Select Page

সিনেমার গল্প : মাস্তান রাজা

সিনেমার গল্প : মাস্তান রাজা

পরিচালক দেওয়ান নজরুল হলেন সেই পরিচালক যার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দোস্ত দুশমন’-এ প্রধান খলনায়ক হিসেবে জসিম বাজিমাৎ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে নায়ক জসিমকে দিয়ে অনেক সুপারহিট চলচ্চিত্র উপহারও দিয়েছিলেন। ৮০ থেকে ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে যে কজন পরিচালকের নিয়মিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেতো এবং ব্যবসাসফল হতো তাঁদের মধ্যে দেওয়ান নজরুলের নামটি শীর্ষের দিকে থাকবে সন্দেহ নেই। দেওয়ান নজরুলের সিনেমা মানেই ১০০% বিনোদন এবং দর্শকদের পয়সা উসুল করে দেয়া সিনেমা। দেওয়ান নজরুলের সিনেমা মানেই তারকা ঠাসা বিগ বাজেটের সিনেমা এবং দেওয়ান নজরুল ও জসিম জুটির সিনেমা মানেই মারমার কাটকাট সিনেমা। ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমাটি ছিলো তেমনই একটি সিনেমা।

‘মাস্তান রাজা’ সিনেমার প্রাণ ছিলেন ৩ জন— যারা হলেন জসিম, শাবানা এবং আহমেদ শরীফ। এর মধ্যে আরও মজার ব্যাপার হলো যে সময়ে জসিম শাবানা জুটি একে অপরের বিপরীতে নায়িক নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয় ও সফল সেই একই সময়ে জসিম শাবানা ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমায় আপন দুই ভাইবোন চরিত্রে যেখানে শাবানা হলেন জসিমের বড় বোনের চরিত্রে। জসিম শাবানাকে ভাইবোনের চরিত্রে এরও আগে দর্শকরা একাধিকবার দেখেছে যেগুলোও সফল হয়েছিল কিন্তু ‘মাস্তান রাজা’র জসিম শাবানার ভাইবোন চরিত্র দুটো যেন পূর্বের সিনেমাগুলোকেও ছাড়িয়ে গেলো।

রেডিওতে মুক্তির আগে ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনে শুনে মুক্তির ১ম দিনেই দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং করেছিও সেটাই। সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হলে প্রদর্শনীর ১ম দিনের ১ম মর্নিং শোতেই সিনেমাটি দেখতে গেলাম। ১ শোতেই মারামারি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়ে গেলো দুষ্ট ছেলেদের দলের সাথে অন্যান্য দর্শকদের যার সমাপ্তি ঘটে পুলিশের আগমনের মধ্য দিয়ে। দর্শকদের কারণে প্রায় ৪৫ মিনিট দেরিতে শুরুতে হলো শো। পুরো হল কানায় কানায় পরিপূর্ণ বললে ভুল হবে কারণ দর্শকদের সামলাতে এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা খালি ছিলো না হলের ভেতরে। মনে হলো হলের বারান্দা থেকে শুরু করে গেইটের বাহিরে বসেও যদি সিনেমা দেখানো যেতো তাহলে হল কর্তৃপক্ষ সেটাই করতো।

আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে তাহলে সিনেমার গল্পের শুরুতেই কিশোরী শাবানার হাতে (সোনিয়া) ছোট দুই ভাইবোন (জসিম ও কবিতা) রেখে মারা যান মা। মাতাল মামা একদিন টাকার লোভে এক খদ্দেরের হাতে শাবানাকে জোরপূর্বক তুলে দিতে চাইলে কিশোর জসিম মামাকে দা দিয়ে এক কোপে খুন করলে জসিম জেলে যায়। এখান থেকেই গল্পের শুরু……সাজা খেটে কিশোর জসিম পরিপূর্ণ এক যুবক হয়ে জেল থেকে ছাড়া পায়। কিশোরী সোনিয়াও শাবানা হয়ে যায় এবং ছোট্ট বোনটি হয়ে যায় কবিতা। জসিম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরনো বস্তিতে এসে দুই বোনকে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে শুরু করলো। চটিপটির গাড়ী নিয়ে চটপটি বিক্রি করে ভালোই দিন কাটছিল জসিমের।একদিন কলেজ পড়ুয়া ছোট বোন কবিতাকে ভালোবেসে অমিত হাসান। জসিম ও শাবানার কাছে এসে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। শাবানা অমিত হাসানের বাবা আহমেদ শরীফের সাথে কথা বলতে আসলে আহমেদ শরীফ শাবানাকে অপমান করে মেরে তাড়িয়ে দেয়।জসিম সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে আহমেদ শরীফের বাড়িতে গেলে আহমেদ শরীফ পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়। শাবানা জেল থেকে জসিম’কে ছাড়াতে গেলে পুলিশ আহমেদ শরীফ অভিযোগ তুলে নিলে তবেই ছাড়তে পারবে বলে জানায়। শাবানা অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে আবারও আহমেদ শরীফের কাছে যায় কিন্তু এবার আহমেদ শরীফ শাবানাকে ভোগ করার জন্য শাবানার গায়ে হাত দিলে শাবানা জুতা দিয়ে আহমেদ শরীফের গালে আঘাত করে বেরিয়ে আসে, আহমেদ শরীফ তাঁর লোক দিয়ে শাবানাকে হত্যা করানোর জন্য চলন্ত গাড়ী দিয়ে ধাক্কা মেরে পথে ফেলে দেয়। দুর্ঘটনায় আহত শাবানাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। জসিম থানা থেকে পালায় এবং শাবানাকে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচায়। পুলিশের ভয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিতে গিয়ে পথে আহমেদ শরীফের লোকদের হাত থেকে অপরাধ জগতের আহমেদ শরীফের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহবুব খানকে রক্ষা করে। মাহবুব খান জসিমের সাহসিকতাকে কাজে লাগাতে নিজের দলে জসিমকে নেন যেখান থেকে জীবন সংগ্রামে পোড় খাওয়া সাধারণ রাজু হয়ে যায় ‘’মাস্তান রাজা’’।

এরপরের গল্পটা শুধুই বারবার টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এক গল্প। শাবানা অপরাধ জগতে পা বাড়ানো জসিমকে ঘর থেকে বের করে দেয়। ভাইবোনের দ্বন্দ্বমুখর একাধিক দৃশ্যর সাথে সাথে সিনেমার গল্পটিও এগিয়ে যেতে থাকে দুর্দান্ত সব অ্যাকশন দৃশ্য আর আহমেদ শরীফ জসিমের দ্বন্দ্ব নিয়ে। পুরো সিনেমাটা শেষ না করে উঠার উপায় ছিলো না একজন দর্শকেরও আর যখন শেষ হলো তখন দর্শকদের ঘোর কাটলো কিন্তু প্রায় আড়াই ঘণ্টা একটি উপভোগ্য সিনেমা দেখার আনন্দের রেশটা রয়ে গেলো যা ছিলো হয়তো আরও অনেকদিন।তপ্ত বৈশাখের ১ম দিনেই দর্শকরা যেন বৈশাখের তেজটা ভালোমতেই টের পেলেন ‘মাস্তান রাজা’ উপভোগ করে।

