
অভূতপূর্ব ‘উৎসব’
আমাদের চলচ্চিত্রে নির্মল বিনোদনের খোরাক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর একদম চলে গিয়েছিল। তিনি যখন চলে যান তখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ডিজিটাল আমল শুরু হচ্ছে যার ফলে সম্পূর্ণ নতুন এ সময়টিতে আগের সময়ের সাথে যে ট্রানজিশন পিরিয়ডটি ছিল সেটির সাথে পার্থক্য এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে শূন্যস্থানটাই বেশি চোখে পড়ে। হুমায়ূনীয় যে হিউমার, দৃশ্য ও সংলাপের ক্রিয়েটিভিটি সাথে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্টও ঠিক রাখা এর সবগুলোই ডিজিটাল সময়ের ছবিতে বড়ভাবে মিসিং ছিল।

কমেডিকে কমেডির মতো করে রিপ্রেজেন্ট করার যে দক্ষতা ডিজিটাল সময়ের ছবিতে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজস্ব অ্যাপ্রোচে তুলে ধরেছেন তানিম নূর তার ‘উৎসব‘ ছবিতে।
তানিম নূরের প্রথম ছবি ছিল ‘ফিরে এসো বেহুলা’, সেটিও নতুন দৃষ্টিকোণের ছবি তখনকার সময়ে। এছাড়া তিনি ওটিটিতে ‘কাইজার’ সিরিজের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে নাম করেছেন এবং এরও আগে তার মানি হানি, একাত্তর, কন্ট্রাক্ট, প্রজন্ম টকিজ সিরিজগুলো দিয়ে আলোচনায় ছিলেন। দ্বিতীয় ছবি ‘উৎসব’-এ তিনি নতুন করে আলোচনায় এলেন। ছবির গুণে, ওয়ার্ড অফ মাউথে, ফ্যামিলি অডিয়েন্স ভ্যালুতে তিনি আলোচনায় এসেছেন।
তানিম নূর যে স্মার্ট একজন পরিচালক তার একটা প্রমাণ দেখানো যাক। ‘উৎসব’ ছবিতে নব্বই দশকের একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে যেখানে সেই সময়ের ক্যাসেট দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। দোকানে প্রদর্শনের জন্য যাদের ছবি রাখা হয়েছে সেখানে শাহরুখ খান, আমির খানের পাশাপাশি আমাদের নব্বইয়ের আধুনিক তারকা সালমান শাহকে রাখা হয়েছে। সময়ের ট্রেন্ড ধরে দর্শকের কাছে সেরা বার্তাটা পৌঁছে দেয়ার যে দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন সেটি ছিল তাঁর স্মার্টনেস।
‘উৎসব’ ছবির প্লট ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্সের ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’ নামের নভেলা বা বড়গল্প থেকে নেয়া। সেদিক থেকে এটি সাহিত্যভিত্তিক ছবিও বটে। ইংরেজি গল্পের প্লটে দেশীয় ফ্লেবার দিয়ে পরিচালক তানিম নূর নিজের ক্রিয়েটিভিটিতে ছবিটি নির্মাণ করেছেন। গল্পটি যারা পড়েছেন ছবির থিম তারা বুঝতে পারবেন যারা পড়েননি তাদের জন্য কৌতূহল বেশি থাকবে।
‘উৎসব’ ছবির নামকরণের মধ্যেই উৎসবের একটা আমেজ রয়েছে। মাল্টিকাস্টিং হওয়াতে অনেক অভিনয়শিল্পীর সমাবেশ ঘটেছে যারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব চরিত্রে নিজেদের মেলে ধরার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। তাদের চরিত্রায়ণের মাধ্যমে উৎসবমুখর একটি পরিবেশ ছবিতে পরিপূর্ণভাবেই এসেছে। ছবির ট্যাগলাইন দেয়া হয়েছে ‘পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ’। ট্যাগলাইনেও ক্রিয়েটিভিটি ও শুভ বার্তা দেয়া আছে এবং ট্যাগলাইনটিও ছবির দর্শক তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
ছবির স্টোরি টেলিং অতীত ও বর্তমানের মাধ্যমে simultaneously এগিয়েছে। গল্প বলার ধরনে নাটকীয়তার সাথে প্রচুর ড্রামাটিক মনোলগ ব্যবহৃত হয়েছে যেখানে চরিত্রগুলো নিজের সাথে নিজের যুদ্ধে শামিল হয়েছে এবং এই প্রেজেন্টেশনের বিষয়টি ছবিটিকে নতুন একটি অ্যাপ্রোচের সামনে দর্শককে দাঁড় করিয়েছে। দর্শক নতুনত্ব পেয়েছে।

