Select Page

মাসুদ রানা, তুমি কোথায়?

মাসুদ রানা, তুমি কোথায়?

এমআর – ৯: ডু অর ডাই; গল্প: ধ্বংসপাহাড় (কাজী আনোয়ার হোসেন); পরিচালনা: আসিফ আকবর; অভিনয়: এবিএম সুমন (মাসুদ রানা), ফ্র্যাঙ্ক গ্রিলো (রোমেন রস), ম্যাট পাসমোর (রিকি রস), রেমি গ্রিলো (জেসন রস), নিকো ফস্টার (পল টেলর), মাইকেল জে হোয়াইট (ডিউক), সাক্ষী প্রধান (সুলতা দেবী), অমি বৈদ্য, শহীদুল আলম সাচ্চু, জেসিয়া ইসলাম, আনিসুর রহমান মিলন, টাইগার রবিসহ অনেকে; প্রযোজনা: জাজ মাল্টিমিডিয়া, আল ব্রাভো ফিলস, চেইজিং বাটারফ্লাই পিকচারস; মুক্তি: ২৫ আগস্ট, ২০২৩ বাংলাদেশ ও আমেরিকা, কানাডা (ইংরেজি) ও ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ (বাংলা ডাবিং)।

২০০৩ সালে মাসুদ রানার নাম ব্যবহার করে একটা অশ্লীল সিনেমা রিলিজ পেয়েছিল। নাম মাসুদ রানা এখন ঢাকায়। সিনেমাটা এত্তো বাজে যে এর কথা হয়তো সবাই ভুলেই যেতে চাইবে। 

রানা হামিদের সেই মাসুদ রানা, আর এবিএম সুমনের আজকের মাসুদ রানা, যেনো ‘কোথায় লিভারপুল আর কোথায় ফকিরাপুল’ উক্তিটার কথাই মনে করাবে। কারণ বাজেট ও আয়োজনে বিস্তর ফারাক। কিন্তু আজ নতুন মাসুদ রানাকে পর্দায় দেখে, আমার সেই অন্ধকার যুগের মাসুদ রানার কথাই সবার আগে মনে পড়লো। প্রশ্ন হলো, কারণটা কি? 

রানা হামিদের সেই মাসুদ রানার সাথে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানার দুর-দুরান্ত অব্দি কোনো সম্পর্ক নেই। কাজীদা হয়তো এ সিনেমা সম্পর্কে জানতেনও না। হয়তো মাসুদ রানার এমন নিম্নরুচি, নিজ চোখে দেখলে তিনি বিশ বছর আগেই ‘আমেনার মা’ বলে হার্ট অ্যাটাক করতেন। যাই হোক, সে অন্য আলাপ। ঠিক একইভাবে, এবিএম সুমনের “এমআর-৯” এর সাথেও আসল গল্পের মাসুদ রানার তেমন একটা সম্পর্ক নেই। সিনেমাটা বলতে গেলে নামেমাত্র ‘ধবংসপাহাড়’ অবলম্বনে বানানো, বাস্তবে গল্প এতো বেশি মডিফাই করা হয়েছে, ধরতে গেলে কিছুই নেওয়া হয়নি সেই বই থেকে। ঐ দুই একটা চরিত্র, দুই একটা সংলাপ, দুই একটা সাদৃশ্য… এই যা! 

তো যদি আপনি এডাপ্টেশন কেমন হয়েছে এই চিন্তা নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে যান, নিশ্চিত ধরা খাবেন। এই সিনেমা তো আপনাকে নষ্টালজিক করবেই না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে ডিপ্রেশনে ফেলে দিবে। মন চাইবে রানা হামিদের মাসুদ রানার মতো এটাও ভুলেই যাই! এ জীবনে একটা তৃপ্তিকর মাসুদ রানা দেখা হলো না… 

