অদ্ভুত এক আগুনের গল্প ‘সিন্ডিকেট’
শিহাব শাহীনের ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’। দুনিয়ার অনেক বিখ্যাত সিনেমায় পরিচালককে পাসিং শটে দেখা গেছে, এখানেও দেখা গেলো। বসলাম সময় নিয়ে। একটা ব্যাংকের ভেতরের ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের প্রায় অনেক সেক্টরের গল্পের ইশারা দিয়ে সিরিজের জার্নি শুরু হলো। গল্পে কী কী আছে, সেসব আলাপে না গিয়ে আমার কেন এত ভালো লাগলো, কী কী ভালো লাগলো সেসব লিখতে বসেছি।
২০০৭ সালে ‘ইট কাঠের খাঁচা’ নামের ধারাবাহিক নাটক থেকে আমি শিহাব শাহীনের যেকোনো নির্মাণ যত্ন নিয়ে দেখার চেষ্টা করি। কারণ, গল্পগুলো ধীরে এগোয়, তারপর আরও ধীরে সেই গল্পে থিতু করে দেয়। ফলে ‘ইট কাঠের খাঁচা’ থেকে তার নির্মাণ নিয়ে সাধারণ এবং সচেতন দর্শক হিসেবে আমারও যাত্রা শুরু হয় আস্তে-ধীরেই। যদিও তার বেশ আগে ‘রমিজের আয়না’ দেখেছিলাম। তবে টেলিভিশনের সামনে বসে নাটক দেখার সেই আনন্দের দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। যাহোক, সেই পুরনো মুগ্ধতা থেকে তার ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’ দেখতে বসলাম।
নিশো আমাদের সন্তান। আমরা এক মাটি-জল-নদী-হাওয়ার মানুষ। তার প্রতি বরাবর একটা ভিন্ন আগ্রহ থাকে আমাদের। নির্মাতা তাকে এই সিরিজে ভেঙ্গেচুরে উপস্থাপন করেছেন। অ্যাসপারগার সিনড্রোম রোগী চরিত্রে নিশোকে এভাবে পাওয়া যাবে, এটা বিরাট চমক। দিন দিন নিশো কতটা অসামান্য অভিনেতা হয়ে উঠছে, সিন্ডিকেটে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। এই রোগে ভুগতে থাকা লোকজন সাধারণত প্রত্যাশিত সামাজিক আচরণ করতে পারে না। সেই অস্বাভাবিক চরিত্রে নিশো ছিল অনবদ্য। তার লুকটাও নির্মাতা বদলে দিয়েছেন, আর নিশো ঢেলে দিয়েছে নিজেকে শতভাগ মনোযোগে।
রাশেদ মামুন অপু। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই। আমার আপন ভাইদের একজন। তাকেও আমি নড়চড়ে বসে দেখি। দেখতে ভালো লাগে। গর্ব হয়। সিন্ডিকেটে অপু ছিল খাঁটি বদমাশ। এই চরিত্রে তার বিকল্প ভাবাটা কল্পনাই করতে পারছি না। বিশেষ করে তার সংসারে মনোযোগী ও বোকাসোকা স্ত্রীর সাথে তার অভিনয় বিপুল মুগ্ধ করেছে।
বরাবর শতাব্দী ওয়াদুদ আমাদের প্রায় সকলের পছন্দের সামনের কাতারের অভিনেতা। সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের লাম্পট্য এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সামনে নিয়ে আসাটা তিনি দেখিয়েছেন দারুণ মুন্সিয়ানায়।
তাসনিয়া ফারিন তো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান থেকেই মনোযোগের প্রথম দিকের অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। সেই ফারিন সিন্ডিকেটে এসে আরও পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন।
নাজিফা তুষিকে কেন্দ্র করেই এই গল্পটা এগিয়েছে নানান মোড়ের দিকে। ব্ল্যাকমেইলে বিপর্যস্ত এই অসামান্য প্রেমিকার চোখে মুখে যে অস্থিরতা তিনি দেখালেন, কাজটা সহজ নয় একেবারেই।
এবার আসি আসল মানুষটির ব্যাপারে। নাম তার নাসির উদ্দিন খান। আশফাক নিপুণের মহানগরের সেই সংলাপ ‘রূপালিরে আবার কল টল দিয়েন না, নাম্বারটা ডিলিট কইরা দিয়েন। ‘এখনও ঠিক মনে আছে। তার প্রতি বাড়তি আগ্রহ ছিল তখন থেকেই। সিন্ডিকেটে তার উপস্থিতি বেশি না হলেও তিনি যেন সবচেয়ে বেশি আলো কেড়ে নিলেন। এ কী অভিনয়! অনেকে তাকে আমাদের দেশের নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকী বলছেন। আমি তাও বলছি না। সিন্ডিকেট দেখে আমার মনে হলো, এ অন্য জিনিস। এর সাথে নওয়াজুদ্দীন সিদ্দিকীর তুলনা করা অনুচিত। এখানে তিনি যা দেখালেন, তাতে তার তুলনা তিনিই। ভবিষ্যতে ফাইট দিতে হলে তাকেই তার সাথে দিতে হবে। এক কথায় সময় ও পয়সা উসুল হয়ে গেছে তার অভিনয় দেখার পরেই।
মেকিং নিয়ে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আমার নাই। আমাকে আরও দেখতে হবে , আরও পড়তে হবে। মেকিং নিয়ে আমি কিছু বলব না। আমার দেখতে আরাম লেগেছে। অসঙ্গতি লাগে নাই। আমি আসলে এই শীতল আবরণে মোড়ানো অদ্ভুত এক আগুনের গল্পের দিকে ঝুঁকেছিলাম। সেভাবেই পুরোটা দেখে স্তব্ধ হয়ে আছি। সমাজের এই জায়গাগুলোর ক্রাইসিস নিয়ে তেমন গল্প আসে না। যদিও আসে, অল্প অল্প। কেউ বলছেন এই গল্প বেশি ধীরে চলেছে। আমার মনে হয়েছে, এমন গল্পের এই ধীরে চলনটাই এর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।
শিহাব শাহীনের গল্প বলাটার পুরনো ভক্ত হিসেবে আমি আনন্দ পেয়েছি। তার কাছে সমাজের সব ছিদ্র দিয়ে ঢুকে বড় ফাল হয়ে বের হবার আরও অনেক গল্পের প্রত্যাশা রাখি।
চব্বিশ জুলাই, বাইশ। পান্থপথ, ঢাকা।