অনন্য জহির রায়হান
জহির রায়হান জানতেন ‘সময়ের প্রয়োজনে’ সবকিছু হয়। ভাষা অর্জনে ত্যাগের কথা শোনান ‘একুশের গল্প’-এ। তাঁর গড়া তপু-র মধ্যে আমরা হারানো বন্ধুর সত্তা পাই যেন। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি একগোছা চাবি দিয়ে বাস্তব প্রতিবাদকে দেখান ‘জীবন থেকে নেয়া’-তে। একাত্তরে গণহত্যা বন্ধ করতে কথা বলেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ। ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার বিকৃতি দেখে তিনি কলম ধরেছেন গল্পে ‘কয়েকটি সংলাপ’-এ। জীবনের আবহমান আয়োজন যা কোনোদিন ফুরায় না তাকে বলেন ‘হাজার বছর ধরে।’ তিনি ‘বেহুলা’-র কথা বলেছিলেন যাকে কাব্য করে জীবনানন্দও এঁকেছেন। ‘বরফ গলা নদী’ হৃদয়ে বয়ে যায় তাঁর অপেক্ষায় তিনি আসেন না স্বজনরা বলেন ‘আর কতদিন’ চলবে এ অপেক্ষা! ‘তৃষ্ণা’ যেন এক। আজও অনেকেই ভাবে তিনি ফিরবেন অথচ তাঁর ভাষায় তাঁকে বলতে হয় ‘কখনো আসেনি’।
বাংলাদেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্রে জহির রায়হান একটি গর্বিত নাম। তাঁর নামটি আসলেই কালজয়ী একটা ইমেজ চোখের সামনে ভাসে। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে প্রায়ই বৈশ্বিক মান নিয়ে যে কথা ওঠে সেখানে একজন জহির রায়হান অনায়াসে চলে আসে। তাঁর কাজ বৈশ্বিক মান বজায় রেখেই কালজয়ী হয়েছে।
মূলনাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। জন্ম ১৯ আগস্ট ১৯৩৫, ফেনী জেলায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় ৩০ জানুয়ারি বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিতা দেবী এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী সুচন্দা। সন্তান অনল রায়হান, বিপুল রায়হান এবং তপু রায়হান। তপু রায়হান তাঁর মা সুচন্দার পরিচালনায় ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ এবং রায়হান মুজিবের পরিচালনায় ‘প্রেমপ্রীতি’ ছবিতে অভিনয় করেছে।
জহির রায়হান সাহিত্যিক ও নির্মাতা। তাঁর দুটি সত্তাই স্বতন্ত্রভাবে উজ্জ্বল। সাহিত্যচর্চার অংশ হিসেবে তিনি রচনা করেছেন কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে।’ ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাঁরই সহধর্মিণী সুচন্দা।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, তৃষ্ণা, আর কতদিন, একুশে ফেব্রুয়ারি। গল্পের মধ্যে সময়ের প্রয়োজনে, একুশের গল্প, কয়েকটি সংলাপ, বাঁধ, সোনার হরিণ নামকরা।
জহির রায়হান কালজয়ী সব ছবি নির্মাণ করেছেন। যার মধ্যে ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) বিখ্যাত ছবি। এছাড়া ‘কখনো আসেনি (১৯৬১), বেহুলা (১৯৬৬), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) এগুলো অমর সৃষ্টি। অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সোনার কাজল (১৯৬২), আনোয়ারা (১৯৬৭), সুয়োরাণী দুয়োরাণী ( ১৯৬৮), দুই ভাই (১৯৬৮)। উর্দু ছবির মধ্যে সঙ্গম, বাহানা উল্লেখযোগ্য ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী। সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন এদেশ তোমার আমার, জাগো হুয়া সাভেরা, যে নদী মরুপথে প্রভৃতি ছবিতে।
‘জীবন থেকে নেয়া’ তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। একটি চাবির গোছাকে প্রতীকী করে তৎকালীন পরাধীনতাকে তুলে ধরেছেন যা ছিল পাকিস্তান আমলে সাহসী একটি কাজ। এ ছবির জন্য তাঁকে অনেক চাপও সহ্য করতে হয়েছিল। ছবিতে বাড়িটি ছিল রাষ্ট্রীয় প্রতীকে, রওশন জামিলের চরিত্রটি ছিল স্বৈরশাসকের প্রতীকে, তাঁর বিরুদ্ধে ঘরোয়া প্রতিবাদে খান আতাউর রহমানের ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’ গানটি ছিল স্বাধীনতার চেতনা এবং রাজ্জাক, শওকত আকবরদের সম্মিলিত প্রতিবাদ ছিল আপামর জনমতের প্রতীক যারা সবাই স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি চায়। অসাধারণ একটি ছবি ছিল।
‘কখনো আসেনি’ কালজয়ী ছবি। এ ছবিতে অনেক আগের একটি গল্পকে পরবর্তী সময়ে তুলে ধরা হয়েছে। সুন্দরী এক মেয়ে যাকে পাথরের মূর্তির মতো করে রাখতে চেয়েছিলেন যাদুঘরের মালিক। সেই মেয়েই ছবির নায়িকা সুমিতা দেবী যার প্রেমের পরিণতিতে তাকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল এবং তাঁকে বাঁচাতে পরবর্তীতে কেউ আসেনি। করুণ এ গল্পকে যেন শিল্পীর তুলিতে এঁকেছেন জহির রায়হান।
‘বেহুলা’ মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত বেহুলা-লখিন্দর কাহিনী নিয়ে নির্মিত। রাজ্জাক-সুচন্দা জুটির সেরা ছবি বলা যায়।
‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিতে সংসারে নির্যাতন সহ্য করা একটি মেয়ের গল্প এসেছে যার ভাগ্যে লটারি জোটে এবং তারপর তার আদর-যত্ন বেড়ে যায়। লটারি মিথ্যে প্রমাণিত হওয়াতে আবার নির্যাতন বাড়ে তখন মেয়েটি বাড়ির কাঁচের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায় স্বাধীনতার জন্য।
‘আনোয়ারা’ ছবিটি নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের উপন্যাস থেকে নির্মিত এবং রাজ্জাক-সুচন্দা জুটির অন্যতম ছবি। ‘দুই ভাই’ অমনিবাস চলচ্চিত্র। স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন’মুক্তিযুদ্ধের দলিল।
জহির রায়হান সাহিত্যে ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান। এছাড়া ১৯৭২ সালে মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক এবং ১৯৯২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন যার মধ্যে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিগার পুরস্কার ছিল। ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারে মরণোত্তর পুরস্কার পান।
একজন জহির রায়হান এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁকে নিয়ে যত কাজ হবে, আলোচনা হবে আমরা ততই সমৃদ্ধ হবো এবং আগামী প্রজন্ম আরো বেশি গর্বিত বোধ করবে আর বলবে আমাদের একজন জহির রায়হান ছিলেন।