Select Page

আমার একান্ত শাবনূর

আমার একান্ত শাবনূর

আমার একান্ত শাবনূর আমার চিন্তার জগতে আমার মতো প্রিয়। সেখানে সে একা আলাদা।

আমার একান্ত শাবনূর তার প্রথম ছবির মধ্য দিয়েই শুরু। সেই যে ‘কথা যদি শুরু করি শেষ তো হবে না/আগুন যদি জ্বালি নেভানো যাবে না’ গানটি দিয়েই শুরু। প্রথম ছবিতেই তার অভিনয় এ গানে অনেকগুলো গানে অভিনয় করার মতোই পরিণত। গানটি যেন তার লম্বা ক্যারিয়ারের ইঙ্গিতই দেয়।

আমার একান্ত শাবনূর চরিত্রের শাবনূর, অভিনয়ের শাবনূর, নাচের শাবনূর, বিজ্ঞাপনের শাবনূর। সবখানে তার অনন্যতার মাঝে একান্ত ভালোলাগার জন্ম দেয়। ‘গায়ে হাত দিও না তো মা, গায়ে হাত দিলেই পুরুষের হাত বলে মনে হয়’ এ সংলাপে ‘নিরন্তর’-এর শাবনূরকে মনে পড়ে যে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তার অভিনয়শক্তি বুঝিয়ে দেয়। ‘বাঙলা’-র শাবনূর বোবাকালার ভাষায় উনসত্তরের গণঅভূত্থানের চেতনা বুঝিয়ে দেয় যার কথা বলতে চাওয়ার সুনিপুণ আবেগ যেন কথা বলতে পারা মানুষদের থেকে তাকে ভিন্ন করে তোলে। ‘দাঁড়াও বন্ধু বহুদিনে পাইছি তোমার লাগ/শেষ বিচারে দেখাইব গো বুকের পোড়াদাগ’ এই গানে গানে নিজের অসহায় অস্তিত্বকে জানিয়ে দেয় যে শাবনূর ‘কাল সকালে’ ছবিতে সে শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর। প্রেমের কাঙাল হয়ে তিন সতীনের সংসারে চার সতীন হয়ে যে শাবনূর গিয়েছিল আর শেষবেলায় এসে মাঝি মাহফুজের মুখে প্রেম ও বিয়ের কথা জানতে পেরে আকুতি স্বরে বলে ‘তাহইলে আর দেরি ক্যান, মাঝি’ সেই শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর। সেই শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর যে পরিবারকে রক্ষা করতে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতেও পিছপা হয়নি সেই সেজুঁতিরূপী ‘দুই নয়নের আলো’-র শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর।

সেই শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর যে কমার্শিয়াল ছবির অভিনয়কেও শিল্পে পরিণত করেছে। কমার্শিয়াল ছবি দেখে যারা নাক সিঁটকানোর সুযোগ খোঁজে শাবনূরের কমার্শিয়াল ছবিগুলো তাদেরকে সে সুযোগ দেবে না। ‘মোল্লাবাড়ির বউ’-এর চটপটে কিন্তু গভীরভাবে কাঠমোল্লার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শাবনূর কমিক অভিনয়ে কমার্শিয়াল ছবিকে শৈল্পিক করে তুলেছে। সালমান শাহ-র বিপরীতে তার সব ছবিরই শৈল্পিকতা বিদ্যমান কারণ জুটি হিসেবে আইকনিক। সালমানের সাথে জুটির সেই শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর। ‘আনন্দ অশ্রু’-র ভালোবাসাকে হারিয়ে আবার মর্মান্তিকভাবে তার মুখোমুখি হওয়া শাবনূর, ‘তোমাকে চাই’-এর প্রেয়সী হয়ে প্রেমিক সালমানকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস যোগানো সামান্য মালা ও নূপুরে খুশি থাকা শাবনূর, ‘বিক্ষোভ’-এর সেই সন্ত্রাস দমনে একাত্তরের মুক্তিসেনাদের আবার ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের শাবনূর, ‘সুজন সখি’-র সুজনের প্রেমে আবহমান বাঙালি নারীর প্রেমদরদী শাবনূর, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’-র প্রেমপরীক্ষায় আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া আগুনরূপী বাস্তবের সাথে লড়াই করা শাবনূর, ‘জীবন সংসার’-এর জ্বলেপুড়ে মরার মাঝে ভালোবাসার সুখ খোঁজা শাবনূর, ‘প্রেম পিয়াসী’-র সমাজবাস্তবতার কাছে পরাজিত শাবনূর, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’-র স্টাইলিশ শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর।

