অশ্লীলতা: খারাপরা না হয় খারাপই, ভালোরা তখন কোথায় ছিলো?
অসত্য কীভাবে বলি! নিজেকে লুকিয়ে কীভাবে বনে যাই সাধু পুরুষ! সে সময় দশ ক্লাসে উঠে গেছি। তখনও প্রেমে পড়ি নাই। প্রেমে পড়ার কথাটা বলছি এ কারণে, প্রেমে পড়ার পর বাঙলাদেশের সিনেমা-টিনেমা আমাকে আর টানে নাই। প্রেমে পড়ে আমি কতকটা শুদ্ধাচারি হয়ে গিয়েছিলাম। আর চলে গিয়েছিলাম অন্য এক পৃথিবীতে। আমি যেন একই সাথে দুই পৃথিবীতে বসবাস করতে থাকি সে সময়। যাইহোক, প্রেম নিয়ে বলতে চাই না। বলতে চাচ্ছি বাঙলাদেশের সিনেমা নিয়ে। বিশেষ করে বাঙলাদেশের অশ্লীল সিনেমা নিয়ে। আমি কী করে অস্বীকার করবো, সেই কৈশোরের ঘ্রাণ লাগা বয়সে তখনও শিখি নাই শরীরের অভিজ্ঞান।
স্কুল-টুল পালিয়ে দুয়েকটা সিনেমা আমিও দেখেছি, চুপচাপ। তো আমরা বলি নব্বই দশকের শেষ দিকে আমাদের সিনেমা অশ্লীলতার দিকে চলে গেছে। অশ্লীল সিনেমার পরিচালক-খ্যাত মোহাম্মদ হোসেন বলেছিলেন, অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। আমি তার সাথে একমত নই। কারণ আমার কাছে সেসময়কার ডিপজলের চোখের তাকানো। কথা বলার স্টাইল অশ্লীল বলে মনে হয়েছে।
আমাকে ক্ষমা করবেন, নারীর শরীরকে আমার কখনও অশ্লীল মনে হয়নি। অশ্লীল মনে হয়েছে শরীরের উপস্থাপনাকে। যেমন কোন এক সিনেমায়, নাম ভুলে গেছি, নায়ক মেহেদী আর নায়িকা নিশি কোন এক গানের দৃশ্যে একটা বালিশকে দুজনে দুপায়ের মাঝখানে রেখে এমনভাবে টানাটানি করছিলো যে দেখে অশ্লীল মনে হয়েছিলো।
অথচ নিশি খুব সুন্দর একটি মেয়ে। চুম্বন বা যৌনতা তো অশ্লীল নয়। পৃথিবীর সিনেমায় এইসব কত শত দৃশ্য শিল্প হয়ে উঠেছে। অথচ বাঙলাদেশের সেসময়কার সিনেমায় যে নগ্ন দৃশ্যগুলো ছিলো সেগুলো সত্যিকার অর্থেই অশ্লীল হয়ে ওঠে। এর কারণ এদেশের মানুষ কখনওই যৌনতাকে প্রকাশ্যে নিতে শেখেনি। সবটা প্রকাশ করতে না পেরে, আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে গিয়ে সুরসুরির মতো অশ্লীল হয়ে গেছে। আর নির্মাতাদেরও ছিলো স্থূল রুচি। নাহলে নিশা কোটারির চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলো না আমাদের নিশি।
আমি যদি বলি ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শহীদুল ইসলাম খোকনের বিপ্লব সিনেমায় অশ্লীল দৃশ্য ছিলো বিশ্বাস করবেন? দৃশ্যটা এইরকম— নায়ক রুবেল এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ঠোঁট মিলাচ্ছেন ‘পয়লা নম্বর দুধের লাগি জিভ করে লকলক’। রুবেল নায়িকা জিনাতের ওড়না টেনে ধরে দুই স্তনের দিকে জিভকে লকলকিয়ে দেয়। দৃশ্যটা মূলত অশ্লীল।