Select Page

আর্ট-কমার্শিয়ালের অতিচর্চায় মার খায় জনরুচি

আর্ট-কমার্শিয়ালের অতিচর্চায় মার খায় জনরুচি

আমার লেখাটি লেখার কারণ হলো— গতকাল ইউটিউব ঘাটতে গিয়ে কলকাতার একটা টিভি টকশোর (অপুর সংসার) ক্লিপ দেখলাম শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থাপনায় যদিও নামটা জানি না। সেখানে অতিথি ছিলেন কৌশিক ব্যানার্জি-লাবণী দম্পতি।

এক.

আমাদের দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবসা করা চলচ্চিত্র হলো ‌‘বেদের মেয়ে জোসনা’। ছবিটির পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল। পরবর্তীতে ছবিটা কলকাতায় রিমেক করা হয় এবং সেটা পরিচালনা করেন বাংলাদেশের পরিচালক-প্রযোজক মতিউর রহমান পানু এবং অভিনয় করেন চিরঞ্জিত,অঞ্জু ঘোষ ও কৌশিক ব্যানার্জি। সেটাও কলকাতায় রেকর্ড ব্রেকিং সাকসেস পায়। কলকাতায় অনেক হলে মাসের পর মাস ছবিটা চলে। সে জনপ্রিয়তার সূত্রে কলকাতায় থিতুও হন অঞ্জু।

দুই.

কৌশিক ব্যানার্জির কন্ঠে শোতে বলা ১৯৯০ এর আশেপাশের একটা ঘটনা— তখন চারদিকে রমরমিয়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলছে। এমনি একদিন আমি মানিকবাবুর (সত্যজিৎ রায়) বাড়িতে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমরা নাকি একটা ছবি করেছো লোকে খুব দেখছে, তা ছবিটার গল্পটা একটু বলো তো।’ আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাবছি কি বলব! মানে সত্যজিতের সামনে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র এই সাঁপুড়ের বীণ বাজানো, ধরে জেলে বন্দি করা এসব কখনো যায়? তাই আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না, ওসব আপনি কি শুনবেন। সেই রকম মানসম্মত কোন ছবি না। মানে…’ তিনি (সত্যজিৎ) আমাকে থামিয়ে দিয়ে, ‘না না না, তুমি এভাবে বলতে পারো না। ছবিটা লোকে দেখছে তার মানে এতে কিছু একটা আছে যেটা মানুষকে টানছে। সেইরকম স্পেশাল কী আছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।’

তিন.

জ্বি ভাই, আমি আজকে ক্লাস ও মাসের (গণ) সেই ক্ল্যাশ অব টাইটানস্ নিয়ে কথা বলব। আমাদের দেশে কমার্শিয়াল ছবিকে ‌‌‘রিকশাওয়ালার ছবি’ বলে যেমন নাক সিঁটকানো হয় তেমনি অপরপক্ষ আর্ট ফিল্মকে নাটক, আঁতেল ছবি বলার প্রবণতাও ব্যাপক।

চার.

আমার পোস্ট এই নাক সিঁটকানো ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের নিয়ে, কারণ অপর পক্ষের কাছ থেকে আমার আশা সম্পূর্ণ জিরো। তা এই পরিচালকরা নাক সিঁটকানোর সময় নিজেকে সত্যজিতেরও উর্ধ্বে মনে করেন। ওইদিন একজন দেখলাম আবার সত্যজিতকেও আন্ডারস্টেইমেট করছেন। এই মহান ব্যক্তিরা আসলে সত্যজিতের চেয়েও ট্যালেন্ট কি না!

পাঁচ.

আমাদের এই পার্থক্য তৈরি করাটা সবদেশেই আছে। অনেকেই সেটা অস্বীকার করতে চান, কিন্তু সত্যিটা হলো অস্কারে যেসব ছবি পুরস্কার পায় আর যেসব ছবি বক্স অফিসে হুড়মুড় ব্যবসা করে তাদের মধ্যেই একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। অস্বীকার করলেই সেটা ডিঙানো সম্ভব নয়।

ছয়.

