Select Page

সূর্য দীঘল বাড়ীতে বোকা পিঁপড়ের দল

সূর্য দীঘল বাড়ীতে বোকা পিঁপড়ের দল

আমি কোন চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক নই। সাধারণ দর্শকের মত ছবি দেখি। প্রাণবন্ত কমেডি দেখলে প্রাণ খুলে হাসি। মর্মন্তুদ ট্রাজেডির পর স্তব্ধ ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। কখনো চুপ করে বসে থাকি,কখনোবা কেঁদে ফেলি অজান্তেই। আমার কাছ থেকে তাই বোদ্ধার মত তথ্য উপাত্তে ভরা খটখটে লেখা আশা করা বোকামি।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুভি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দেখি দেখি করেও আলস্যে দেখা হয়ে উঠছিল না এটি অনেক দিন ধরে। এখন বলব, মারাত্মক ভুল করেছিলাম এমন ‘অবশ্য দ্রষ্টব্য’ মুভি আগে না দেখে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে মসিহউদ্দিন শাকেরশেখ নিয়ামত আলী মুভিটি নির্মাণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ ও অবিভক্ত ভারতের বাংলায় অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের উপর নির্মম শোষণের গল্প ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষের ‘চতুর শেয়াল’ বনে যাবার গল্প ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। মুভিটির ব্যাপ্তি ১৩২ মিনিট। কিন্তু কখনই মনোযোগ হারাতে হয় না। ছবির প্রধান চরিত্র জয়গুন। যে কিনা আমাদের চারপাশে অহর্নিশ সংগ্রাম করে যাওয়া পরিচিত এক নারী। স্বামী পরিত্যক্তা বাস্তুহারা জয়গুন যতটা চোয়ালবদ্ধ সঙ্কল্পে খিটখিটে মেজাজে সংসার আগলে রাখে,ততটাই আগলে রাখে পড়শির দস্যি চোখ থেকে নিজের সম্ভ্রম। গ্রামের ধর্মান্ধ মানুষের ভ্রূকুটি এড়িয়ে অটুট দৃঢ়তায় যে নারী এ অঞ্চলের চাল ও অঞ্চলে ফেরি করে বেড়ায়,তা দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। মমতায় চোখ ভিজে ওঠে। সময়ের পরিক্রমায় জয়গুনের একমাত্র মেয়ে মায়মুনের জীবনের পথের বাঁকও তার জীবনের মত ধূলিময় হয়ে দেখা দেয়। সেখানে থাকে না কোন মমতার পরশ,ফোটে না কোন নরম মাটির ফুল। সুদিনের স্বপ্ন দেখাটা যেন সাংঘাতিক অপরাধ!! মায়মুনের বিয়ের দিনে জয়গুনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তওবা পড়ে অঝোরে কান্না করার দৃশ্যটা বস্তুত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে,পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও নিছক হাতের পুতুল। পুরুষের যেমন ইচ্ছে,সেভাবেই তাদের ব্যবহার করে। প্রসঙ্গত, হুমায়ুন আজাদের কথা মনে পড়ে যায়,”কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না। ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।”

মুভিজুড়ে আমার প্রিয় চরিত্র ছিল জয়গুনের বড় ছেলে হাসু। সদ্য কৈশোর পেরুনো এ যুবক যেন বঞ্চনার প্রতীক। মুটের কাজ করতে গিয়ে অবাঞ্ছিত হওয়া,আকস্মিক নির্মাণ কাজ বন্ধ হওয়ায় ন্যায্য মজুরি না পাওয়া,বরাদ্দকৃত সরকারী চাল লাইনে দাঁড়িয়েও ভাগ্যে না জোটা,ছোট ভাইকে দেখতে গিয়ে সৎবাবার মুহুর্মুহু পাটকেল নিক্ষেপ,পয়সা বাঁচিয়ে বোনের জন্য চুরি কিনে গালি হজম সহ নানা দিক থেকে আসা হাজার রকম বঞ্চনা মুখ বুজে সয়ে যাওয়া হাসুর চোখে আমি কিছু একটা দেখেছিলাম। যেখানে অশ্রু ছিল না, অভিযোগের তীর ছিল না। ছিল যেন,”দেখিস,কোন একদিন আমিও..”
যখন দেখি ‘হার্ট লকার’ ‘আরগো’ এর মত অরডিনারি ছবি শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে অস্কার পুরস্কারে ভূষিত হয়,তখন আমার মনেও হাসুর প্রভাদীপ্ত অভিলাষ এসে বাসা বাঁধে,”দেখিস,একদিন আমাদের ছবিও..”

সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুভিটির চিত্রনাট্যে ছিলেন বোধহয় মসিহউদ্দিন শাকের। যেহেতু ছবিটা মুভিয়ানার ক্লাসরুমে বসে দেখা,তাই আন্দাজে ঢিল মারতে হচ্ছে আর কি। যদ্দুর মনে পড়ে,তিনি অথবা তাঁরা দু’জন। চিত্রনাট্য যত্ন নিয়ে করেছেন বলে মনে করি। পরিচালনায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানার ছাপ থাকবারই কথা। ক্যামেরাওয়ার্ক ভালো ছিল আনোয়ার হোসেনের। তবে তিনি বলেই তার কাছ থেকে আরেকটু ভালো আশা করেছিলাম। শেষ দৃশ্যটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। সূর্যাস্তের বেলায় ঘর পোড়া জয়তুনের গোটা পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে আবারও শহরমুখী হবার পথে। এক্সট্রিম লং শটে ক্যামেরা স্থির।মাথা নিচু করে জয়তুনেরা পিঁপড়ের দলের মত নির্বিকার হেঁটে যায়। আমরাও বাকশুন্য হয়ে স্থির বসে থাকি।

জয়তুনের চরিত্রে ডলি আনোয়ারকে দারুণভাবে মানিয়েছে। এজন্য পরিচালকদ্বয় বাড়তি একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। মায়মুন চরিত্রে ইলোরা গওহরকেও বেশ মানানসই লেগেছে। এ টি এম শামসুজ্জামান ছিলেন বরাবরই তার মতো। অতুলনীয় অভিনয়!! জহিরুল হক, লেনিন, আরিফুল হক, ফখরুল হাসান বৈরাগী সহ সবার অভিনয়ই কম বেশি ভালো লেগেছে। তবে হাসান ইমামের অভিনয় একদমই ভালো লাগেনি। রওশন জামিলের কথা না বললেই নয়। এই গুনী অভিনেত্রীর অসাধারণ অভিনয় আমি তন্ময় হয়ে দেখি।‘জাগো হুয়া সাবেরা (১৯৫৯), জীবন থেকে নেয়া (৭০-৭১), চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)’ সহ অসংখ্য বিখ্যাত ও নন্দিত ছবিতে তিনি মনোমুগ্ধকর অভিনয় করেছেন। তবে প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি,এটাই অনুতাপের বিষয়।

সঙ্গীত আশানুরূপ ভালো লাগেনি। দু এক জায়গা ছাড়া পুরো ছবিটিতে মিউজিকের প্রভাব তেমন চোখে পড়েনি। নাকি কানে শোনেনি!! ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে বসেছিলাম এটা দেখতে,তাই হয়তো তুষ্টি আসেনি। ছুঁয়ে যাওয়ার মতো যেমন আবহ সংগীত আশা করেছিলাম,তার লেশমাত্র পাওয়া যায়নি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’তে।

তবে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’তে পেয়েছি বেগুনী সংগ্রামের নিদারুণ বাস্তবতা। ধর্মান্ধতা,কুসংস্কারাচ্ছন্নতা,অজ্ঞতা,দখলদারিত্ব এবং সামাজিক বিধি নিষেধের শেকলে আটকে পড়া আমাদের চিরাচরিত যে গ্রাম ও তার অধিবাসী,তাতে ছবিটির নাম ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বেমানান ঠেকে। শহীদুল জহিরের মতো আবার বলতেও ইচ্ছে হয়,”এটাই যে সূর্য দীঘল বাড়ী!!”

ধন্যবাদ মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী স্যার।
এমন একটা মুভি বানানোর জন্য।
এমন একটা মুভি আমাদের দেখার সৌভাগ্য করে দেয়ার জন্য।।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

৭ টি মন্তব্য

  1. chobiwala

    আপনার লেখা দেখে মনে হচ্ছে না যে এটা আপনার প্রথম লেখা এবং আরেকটা বিষয় যদিও আমি এখন পর্যন্ত ছবিটা দেখিনি তারপরেও আপনার লেখা পড়ে ছবিটা আমার দেখার সাধ জেগেছে এবং সময় পেলে অবশ্যই দেখব।চালিয়ে যান আপনি আপনার রিভিও লেখা………….

    • moviekature

      ধন্যবাদ chobiwaala. আমারও ইচ্ছে আছে,ছবিটা আরও একবার দেখার। আমি ভাই নিতান্তই পাঠক ও দর্শক(মুভিকাতুরে)। বড় লেখা লিখতে কষ্ট হয় (শারীরিক)। ধৈর্যও কুলোয় না। সে অর্থে এটাই প্রথম লেখা আমার।
      “আপনার লেখা পড়ে ছবিটা আমার দেখার সাধ জেগেছে” আবারও ধন্যবাদ।

  2. সওদাগর

    বাহ! দারুণ রিভিউ। মুভিটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছে।

    বিএমডিবি এধরনের ক্লাসিক মুভিগুলো দেখার কোন সুযোগ করে দিতে পারে না?

    • moviekature

      ধন্যবাদ। মুভিটা দেখে নিয়েন। ভালো লাগবে আশা করা যায়।
      বিএমডিবি একটু গুছিয়ে উঠলেই এধরনের ক্লাসিক মুভিগুলো দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দেবে হয়তো..

  3. kaler kolosh

    ভীষণ ভালো লাগসে রিভিউটা। লেখাটা পড়ে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ মুভিটা দেখার খুব ইচ্ছে জাগসে। আরও লেখা চাই আপনার কাছ থেকে।

    • moviekature

      ধন্যবাদ। ক্লাসিক মুভিগুলো আগেভাগে দেখে ফেলাই ভালো। আমাদের ক্লাসিক হলে তো কথা নাই!!
      অলসতার গল্পের সমাপ্তি ঘটুক আগে,তারপর না হয় কালো হরফ উড়ে বেড়াক মগজে.. 🙂 🙂

  4. moviekature

    ধন্যবাদ। ক্লাসিক মুভিগুলো আগেভাগে দেখে ফেলাই ভালো। আমাদের ক্লাসিক হলে তো কথা নাই!!
    অলসতার গল্পের সমাপ্তি ঘটুক আগে,তারপর না হয় কালো হরফ উড়ে বেড়াক মগজে.. 🙂 🙂

মন্তব্য করুন