রিয়াজ, শাকিল, শাকিব খানের সাথে সফল জুটির শাবনূরও আমার একান্ত শাবনূর। সেই ‘নারীর মন’-এর শাবনূর যার ষোড়শী হয়ে ওঠা রূপমাধুর্যে রিয়াজ, শাকিল তারুণ্যের প্রতিনিধি হয়ে পর্দায় আমাদের বয়সকে তুলে ধরেছিল এবং কলেজ রোডের সেই এন্ট্রি সিনে অভিনব আগমনের শাবনূর হৃদয়কে রোমান্টিক করে একান্ত শাবনূর হয়ে ওঠে। ‘বিয়ের ফুল-এর সেই শাবনূর একান্ত শাবনূর হয়ে ওঠে যে ত্রিভুজ প্রেমের বাস্তব চক্রে আবর্তিত হয় যা অনেকের জীবনে সত্যিই ঘটে যায়, ‘মাটির ফুল’ ছবির সেই শাবনূর একান্ত শাবনূর হয়ে ওঠে যার পরিচয় আসে এভাবে-‘বাগানে ফুল ফোটে গোলাপ, রজনীগন্ধা মনের বাগানে যে ফুল ফোটে সে ফুল মাটির ফুল।’ ‘মিলন হবে কত দিনে’-র শাবনূর একান্ত শাবনূর হয়ে ওঠে যে নিঃসঙ্গতা প্রকাশে গীটারে সুর তোলে, ‘কে অপরাধী’-র সেই শাবনূর একান্ত শাবনূর হয়ে ওঠে যে ভালোবাসা পেয়েও নিয়তির হাতে পড়ে শেষ হয়ে যায়, ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’-র শাবনূর একান্ত হয়ে ওঠে যে মান্নার বিপরীতে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিয়ে পর্দা মাত করে দেয়, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’-র শাবনূর একান্ত হয়ে ওঠে যে স্বামীর সংসারকে বাঙালি নারীর প্রকৃত আশ্রয় হিসেবে বরণ করে নেয় প্রেমিক শাকিব খানের অকস্মাৎ আগমনেও যার কোনো বদল হয় না।

নাকে নেই ফুল কানে নেই দুল/ গলাতে নেই কোনো হার, / পরো নাকো টিপ মাখো না কাজল/ দেখেছি তোমায় যতবার

এই সাদামাটা রূপের শাবনূর একান্ত শাবনূর যাকে সাদামাটাতেই সর্বাঙ্গসুন্দর মনে হয় আমার। তার বেশি না সাজলেও চলে। ন্যাচারালিটির শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর।

গানের শাবনূর নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে রূপের বর্ণনার বেশি সংখ্যক গান। উপমার কাব্যিক প্রয়োগের সেসব গানের শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর। ‘ফুল নেবো না অশ্রু নেবো’-র ‘দুধে আলতা বদন তোমার’ গানের সেই উপমা-‘দুধে আলতা বদন তোমার, চন্দনের সুবাস ভরা/দুটি দীঘল কাজল আঁখি, যেন মেঘের কাজল পরা/তোমার নরম দুটি ঠোঁটে, ফোটে লাল পদ্মফুল/যেন রেশমি সুতোর গোছা, তোমার মাথার ওই না চুল।’ এই উপমা না ভালোবেসে কী পারা যায়! ‘আমার স্বপ্ন তুমি’-র ‘আলতা রাঙা দুটি ভেজা ভেজা ঠোঁট, ও চোখে কী যে মায়া!/কোকিলার মতো সুরে সুরে কথা কয়, চাঁদেতে মেঘের ছায়া/সবুজ ঘাসে পড়লে চরণ শিশিরবিন্দু হয় উদাসী।’ তারপর ‘সবার অজান্তে’-র ‘আমি করব তারে বউ’ গানের উপমা-‘কথা যদি বলে সে ঝরে হাসির বৃষ্টি, প্রাণটাকে ঘায়েল করে হরিণ হরিণ দৃষ্টি’ কিংবা ‘এলোমেলো চুলে যার খেলে দখিন হাওয়া /কামরাঙা ঠোঁট দুটি শিশিরেতে ধোঁয়া’। ‘নদীর পানিরে’ গানের এ উপমাগুলো-‘ঢলো ঢলো অঙ্গ তার পাগল করা হাসি/একবার দেইখে মনে যে লয় তারে ভালোবাসি/চঞ্চল ঐ নয়ন বাণে আমায় মাইরাছে’ কিংবা ‘লজ্জাবতী কয় না কথা চুপ করিয়া রয়/কোনো কথা না কইয়াও য্যান অনেক কথা কয় সে অনেক কথা কয়।’ আহা! এ যেন সাক্ষাৎ মনের মাধুরী মেশানো রূপের বর্ণনা!