প্রথম এবং আমার দৃষ্টিতে সবথেকে ভয়ানক দুর্বল দিক – মাসুদ রানা চরিত্রটিকে শক্তপোক্তভাবে উপস্থাপন না করা। দর্শক চরিত্রকে আপন করে নিবে, চিত্রনাট্যকার নাজিম-উদ-দৌলা এমন কোনো ইমোশনাল কানেকশন তৈরিই করেননি। সিনেমাটার ভেতর প্রচুর একশন সিকোয়েন্স রয়েছে। প্রচুর মানে প্রচুর! বলা যায় প্রতি ১০ মিনিট পরপর একশন সিন। কিন্তু ‘উইথআউট ইমোশন, একশন ইজ নাথিং’ এস এস রাজামৌলির এই জনপ্রিয় উক্তিটির প্রতিফলন দেখা যায় “এম আর-৯” এ। মাসুদ রানা কে? সে কোথা থেকে উঠে এসেছে? সে আমাদের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ? সে কেন এই মৃত্যুকুপে?… এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আপনি খুঁজে পাবেন না। মাসুদ রানার একটা ব্যাকস্টোরি দেখানো হয়েছে, সেটাও খুবই প্রশ্নবিদ্ধভাবে। ক থেকে কি হলো, কেনো হলো, কোনো উত্তর নেই। একজন স্পাই যেমন অকুতোভয়, শক্ত-সামর্থ্যবান হওয়া উচিত, এম আর-৯ এর মধ্যে সেটা আপনি বেশিরভাগ সময় খুঁজে পাবেন না। প্রায় সময় দেখা গিয়েছে, মাসুদ রানা বারবার বিপদে পড়ছে ও আমেরিকার এজেন্টরা তাকে উদ্ধার করছে। যেসব ছোটখাটো টাস্কে রানা একা ছিল, সেগুলোর একটাতেও তিনি সফল হতে পারেননি। সিরিয়াসলি বলছি, একটাতেও না! তাহলে এমন মাসুদ রানা দিয়ে আমরা কি করবো?

চলচ্চিত্রের নাম এম আর-৯ হলেও, চলচ্চিত্র দেখলে মনে হবে এম আর-৯ ই স্পেস সবথেকে কম পেয়েছে। এর থেকে চলচ্চিত্রের মেইন ভিলেন ফ্র্যাঙ্ক গ্রিলো বেশি স্পেস পেয়েছেন। অন্তত তার চরিত্রের সাথে কানেক্ট করার মতো একটা ইমোশনাল এঙ্গেল ছিল, এইটুকুও মাসুদ রানা পায়নি। আরো হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার, দুই আমেরিকান এজেন্ট, নিকো ফস্টার ও মাইকেল জে হোয়াইট, এবিএম সুমনের থেকে বেশি স্পেস পেয়েছেন। মনে হবে, গল্প ও মিশন, দুইটাই মূলত ওদের, মাসুদ রানা জাস্ট একটা পার্শ্বচরিত্র। বলেন এখন, এমন মাসুদ রানা দিয়ে আমরা কি করবো?

আরেকটা হতাশার নাম হলো কবির চৌধুরী। একেতো কোনোকিছু ঠিকঠাকভাবে দেখায়নি। সবকিছু উপরে উপরে ছুঁয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গল্প ডালপালা মেলেছে। এরওপর কবির চৌধুরী চরিত্রটি যাকে দেওয়া হয়েছে, তিনি ভালো অভিনেতা হওয়া স্বত্বেও খুবই দুর্বল একটা পারফরমেন্স দিয়েছেন। মনে হলো আমেরিকায় বসে ওভার একটিং এর কোর্স করেছেন। বাংলাদেশে তিনি ছোট ছোট রোলে অনেক ইফেক্টিভ পারফরমেন্স দিয়ে গেছেন। ভালো লাগেনি সুলতা দেবী চরিত্রের সাক্ষী প্রধানকে। গ্ল্যামারাস কিন্তু স্ক্রিন প্রেজেন্স বেশ দুর্বল। তবে আবার যখন সাক্ষী প্রধানের সামনে শহীদুল আলম সাচ্চু, জেসিয়া ইসলাম, টাইগার রবিদের পারফরম্যান্স দেখবেন, মনে হবে… থাক ভাই আমার ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীই ভালো! বিসিআই এজেন্ট চরিত্রে থাকা প্রত্যেকের অভিনয় অনেক বেশি অবাস্তবিক, অস্বাভাবিক। যেনো এরা অভিনয় পারেই না! 