ছবিতে সৎ পথে থাকার কষ্ট আর শত কষ্ট করে হলেও চিরদিন সৎ পথে থাকার দ্বন্দ্ব সংঘাত দেখানো হয়েছিল যা ছিলো জসিম ও শাবানা’র মতো দুজন উঁচু মাপের অভিনেতা অভিনেত্রীদের দুর্দান্ত অভিনয় দেখার একটি পরিপূর্ণ বিনোদনধর্মী সিনেমা। শাবানা যে তাঁর সমসাময়িক সকল নায়িকাকে কেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সে প্রশ্নের জবাবও পেয়ে যাবেন ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমা দেখলে। শাবানা সব চরিত্রেই ছিলেন তুরুপের তাস যিনি পর্দায় থাকলেই হলো সেই কথা আবারও প্রমাণ দিয়েছিলেন ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। একজন দর্শকের মনে প্রশ্ন এলো না কেন সিনেমায় শাবানার বিপরীতে কোন নায়ক রাখা হয়নি তা, বরং মনে হয়েছে জসিমের বড় বোনরুপি শাবানাকেই দর্শকরা এতদিন ধরে দেখে আসছে যা ছিলো শাবানা ও জসিমের দুর্দান্ত অভিনয়ের ফলাফল। এই শাবানার সাথেই যে দুদিন আগে দর্শকরা জসিমকে নায়ক হিসেবে দেখেছে তা বেমালুম ভুলিয়ে দিলেন শাবানা ও জসিম। সিনেমায় কতগুলো দৃশ্য চমকপ্রদ লেগেছে তা গুনে বলা যাবে না। একটি বাণিজ্যিক বিনোদনধর্মী সিনেমাকে কিভাবে কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে একের পর এক দারুন সব দৃশ্য দিয়ে পুরো সিনেমা হলকে প্রায় পুরোটা সময় করতালিতে মুখর রাখতে হয় দেওয়ান নজরুলের ‘মাস্তান রাজা’ অন্যতম একটি উদাহরন হতে পারে।মাস্তান রাজা জসিম যখন শাবানার কাছে দোয়া চায় আর শাবানা জসিমকে থাপ্পরাতে থাপড়াতে যখন বলে ‘’এই নে দোয়া’ কিংবা শাবানা যখন আস্তে করে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে কষে আহমেদ শরীফের গালে একটি আঘাত করে সেই দৃশ্য নাকি রাস্তায় জসিম শাবানাকে বাঁচাতে গেলে উত্তেজিত জসিমকে শাবানার ধরে রাখার দৃশ্য এবং সেই দৃশ্য জসিম যখন শাবানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ‘’ আমি কারো মরা মুখ দেখতে চাইনা’’ বলতে বলতে শাবানাকে একা ফেলে চলে যায় সেই মুহূর্ত নাকি জেল থেকে বের হয়ে বস্তির মুখেই দেখা পাওয়া কিশোর বেলায় কসাই নামক যে মাস্তানের হাতে মার খাওয়া সেই কসাইকে মারতে মারতে জসিম যখন বলে ‘’ আমি সেই রাজু’’ সেই দৃশ্য… এমন কোন দৃশ্যকে আপনি সিনেমার সেরা দৃশ্য বলবেন সেটা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হবে কিন্তু কোনটিকে বাদ দিতে পারবেন না। একেকটি মুহূর্ত কিংবা একেকটি দৃশ্য বোরিং বা বিরক্তিকর লাগার উপায় ছিলো না দর্শকদের কারণ সেই উপায়টুকু বের করার সময় পরিচালক দেওয়ান নজরুল দর্শকদের একটুও দেননি যাকে বলে একজন পরিপূর্ণ সার্থক বিনোদনধর্মী পরিচালক।

পরিশেষে প্রয়াত জসিম সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়,- বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আমার কাছে বহুমুখী মেধাবী হিসেবে সর্বপ্রথম যিনি গণ্য হবেন তিনি হলেন অ্যাকশন কিং জসিম যার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয়েছিল সহ খলনায়ক দিয়ে , যিনি পরবর্তীতে প্রধান খলনায়কও হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হিসেবে। জসিমের ভেতর থেকে মেধাকে বের করে এনে কাজে লাগিয়েছিলেন সেইসময়ের মেধাবী পরিচালকরাও যাদের সিনেমায় জসিম একসময় খলনায়ক হয়েছিলেন আবার সেই পরিচালকদের সিনেমাগুলোতেও জসিম নায়ক হয়ে বাজিমাৎ করেছিলেন। পর্দার ভেতরে ও বাহিরেও জসিমের পদচারনা ছিলো দুর্দান্তভাবে কারণ জসিম ছিলেন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সর্বপ্রথম ফাইট ডিরেক্টর যার ছিলো ‘জ্যাম্বস ফাইটিং গ্রুপ ’নামে একটি গ্রুপ যে গ্রুপের সদস্যরা পর্দায় নায়কের ডামি হিসেবে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ শর্ট দিতেন।বাংলা চলচ্চিত্রে এমন বহুমুখী, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী জসিমের মতো ২য় আরেকজন কেউ আমাকে দেখাতে পারবেন বলে আমি মনে করিনা, কারণ জসিমের মতো এমন মেধাবী ২য় আরেকজন আসেনি যিনি ফাইট ডিরেক্টর থেকে শুরু করে খলনায়ক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েও দুর্দান্ত জনপ্রিয় নায়ক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং সফল একজন প্রযোজকও ছিলেন।

একজন ভুঁড়িওয়ালা খলনায়ক, ফাইট ডিরেক্টর, প্রযোজক’কে একজন নায়ক হিসেবে কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং যার মেধাকে কিভাবে সৎ ব্যবহার করতে হয় সেটা সেদিনের গুণী পরিচালকদের সিনেমাগুলো না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। অথচ আজ জসিমের চেয়েও অনেক অনেক সুদর্শন চেহারার নায়ক’কে দিয়েও আজকের মেধাবী ডিজিটাল পরিচালকরা যা পারছেন না তার চেয়েও অনেক অনেক বেশিকিছু জসিমের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিলেন আমাদের সেদিনের গুনি প্রযোজক পরিচালকরা । আজ জসীমের মতো মেধাবীও এই ইন্ডাস্ট্রিতে নেই , নেই মেধাবী বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালকও।


মন্তব্য করুন