Select Page

হুমায়ূন ফরীদি জাদুকর ছিলেন

হুমায়ূন ফরীদি জাদুকর ছিলেন

হুমায়ুন ফরীদি ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২) টিভিতে দেখলাম যখন আমার বোনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছি। বোনের বাচ্চা হবে, একটা রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি তখন দেখি টিভিতে খবর: জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি আর নেই। মুহূর্তের মধ্যে আমি থমকে দাঁড়ালাম। সেই মুহূর্তেই মনে হলো এই খবর চিরদিনের জন্য আমার মাথায় গাঁথা হয়ে গেল।

হুমায়ুন ফরীদি তো শুধু অভিনেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন জাদুকর। মজার ব্যাপার, আমার লেখা ‘অদ্ভুত জাদুকর’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তিনিই নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন। অদ্ভুত জাদুকর এক ঈদে পাঁচ দিন ধরে পাঁচপর্ব প্রচার হওয়ার কথা ছিল চ্যানেল আই-এ, শিরোনাম একই, সব আলাদা গল্প নিয়ে। দিন-তারিখ ঠিক করা ও গল্প নিয়ে কথা বলার জন্য একদিন বুলু ভাইয়ের সঙ্গে গেছি তার ধানমন্ডির বাসায়। সেদিন সন্ধ্যায় ভূমিকম্প হয়েছিল। তিনি খুব মজা করে ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। ভূমিকম্পের সময় কীভাবে একটা পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলেন সেটা অভিনয় করে দেখালেন। আর খুব মজা করে বললেন খাওয়ার কথা, দুপুরে কী কী দিয়ে মজা করে খেয়েছেন তার বর্ণনা দিলেন। ডায়রি বের করে শিডিউল লিখলেন। খুব কষ্ট করে ডেট বের করতে হলো, তিনি ডায়রিতে ডেট লিখছেন, আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছি! আমার ছেলেবেলার জাদুকর আমার সামনে বসে আছেন! দুঃখের ব্যাপার, অদ্ভুত জাদুকর এক পর্বই প্রচার হয়েছিল। ‘এবং জাদুকর’ নামে আরেকটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

এক সময় আমার অভিনয়ের প্রতি একটু আগ্রহ জেগেছিল। একটা থিয়েটার গ্রুপেও ভর্তি হয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, একমাত্র হুমায়ুন ফরীদিকে দেখেই। তার পরবর্তী জেনারেশনের কতজন যে তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন! আফরান নিশো, মিশা সওদাগর তাকে গুরু মানেন। আফরান নিশো নাকি এখনো প্রতিদিন শ্যুটিংয়ে বেরোনোর আগে তার ছবিকে সালাম করে জান।

আমাদের ছোটবেলায় হুমায়ুন ফরীদি ছিল এক বিস্ময়ের নাম। সংশপ্তকের কান কাটা রমজানের কথা বাদ দিলাম, শহীদুল ইসলাম খোকনের বিশ্ব প্রেমিক-এর বড় ভাইয়ের কথা বলি, সে ছবি যখন এলো মতিমহলে মাথা খারাপ হয়ে গেল। ‘এই তো প্রথম একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে’ কী নাচ সেই গানে! তারপর এল ‘ভন্ড’! তারও আগে এসেছিল ‘বাংলার কমান্ডো’, চোর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সারা গায়ে তেল মেখে চুরি করতে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকেন। তারও অনেক পড়ে এসেছিল ‘পালাবি কোথায়’!

হুমায়ুন ফরীদি থাকা মানেই ছবি হিট। আর সাথে যদি রুবেল থাকতেন তাহলে তো কথাই নেই। এক ছবিতে কোমড় দুলিয়ে যে কী নাচ দিয়েছিলেন, তেল গেলে ফুরাইয়া বাত্তি যায় নিভিয়া, কী হবে আর কান্দিয়া। সালমান শাহ’র সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন …

বদমাশ বলি আর ভালো মানুষ বলি সব চরিত্রেই তিনি পারফেক্ট। আমার একটা আফসোস হয়েছিল লালসালু ছবিতে তানভীর মোকাম্মেল যে কেন তাকে নিলেন না! মজিদ চরিত্র তিনি খুব ভালো করতেন। বিকল্পধারার বা তথাকথিত আর্টফিল্ম বলে যেগুলোকে আমরা চিহ্নিত করি সেরকম বেশি ছবিতে কাজ করার সৌভাগ্য তার হলো না। এক নাসিরউদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যিশু আর হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া, এই দুই অন্যরকম ছবিতেই তাকে আমরা পেলাম। আর মোরশেদুল ইসলামের দূরত্বেও অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু, সেখানে তার অভিনয়ের তেমন জায়গা ছিল না।

মাঝে মাঝে আফসোস হয় ভালো পরিচালাকের অভাবে তার মতো বিস্ময়কর একটা প্রতিভা কেবল ভিলেন আর কমেডিয়ান হিসেবেই বাংলা ছবিতে সারাজীবন কাজ করে গেলেন। তা না-হলে তো তার নাসিরুদ্দিন শাহ’র মতো প্রতিভা ছিল।

সে যাই হোক, শেষ দিকে হুমায়ূন আহমেদের কিছু অসামান্য নাটকে অভিনয় করেছিলেন। ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতেন কোন নাটকে যেন। তিনি আমার এক স্মৃতিকাতরতার নাম। আমার নাটক যখন পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন তখনই তিনি চলে গেলেন। আমার একটি ধারাবাহিক নাটকও পরিচালনা করার কথা ছিল তার।

তিনি আমার মোট চারটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু একটি ছাড়া ইউটিউবে আর কোনোটা পেলাম না। সেটাও কেমন ঝাঁপসা হয়ে গেছে, অনেক দিন আগের নাটক। কমেন্টে লিংক দিলাম, দেখলে মজা পেতে পারেন।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কামরুল আহসান

লেখক, গবেষক ও নাট্যকার

মন্তব্য করুন