Select Page

গীতিকার, সুরকার ও নির্মাতার কালজয়ী মেলবন্ধন

গীতিকার, সুরকার ও নির্মাতার কালজয়ী মেলবন্ধন

সিনেমার আড্ডায় প্রায়ই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হই- কেন আগের মতো কালজয়ী গান আর হয় না? আমার উত্তরটা থাকে খুবই বাঁধাধরা। মেধাবী শিল্পীরা এখন বিচ্ছিন্ন। গীতিকার, সুরকার ও নির্মাতার মধ্যে কোনো মেলবন্ধন নেই। এই ত্রয়ীর মধ্যে নেই কোনো সৃজনশীল গাঁটছড়া। গান এখন অনেক বেশি ব্যক্তিগত পেশাদারিত্বের জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে। সম্মিলিতভাবে শিল্পসৃষ্টির তাড়না না থাকায় কালকে অতিক্রম করার মতো গান বেরিয়ে আসছে না।   

আসুন, দৃষ্টান্ত দিয়ে কথা বলি। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ও খোন্দকার নুরুল আলম ছিলেন অসাধারণ এক গীতিকার-সুরকার জুটি। তাদের দুজনের রয়েছে অনেক শ্রুতিমধুর গান। কিন্তু এই দুজনের সঙ্গে যখন জুড়ে যান নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম, তখন চলচ্চিত্রের গানের ইতিহাসে এক বিস্ফোরণ ঘটে। আশির দশকে বেশকিছু কালজয়ী গান বেরিয়ে আসে তাদের যুথবদ্ধ চেষ্টায়।   

চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৮২ সালে ‘দেবদাস’ ছবি দিয়ে শুরু করেন তার সাহিত্যভিত্তিক ছবির আশ্চর্যজগৎ। এই ছবিতেই প্রথমবার একত্র হন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, খোন্দকার নুরুল আলম ও চাষী নজরুল ইসলাম। এ ছবির গানগুলো দর্শক-শ্রোতাদের আজীবন মুগ্ধ করে যাবে। সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘জনম জনম ধরে প্রেমপিয়াসী দুটি আঁখি নিশি জাগে’, রুনা লায়লার গাওয়া ‘নিজের বুকে আগুন জেলে রঙিন আলো হয়ে জ্বলি আমি’, রুনা লায়লা ও সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘বলো কে বা শুনেছে এমন পিরিতি কথা’ এবং সুবীর নন্দীর গাওয়া  ‘মনরে ওরে মন সুখ পাখি তোর হইল না আপন’ প্লেব্যাকের ভুবনে পেয়েছে স্থায়ীত্ব।

এরপর ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে আবারও জোটবদ্ধ হন এই তিন ব্যক্তিত্ব। এবার তারা উপহার দেন বহু বছর টিকে থাকার মতো কয়েকটি গান। এগুলোর মধ্যে বলতে হয় সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘এই হৃদয়ে এত যে সুখের কাঁপন’ এবং প্রবাল চৌধুরীর গাওয়া ‘ফুলের বাসর ভাঙল যখন স্মৃতি কেন বেদনার বাসর সাজায়’ গানের কথা।

১৯৮৬ সালে আবারও শরৎচন্দ্র, আবারও ত্রিরত্নের সংগীতবিহার। ‘শুভদা’ ছবিতে আমরা পেলাম নীলুফার ইয়াসমীনের ব্যতিক্রমী কণ্ঠে গাওয়া সেই বেদনাবিধুর গান ‘বুঝি কান্নাই লেখা ছিল ভাগ্যে আমার’। আরও পেলাম সুবীর নন্দীর মধুমাখা কণ্ঠে গাওয়া ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে’। এই ছবিতেই শ্রোতাপ্রিয় হয় শিল্পীর আরো একটি চমৎকার গান ‘হায়রে অবুঝ নদীর দুই কিনার’।

১৯৮৯ সালে চাষী নজরুল শরৎচন্দ্রকে ছেড়ে গ্রহণ করেন বঙ্কিমচন্দ্রকে, ‘বিষবৃক্ষ’ অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘বিরহব্যথা’। কিন্তু ছেড়ে যান না নুরুল আলম ও রফিকউজ্জামানকে। এই ছবিতে সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই ‘ডেকে নাও গো আমায়’ গানটি।

১৯৯১ সালে শেষবারের মতো একসঙ্গে আসেন রফিকউজ্জামান, নুরুল আলম ও চাষী নজরুল। ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ছবিতে জনপ্রিয় হলো রুনা লায়লা ও অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া রোমান্টিক প্রেমের গান ‘অন্তর জ্বালাইয়া প্রেমেরই আগুনে তুমি আমি হইলাম খাঁটি সোনা’।

এবার শুনি তাদের পুরস্কারের গল্প। ‘চন্দ্রনাথ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান খোন্দকার নুরুল আলম, সাবিনা ইয়াসমীন ও মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। ‘শুভদা’ ছবির জন্য্ একই পুরস্কারে আবার ভূষিত হন খোন্দকার নুরুল আলম, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তাদের সঙ্গে এবার যোগ দেন চাষী নজরুল ইসলাম, সুবীর নন্দী ও নীলুফার ইয়াসমীন।  ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ছবির জন্য খোন্দকার নুরুল আলম পুরস্কার পান।

 আমাদের সংস্কৃতির তিন গুণীজনকে নিয়ে আজ এই পোস্ট লেখার কারণ, আজ একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। ২০২৪ সালের জন্য ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কারে নাম এসেছে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের। এর আগে ২০০৮ সালে একুশে পদক পান খোন্দকার নুরুল আলম। ২০০৪ সালে একুশে পদকে সম্মানিত হন চাষী নজরুল ইসলাম। আজকে এই ত্রিরত্নকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুটি পুরস্কারে ভূষিত হতে দেখে খুব ভাল লাগল। অপ্রাপ্তি আর অবমূল্যায়নের দেশে আমাদের সিনেমার গানে মুগ্ধতা-ছড়ানো তিন মহৎপ্রাণকে স্বীকৃতি পেতে দেখে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম। আহা, সিনেমার গানের কী দিন ছিল!  কত গুণীরা জড়িত ছিলেন প্লেব্যাকের সঙ্গে! কেমন সব কালোত্তীর্ণ গান হত!।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহফুজুর রহমান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন