছর মুক্তি
চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীদের মতে, ১৯৮৩ সালের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছিল সুভাষ দত্ত পরিচালিত সামাজিক ধারার ছবি ‘নাজমা’। এরপর আছে এ জে মিন্টু পরিচালিত নারী প্রধান ও অ্যাকশনধর্মী ‘মান-সম্মান’। দুই ছবিতেই অভিনয় করেছেন রাজ্জাক ও শাবানা। প্রথম ছবিটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ সেন্টিমেন্ট। তৃতীয় ব্যবসাসফল ছবি হচ্ছে ‘গাদ্দার’। কাহিনী একেবারে ছকে বাঁধা তবে অধ্যায়ে অধ্যায়ে ছিল মারপিটের সমারোহ। পিতা-পুত্রের মান অভিমান নিয়ে ভারতে নির্মিত হয়েছে শক্তি। এ ছবির কাহিনীও তাই।
১৯৮৩ সালে তুলনামূলকভাবে ভালো ব্যবসা করেছে সামাজিক ছবি। তবে নির্মাণে মুনশিয়ানা ও চমক সৃষ্টির প্রচেষ্টা দেখা গেছে এ জে মিন্টুর ‘চ্যালেঞ্জ’ ও দেওয়ান নজরুলের ‘জনি’ ছবিতে। এ বছর অ্যাকশন-পোশাকী ছবি ছিল ১৬টি। ৪টি ছবি সুপারহিট ব্যবসা করেছে— লাইলী মজন, মান-সম্মান, আবে হায়াত ও গাদ্দার। এছাড়া ১০টি ছবি ভালো ব্যবসা করেছে— টক্কর, ইজ্জত, প্রতিহিংসা, গলি থেকে রাজপথ, বানজারান, নাগপূর্ণিমা, শাহীচোর, নাগরানী ও তিন বাহাদুর [তালিকায় আরেকটি ছবির নাম নেই]। ‘সিকান্দার’ মোটামুটি ব্যবসা করেছে।
![](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2018/04/maan-samman.jpg?resize=720%2C567&ssl=1)
২৮টি সামাজিক ছবির মধ্যে ‘নাজমা’র কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর সঙ্গে সুপারহিট তালিকায় আছে ‘বদনাম’ ও ‘লালুভুলু’। এরপরে ভালো ব্যবসা করেছে আকবর কালো গোলাপ, প্রাণ সজনী, ধনদৌলত, আশীর্বাদ, বড় মা, আঁখি মিলন, অন্ধবধূ ও ঘরের বউ। মোটামুটি ব্যবসা করেছে নতুন বউ, সাত রাজার ধন, ঝুমুর, চেনামুখ, প্রেমবন্ধন, মেহমান, অপমান, প্রেমনগর, ফেরারী বসন্ত, হাসু আমার হাসু, আরশীনগর, আশা, পুরস্কার ও সময় কথা বলে। ফ্লপ করেছে মেঘ বিজলী বাদল ও বাসর ঘর।
অভিযোগ আকারে বলা হয়, ১৯৮৩ সালে বিনোদনের নামে প্রায় সব ছবিতেই ‘সেক্স ও ডায়োলেন্স’ এসেছে। ‘সেক্স আনতে গিয়ে পরিচালকরা আশ্রয় নিয়েছেন অশ্লীলতার। বিশেষভাবে ঝাঁকি নৃত্য সংযোজনের মাধ্যমে। প্রায় ১৫ বছর আগে এক চিত্রসাংবাদিক ছবি সেটে গিয়েছিলেন শুটিং দেখতে। নায়িকা নাচছে। কিন্তু নায়িকার অঙ্গভঙ্গি দেখে পরিচালক কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তিনি বুক দেখিয়ে বললেন ম্যাডাম একটা ঝাঁকিয়ে নাচুন। এই ধারা এখনে অব্যাহত রয়েছে। ঝাঁকি নৃত্যের কবল থেকে চলচ্চিত্রের বিনোদন এখনো মুক্ত হতে পারেনি। জীবনের অংশ হিসেবেই চলচ্চিত্রে সেক্স আসবে: আসবে প্রেমিক-প্রেমিকার সোহাগে বা স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতায়। কিন্তু আমাদের নির্মাতাদের হাতে সেক্স হয়ে ওঠে কদর্য। আর কারণে-অকারণে ভায়োলেন্স সমাজের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে’।
এ বছর কিছু জনপ্রিয় গান পাওয়া গেছে ‘ঢাকায় নির্মিত প্রায় প্রতিটি ছবিতেই ৫-৬টি কবে গান থাকে। ছবির কাহিনী বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গান ব্যবহার হয় না। ছবিতে গান রাখতে হবে এই মানসিকতা থেকেই গান রাখা হয়। গানের জন্যে মাঝে মাঝে ছবি জনপ্রিয় হয়। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে কেবল গানের জন্যেই জহিরুল হক পরিচালিত প্রাণ সজনী হিট করেছে। আবেহারাত ছবি চাকবুম চাকবুম গানটির চিত্রায়ন দেখার জন্যেও অনেক দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গেছেন বারবার’।
এ বছর আলোচনায় ছিল নকল কাহিনী। যাকে ভিডিও ক্যাসেটের প্রার্দুভার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। “১৯৮৩ সালে যদি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বা চিত্রনাট্যকারের শিরোপা দিতে হয়, সেটা হবে ভিডিও ক্যাসেট। এ বছরের প্রভাবশালী ‘কাহিনী ঠিকাদার’ দেলোয়ার জাহান ঝন্টুও এই যন্ত্রটির কাছে কৃতজ্ঞ। ঢাকায় নির্মিত প্রায় প্রতিটি ছবির রসদই সংগৃহীত হয়েছে ভিডিও ক্যাসেট থেকে। এ কথাটি নির্মাতারাই স্বীকার করেছেন। ভিডিও ক্যাসেট থেকে কিছু মানুষ কাগজে লিপিবদ্ধ করেছে ক্যাসেটের ঘটনাবলী। ফিল্মম্যানদের ভাষায় এরাই হচ্ছেন পেশাদার কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার। এদের মধ্যে রয়েছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, শাহেদুর রহমান কুটু, অধ্যাপক শাহেদুর রহমান, মো. রফিকুজ্জামান, আল মাসুদ প্রমুখ। এই ক্ষেত্রে সৈয়দ শামসুল হক ও আহমেদ জামান চৌধুরীর নামও উল্লেখ করেছেন অনেকে”।
![](https://i0.wp.com/bmdb.co/wp-content/uploads/2023/10/laili_majnu_bmdb_image.jpg?resize=639%2C820&ssl=1)
লাইলী মজনু সিনেমার আরেকটি দৃশ্য
“১৯৮৩ সালে ৫টি ছবির কাহিনী পুস্তক থেকে নেয়া হয়েছে। শুরুতে নাম করতে হয় পরিচালক কামাল আহমদের। তিনি ভারতের বাংলা ঔপন্যাসিক ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘লালুভুলু’র চিত্রায়ন করেন। ছোট গল্পকার শহীদ আখন্দের ‘একই ঘরে এক ঘরে’ নিয়ে জহিরুল হক তৈরি করেন ‘প্রাণ সজনী’। পারসিয়ান লোকগাথার কাহিনী নিয়ে তৈরি ইবনে মিজানের ‘লাইলী মজনু’ এ বছর মুক্তি পায়। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’র ছায়া অবলম্বনে ‘মান সম্মান’ ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেন সৈয়দ শামসুল হক। এছাড়া ইংরেজি লোকগাঁথা ‘দি ওয়ার উলভ’-এর চিত্ররূপ বলা হয়েছে ‘নাগপূর্ণিমা’ ছবিকে। ছবির চিত্রনাট্যকার শাহেদুর রহমান কুটু। তবে এ ছবিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, এটি ভারতীয় ‘জীনে কা আরজু’ ছবির নকল। ‘নাজমা’র কাহিনী নেয়া হয়েছে ‘সাত পাকে বাঁধা’ নামের ভারতীয় উপন্যাস থেকে। তবে কাহিনীকার হিসেবে নাম দেয়া হয় দেলোযার জাহান ঝন্টুর”।
এ বছর অভিযোগ উঠে সুস্থধারার নির্মাতারা যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছেন না। বলা হয়, “মননশীল নির্মাতাদের মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক সিনেমার একটা ধারা ৮০র দশকের শুরুতে দেখা যায়। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের কর্মী এবং চলচ্চিত্রে পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ সাওয়া কর্মীর চেষ্টায় নির্মিত হয় সূর্য দীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, ঘুড্ডি, মেঘের অনেক রং। কিন্তু পরে এসব ছবির নির্মাতারা আর ছবি বানাতে পারেননি। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র দুই পরিচালকের একজন শেখ নিয়ামত আলী ১৯৮৩ সালে অনুদানের অর্থে ‘দহন’ নামে একটি ছবির কাজ করেছেন। বাদল রহমান ‘নায়করাজ’ নামে একটি ছবির ঘোষণা দেয়ার পর ব্যস্ত রয়েছেন বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণের কাজে। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী তার সৃজনশীল সত্তাকে এখন কাজে লাগাচ্ছেন চলচিত্র উন্নয়ন সংহার নীতিনির্ধারণে। হারুনর রশীদ ‘অসতী’ নামের একটি ছবির ঘোষণা দিয়ে প্রযোজকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছেন। অনুদানের জন্যে চেষ্টা করেও তেমন সুবিধে করতে পারেননি।”
আরো বলা হয়, “সুভাষ দত্ত সততার সঙ্গে তৈরি করেছিলেন বসুন্ধরা ও ডুমুরের ফল। পরের ছবিটিকে করমুক্ত করার জন্যে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার ধর্না দিয়েও ব্যর্থ হন। এখন প্রতি বছর একটি করে হিট ছবি দিয়ে যাচ্ছেন। আমজাদ হোসেন এ বছর কোনো ছবি মুক্তি দিতে পারেননি। এই ধারার একমাত্র আলমগীর কবির এগিয়ে যাচ্ছেন একা। যদিও তার অস্তিত্বও বিপন্ন প্রায়। ছবি নির্মাণ এবং বেটার সিনেমা ফোরাম গঠন ও ‘সিকোয়েন্স’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি সংগ্রাম করছেন। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দীনও উধাও হয়েছেন। ভালো ছবির নির্মাতাদের কাছে কোনো ভরসাই এখন নেই।”