বলা হচ্ছিল সিনেমাটা নির্মাণে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে এর প্রতিফলন আপনি বেশি একটা খুঁজে পাবেন না। ভালো দিক যদি বলি, ভালো ও উন্নত মানের ক্যামেরা দিয়ে সিনেমাটা শ্যুট করা হয়েছে। ভালো কিছু লোকেশন দেখতে পাওয়া গেছে। ভালো পরিমাণে ড্রোন শটের ইউজ করা হয়েছে। একাধিক গ্রামি উইনার রিকি কেজের করা মিউজিক ও সাউন্ড ডিজাইনের কাজ বেশ ভালো। এর বাইরে বেশি কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিনেমাটার সবথেকে বড় সেলিং পয়েন্ট একশন সিন, অন্যতম দুর্বলতার জায়গাও ঐ একশন সিনই। বেশিরভাগ একশন গুলো একটা বদ্ধ জায়গায়। হয় কোনো রুমের মধ্যে, নাহয় কোনো কটেজ কিংবা কোনো ক্যাসেলের মধ্যে। একশন কোরিওগ্রাফির মধ্যে কোনো নতুনত্ব না থাকায়, কোনো সিনেম্যাটিক ফিল দিতে পারেনা। একটা কার চেজিং সিন ছিল, ঐ একটা সিকোয়েন্সেই আমি একটু সিনেম্যাটিক ফিল পেয়েছি, যাকে লারজার দ্যান লাইফ ট্রিটমেন্ট বলা যায়। এছাড়া বাকি সবকিছুই টিপিক্যাল। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধুন্ধুমার বিজিএম বাজছে, অথচ পর্দায় সেরকম আউটপুট দেখা যাচ্ছে না… এমনভাবেই হতাশ হয়েছি বেশিরভাগ সময়।

পরিচালক আসিফ আকবর যেরকম মাসুদ রানা আমাদের উপহার দিলেন, তাতে বলা যায় এই সিনেমা না হয়েছে হলিউড স্ট্যান্ডার্ডের, না হয়েছে আমাদের দেশী স্ট্যান্ডার্ডের। হলিউডের লেভেল ধরলে এটা একটা বি-গ্রেড রেট্রো ভাইভ ওয়ালা একশন মুভি, যেগুলো নাইন্টিজে অনেক বেশি নির্মাণ হতো। এই কম বাজেটের মুভিগুলো ভিসিডি-ভিসিআর যুগে খুব ভালো চলতো। কিন্তু এখন মেয়াদউত্তীর্ণ। অন্যদিকে আমাদের দেশী স্ট্যান্ডার্ড ধরলে তুলনা করতে হবে অনন্ত জলিলের “দিন দ্য ডে”র সাথে। কারণ, দুইটাই ভালো আয়োজনে নির্মাণ করা স্পাই মুভি। কিন্তু এনজয় করার মতো না। 

এতো কিছুর পরেও আমি এবিএম সুমনকে আরেকটা মাসুদ রানায় অবশ্যই দেখতে চাইবো। ওনার মধ্যে আমি কেন জানি হিডেন ট্যালেন্ট দেখতে পাই। মন থেকে চাই, উনি একজন একশন হিরো হিসেবে জনপ্রিয়তা পাক। হয়তো এইরকম আইকনিক ক্যারেক্টার দিয়ে, নয়তো অন্য কোনো কিছু দিয়ে।

‘আইকনিক’ শব্দটা শুনে মনে পড়লো… মাসুদ রানা চরিত্রটাই তো জেমস বন্ডের সস্তা কপি। তো এই আমেরিকানদের কপি করে আবার আমেরিকাতেই ছবিটি রিলিজ করা হচ্ছে, আমেরিকানরা আমাদের বেহাল দশা দেখে কি লজ্জা দিবে না? ইসস, না জানি কি মজাটাই না নিচ্ছে(!) 

রেটিংঃ ৪/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

মন্তব্য করুন