ছবিতে নব্বই দশকের ইম্প্রোভাইজেশন ঈদ কার্ড, ক্যাসেট বিক্রি, নব্বই দশকীয় প্রেম, ‘আজ রবিবার’ নাটকের পুনরাবৃত্তি এসবের সাথে বর্তমানের অস্থির সময়ের বিনোদনের যে বড় সমস্যা তাকে যৌক্তিকভাবে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এই দাঁড় করানোটা ছবির কমেডির জায়গাকে স্ট্রং করে তুলেছে। নব্বই দশকের কমার্শিয়াল ছবির জোয়ারে নির্মিত বুক ভরা ভালোবাসা, পৃথিবী তোমার আমারের মতো ছবি ও রিয়াজ-শাবনূরের হলে লাগানো পোস্টার তুলে ধরাটা ছিল বিশেষ একটা ব্যাপার। কমেডিতে কোনো ভাঁড়ামির জায়গা নেই ছবিতে, দর্শক ন্যাচারালি হেসে যাচ্ছে এটা অনেকদিন পর কোনো ছবিতে এত ভালোভাবে ঘটেছে।
ছবিতে হরর যে অ্যাঙ্গেলটি রয়েছে সেটিও ক্রিয়েটিভ। ইন্টারেস্টিং ওয়েতে হরর অ্যাঙ্গেলটি দেখানো হয়েছে। তাদের অভিনয়ের ধরন দেখে দর্শক কনফিউশনের সাথে মজাটাও ব্যাপকভাবে উপভোগ করবে এটা সম্পূর্ণ নতুন ছিল।
মাল্টিকাস্টিং ছবি হিসেবে এ ছবিতে জাহিদ হাসান, তারিক আনাম খান, আজাদ আবুল কালাম, আফসানা মিমি, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, অপি করিম, ইন্তেখাব দিনার, সাদিয়া আয়মান, সুনেরাহ বিনতে কামাল, সৌম্যজ্যোতি এভাবে সেকাল-একাল মেলবন্ধন ঘটেছে। জাহিদ হাসান সবচেয়ে ফোকাস। তাকে অনেকদিন বাদে কেউ এত যত্ন করে তুলে ধরতে পেরেছে চলচ্চিত্রে এবং জাহিদ তার চরিত্রে অতুলনীয় ছিল। চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান ও অপি করিম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিল। চঞ্চলের বডি ল্যাংগুয়েজ ও অভিনয় ব্যতিক্রমী, জয়া ও অপি ইন্টারেস্টিং চরিত্রায়ণে ছিল। নব্বই দশকীয় ফ্লেবারে সাদিয়া আয়মান ও সৌম্যজ্যোতি অনেক প্রশংসা পাবে। সুনেরাহ বিনতে কামাল ‘দাগী’ ছবির পাশাপাশি এ ছবিতেও সুন্দর চরিত্র পেয়েছে এবং ন্যাচারাল।
self troll, self judgement, self purification এগুলোর ইউনিক প্রেজেন্টেশন আমাদের চলচ্চিত্রে নেই বললেই চলে। অভিনয়শিল্পীরা তাদের নিজের চরিত্রকে নিজেই ট্রল করছে এমন অ্যাপ্রোচ কোথায় কবে পেয়েছি আমরা? জয়া ও জাহিদ হাসানের কথোপকথনে আসে সেটি :
জয়া আহসান কত সুন্দর অভিনয় করে
জয়া আহসান? ওর কোনো অভিনয় হয়? ডায়লগ ডেলিভারি হয় ওর? চিৎকার করে বলে ‘মারো’ (হাসির সাথে)। ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি’ ছবির সেই সমালোচিত সংলাপ দিয়ে নিজে নিজেকে ট্রল করছে। এটা ছিল নতুন উদাহরণ আমাদের চলচ্চিত্রে।
সংলাপের ব্যবহারে অসাধারণভাবে ক্রিয়েটিভিটির পরিচয় দেয়া হয়েছে। যেমন :
দুইদিনের দুনিয়াতে ছুটি নিবেন তিনদিনের?
ডানা থাকলেই উড়তে হয় না যতই আকাশটা খোলা থাকুক।
লাগাম টানতে জানতে হয় তাহলে নাগাল পাওয়া যায়।
আমি আসলে নিজেকে এতদিন সালমান শাহ ভেবে এসেছি কিন্তু আমি আসলে তা নই।
আসলে প্রধান অভিনেতা বলে কিছু নেই আমরা সবাই সাপোর্টিং একজন আরেকজনকে সাপোর্ট করছি।
আমাদের বাস্তবতা অবস্থা হলো আমাদের রাজনীতির মতো কোনো গ্যারান্টি নেই।
গানের মধ্যে আর্টসেলের ‘ধূসর সময়’ বেস্ট। এছাড়া ‘তুমি’ বেশ রোমান্টিক গান।
‘উৎসব’ যেভাবে ফ্যামিলি অডিয়েন্সের ছবি হয়েছে তাতে সামনের দিনগুলোতে এমন সুস্থ বিনোদনের ছবি আরো অনেকে নির্মাণ করতে চাইবে। তাদের জন্য এ ছবি রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে।
‘উৎসব’ এই অভূতপূর্ব জার্নিতে ইন্ডাস্ট্রির নতুন দিনের ট্রেন্ড সেটার ছবি হয়ে থাকবে।
রেটিং – ৯/১০