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া শেষ খেলা ছবিতে চম্পার ক্লিভেজ দেখা যায় একটা দৃশ্যে। তারপর বাংলার কমান্ডো সিনেমায় শিল্পীর বৃষ্টি ভেজা দৃশ্য। কিংবা অবুঝ দুটি মন সিনেমায় চাঁদনীর সুইমিং সুট পরা কিছুই অশ্লীল মনে হয়নি। তো অনেককেই বলতে শুনি বাঙলাদেশের সিনেমায় নায়িকা অঞ্জুর নাচে অশ্লীলতা ছিলো। যদিও আমি নব্বই পরবর্তী সিনেমা নিয়েই মূলত কথা বলতে চাই, তথাপি আমি এই ব্যাপারটিকে অস্বীকার করতে চাই।
আমার মনে হয়, অঞ্জু নয়, নায়ক জাভেদের নাচের ভঙির চেয়ে অশ্লীল আর কিছুই হতে পারে না। অঞ্জুর প্রসঙ্গে যেহেতু এসেছি এইখানে এইটুক বলে ফেলতে চাই। বেদের মেয়ে জোসনা বাঙলাদেশের সিনেমার জগতে সবচেয়ে হিট সিনেমা। এ হিট হওয়ার পেছনে তিনটি বিষয়কে আমি সামনে রাখতে চাই। বলে রাখি সিনেমাটি আমি দেখি নাই। না দেখেই আমি এ মন্তব্য করতে চাই। ছবিটা যখন মুক্তি পায় আমার বয়স তখন হয়তো ৫ বছর। তখন আমি গ্রামে থাকি। আমার মনে আছে সে সময় একটা রটনা ছড়িয়ে পড়েছিলো আমাদের এলাকায়, পরে শুনেছি এমন রটনা প্রায় সব এলাকাতেই ছড়িয়েছিলো। এই সিনেমা চলা সময়ে অঞ্জু ঘোষের বীনের শব্দে সিনেমাহলে সাপ চলে এসেছে- এমন রটনা আমি শুনেছি ফুলপুর, পূর্বধলা এবং ঈশ্বরগঞ্জে। দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে সে সময় গ্রাম বাংলায় মুজিব পরদেশী ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তো বেদের মেয়ে জোসনায় আমি বন্দী কারাগারে গানটা আগে থেকেই মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিলো। ফলত এই গান বা মুজিব পরদেশী বেদের মেয়ে জোসনাকে সুপারহিটে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। আর শেষ বিষয় যেটি হচ্ছে, তা হলো সিনেমার পোস্টার। ফনাতোলা সাপের সামনে দাঁড়ানো অঞ্জুও যেন আর এক ফনাতোলা সাপ। কেবলই আকর্ষণ করে ছোবল খেতে।
যাইহোক, বলছিলাম বাঙলাদেশের সিনেমার অশ্লীল যুগ নিয়ে। আমি মনে করি, বাঙলাদেশের সিনেমা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছনে অশ্লীলতার কোন দায় নাই। অশ্লীলতা ছিলো টিকে থাকার একটা প্রচেষ্টা। আসলে সিনেমাই ছিলো না আমাদের। সিনেমা জগৎ দখল করে রেখেছিলো দুর্বৃত্তরা। ওদের না ছিলো শিল্পবোধ, না ছিলো রুচি বোধ। ২০০০ সাল পর্যন্ত ওরা বস্তাপচা যা বানিয়েছে মানুষ দেখেছে। কারণ তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলো না। যখন মানুষ হাতের কাছে বিনোদন পেয়েছে, স্যাটেলাইট টেলিভিশনে ঘরে বসে বিদেশী সিনেমা দেখে ফেলেছে। তখন কেন দেখবে মানুষ নতুন গল্পহীন এইসব সিনেমা বছরের পর বছর!