‘ভালোবাসা কারে কয়’ ছবির এ উপমাগুলো-”যার হাসিতে ফোটে রে ফুল, কাঁদলে বৃষ্টি ঝরে রে/

যার কথা শুনলে মনে হয়, কোকিলা সুর ঝরে রে।’ এই উপমাসমৃদ্ধ গানের শাবনূর আমার একান্ত শাবনূর। ইউটিউব প্লেলিস্টে ধারাবাহিক বাজতে থাকা প্রিয় গানের শাবনূরও আমার একান্ত শাবনূর।

আমার একান্ত শাবনূর নাচের অপার মুগ্ধতায় গড়া।

শাবনূরের নাচের গানগুলো দেখার সময় মনে হয় নজরুলের ঐ গানটা ব্যাকগ্রাউন্ডে শুনেই যাচ্ছি শাবনূরের নাচের সাথে-‘মম চিত্তে কে যে নাচে, তা তা থৈ থৈ’..

‘বিয়ের ফুল’ দিয়ে শুরু করি। ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’ গানে শাকিল খান গীটার বাজাচ্ছে আর শাবনূর নাচতে নাচতে স্টেজে উঠে আসছে। নাচের সাথে নূপুর আর অন্য অলংকারের যে গুঞ্জন তাতে শাবনূরের নাচ হয়ে উঠেছে মোহনীয়। এ এক অপার মুগ্ধতা!

‘এই মন চায় যে’ ছবির কথা বলি। তুলনা দিতে ব্যস্ত যখন ভক্তরা হিন্দিতে ঐশ্বরিয়ার ‘নিমুড়া’ বেশি ভালো নাকি বাংলায় শাবনূরের ‘নিমুড়া বা লেবু’! রণে ভঙ্গ দিয়ে বলতে থাকি বাংলায় শাবনূরের নাচ শাবনূরের গুণে এগিয়ে ঐশ্বরিয়ার সাথে তুলনার দরকার কি! মুদ্রাগুলো কেমন এঁকেবেঁকে চলে যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা আর নাচের কারুকার্যভরা শাবনূরকে দেখে বারবারই মনে হয় বাফায় নাচ শেখা তার সার্থক। এ এক অপার মুগ্ধতা!

বলি ‘নারীর মন’-এর কথা। ‘জীবনে বসন্ত এসেছে’ অদ্ভুত সুন্দর এ রোমান্টিক গানে শাবনূরের নাচ মনকে মুহূর্তে রোমান্টিক করে দিতে যথেষ্ট।

প্রথম ছবি ‘চাঁদনী রাতে’-র কথা বলি সেই প্রিয় গানটি-‘কথা যদি শুরু করি শেষ তো হবে না’। প্রথম ছবি হিসেবেও শাবনূরের নাচে চোখ আটকে যায়। কে বলবে এটা প্রথম ছবি!

‘প্রেমের অহংকার’ ছবির ‘জীবন যতই হোক না ছোট আশা অনেক বড়’ এ গানটিতেও শাবনূরের নাচ দৃষ্টিনন্দন।

‘আনে রূপের চমক তিব্বত বিউটি কেয়ার সোপ’ এই জিঙ্গেলে চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে তিব্বত বিউটি কেয়ার সোপের শাবনূর টিভিপর্দার একান্ত শাবনূর।

আমার একান্ত শাবনূর শাবনূরের কাজ দিয়েই শাবনূরকে বড় করার মধ্যে নিহিত, আমার একান্ত শাবনূর অন্য তারকাকে ছোট করে তাকে বড় করার মধ্যে নিহিত নয় বরং অন্যদের প্রাপ্য সম্মান দেয়ার পাশাপাশি শাবনূরকে তার কাজ দিয়ে সম্মান দেখানোর মধ্যে নিহিত।


About The Author

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

Leave a reply