কিছুটা উন্মুক্ত শরীর দেখানোয় মৃত্যুর মুখে সুপারহিট হয়ে যাওয়ার পর এই ধরনের সিনেমা নির্মাণ হতে থাকে। রানী কেন ডাকাত, জবর দখল, রাজা, মরণ কামড় ইত্যাদি। এইসব সিনেমার গল্প ভারতীয় সিনেমা থেকে টুকলিফাই করা। আর এসব সিনেমার কারণে মুনমুন নায়িকাদের মাঝে এক নম্বরে চলে আসেন। মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা ছিটকে পড়েন। কথিত অশ্লীল ছবিগুলোর মাঝে দেখলাম শান্ত কেন মাস্তান সবচেয়ে হিট। শান্ত কেন মাস্তান ছবির মূল নায়ক মান্না হলেও এ সিনেমা হিটের পেছনে ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি ও নাসরিন। আমরা যেটাকে অশ্লীলতা বলছি, সেটার শিল্পীত সূচনাকারী পুরুষ চরিত্র হুমায়ুন ফরীদি। রাঙা বউ সিনেমায় তিনি যেভাবে ঋতুপর্ণার নাভিমূল থেকে সোমরস পান করে নেন, বাঙলাদেশের সিনেমায় এমন দৃশ্য আগে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। হুমায়ুন ফরীদি শিল্পী ছিলেন হেতু তার এইসব চরিত্রের সাথে মিশে যায়, তিনি উতরে যান। কিন্তু ডিপজল যার সমস্তটাই অশ্লীল, সে যখন বলে পুত করে দেবে, কিংবা সিস্টেম করে দেবে। তখন সেটা অশ্লীলতর হয়ে ওঠে।
কোন কোন সিনেমায় মুনমুনের চেয়েও খোলামেলা হয়ে ওঠেন পপি। তবে বলে রাখা, ভালো মুনমুন আদতে ওতো খোলামেলা ছিলেন না। যতোটা ছিলেন ময়ূরী। শব্দটা খোলামেলা না বলে অন্য কিছু একটা বলতে পারলে ভালো হতো। প্রথম দিকে পপি ছিলেন সুন্দর। যেমন লাল বাদশা সিনেমায় কিংবা হীরা চুনি পান্নায়। কিন্তু ক্রমশই পপি মুটিয়ে যান। এবং বস্তির রানী সুরিয়াতে আপনাদের যদি দেখতে রুচি হয়, তাহলে দেখবেন কীএক্টা অবস্থা!
কারো কাছে কি আমি শুনেছি, কিংবা আমিই ভেবেছিলাম কিনা! মুনমুন ময়ূরী আমলে মোটা নায়িকার চাহিদা বেড়ে যায়। এর কারণ তখন যে দর্শকশ্রেণি সিনেমা হলে অবশিষ্ট ছিলো, তাদের কাছে মোটা নায়িকাই প্রিয় ছিলো, যেহেতু তাদের ঘরে থাকা নারীটি মেদহীন, সেহেতু মেদময় নারীই তাদের ফ্যান্টাসিতে থাকতে পারে।
আপনারা অনেকেই আলেকজান্ডার বোকে অশ্লীল সিনেমার নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেন। আলেকজান্ডার বো’র আগমন শহীদুল ইসলাম খোকনের হাত ধরে। ১৯৯৬ সালে লম্পট সিনেমায় আমরা তাকে দেখি। এরপর ম্যাডাম ফুলি। আলেকজান্ডার বো রুবেলের বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। কিন্তু সময় তাকেও গিলে ফেলে। সময়টাই এমন ছিলো। কিছুটা শরীর দেখানোর ব্যাপার সেপার চলে এসেছিলো। প্রশ্ন হচ্ছে খারাপরা না হয় খারাপই ছিলো, ভালোরা তখন কোথায় ছিলো? আদতে ভালো যারা ছিলো, তারা ভালো ছিলো না। তারাও মূলত টুকলিফায়ার, নকল সিনেমাই বানাতো।
আমি বলতে চাই, কথিত অশ্লীল সিনেমার সময়ের সিনেমাগুলো অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করা হোক। ইতিহাসের কাছে একদিন ওগুলোও খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
নব্বই দশকের সিনেমা নিয়েই কথা বলতে চেয়েছিলাম সময়ে সময়ে। এরপরের সিনেমা নিয়ে কথা বলার জন্য একটু সময় নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি পৃথিবীর কোন এক ইমরুল হাসান ভাইয়ের সিনেমা বিষয়ক লেখা পড়ে এই কথাগুলো বলে ফেলতে ইচ্ছে হলো।