সব পরিচালকের নেশা থাকে তার ছবিকে সবচেয়ে বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে দেবার। কিন্তু আমার দেশের পরিচালকদের সেটা করলে বোধহয় জাত যাবে। একটা ছবি বানাবে যেটা টেকনিক্যাল দিক থেকে উইক (অজুহাতও হাজির- বাজেট সংকট), ব্লকবাস্টার-সিনেপ্লেক্স দুপুরের দিকে দুইটা শো, নেট খুঁজে খুঁজে বিশ্বের বড় বড় দেশের ছোট ছোট বেনামী উৎসবে ছবি পাঠিয়ে নাম করো, সর্বশেষে বাপ-দাদার চ্যানেলে প্রিমিয়ার করো। সার্কেল কমপ্লিট। কেনরে ভাই! দর্শকদের ডিঙিয়ে কি এলিট হওয়া যায়?

সাত.

একটা দেশের মানুষের রুচি উন্নত করতে গেলে সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের ভূমিকা সবার আগে। এখন যদি বলেন তাদের রুচি অত্যন্ত নিম্ন, সেটা আমি মেনে নিচ্ছি। তাই বলে তাদের রুচি উন্নত করার চেষ্টাও করবেন না? তারা যে ছবিটা পছন্দ করল তা ঠিক কী কী কারণে পছন্দ করল সেটাতো আপনি খুঁজে দেখতে পারেন। কোন কোন জায়গাটা আপনার সাথে কমন সেটা আপনি আপনার ছবিতে রাখতে পারেন। কোন কোন জায়গায় উন্নতির দরকার সেটা আপনি আপনার ছবিতে একটু আধটু চেঞ্জের মাধ্যমে দেখাতে পারেন (আবার আপনার ইন্টেলেকচ্যুয়ালিটির পুরো ডোজ দিতে যাবেন না)। আর যেটা একেবারেই অযোগ্য সেটা ফেলে দিন। দেখবেন আপনার ছবির দর্শক বাড়ছে। এই মাসই তো ছবির আসল পাওয়াররে ভাই। দাগটা টেনে তো অভিজাত হতে পারবেন না, উল্টো আরো অনেক সুযোগ খোয়াবেন। এই আভিজাত্য রক্ষার লড়াইয়ের কারণেই জীবদ্দশায় কোন প্রযোজক পাবেন না যিনি আপনার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবে না ‘একটা চাঁদের পাহাড় বানিয়ে দাওতো ভাই’। কারণ আপনার সেই ক্যাপাবিলিটি নেই। মনপুরা, ছুঁয়ে দিলে মন, আয়নাবাজি কিন্তু এই মাসকে কানেক্ট করতে পেরেছিল বলেই হিট করতে পেরেছিল। তাইতো ‘আয়নাবাজি’তে আয়নাকে যেকোনো মূল্যে জেল থেকে বের করাও তেমনি একটা কারণ (যদিও শুনেছি বাইরের ফেস্টিভালে এই গোঁজামিল দেখানো হয়নি) অস্বীকার করে আপনি কোথায় যাবেন?

আট.

উদাহরণের দরকার হলেইতো আমরা পাশের দেশে ছুটে যাই। সেখানে মালায়লাম আর মারাঠি নামে দুটো ইন্ডাস্ট্রি আছে। তারা তাদের নিউ-ওয়েব ফিল্মকেই মেইনস্ট্রিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে কেবলমাত্র মাসকে কানেক্ট করতে পারার জোরে। আর হ্যাঁ, নির্মাণের কথা বলবেন, সে আপনাদের চেয়ে ঢের ভালো। ২০১০ যখন তারা শুরু করে তখন অনেক বাধার মুখেই পড়েছিল। কিন্তু ওই যে, পায়ের তলার মাটিটা একটু একটু করে তৈরি করে নিয়েছিল। আরো উদাহরণ লাগবে? যে কলকাতার উচ্ছিষ্ট রিমেককে সম্বল করে বাঁচেন সেই ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু সৃজিত, কৌশিক, কমলেশ্বর, অরিন্দম, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায় নামে কিন্তু অনেকগুলো পরিচালক আছে। তারা এই জয় জয়কারটা করতে পেরেছে কিন্তু আরবান জনরার সাথে মাসকে কানেক্ট করার ফলে। তাইতো তারা একের পর এক বড় প্রজেক্ট দিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের একেকটা রিলিজ হচ্ছে উৎসবের মতো। তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু আর্ট-কমার্শিয়াল নিয়ে অতিচর্চা নেই। আছে ভালো ছবি-খারাপ ছবি নিয়ে, আছে মৌলিক রিমেক নিয়ে।

নয়.

মাসকে অস্বীকার করা অনেক বড় ভুল, তাই বলব যেদিন মাসকে নিয়ে চলতে শিখবেন সেদিনই আপনাদের ছবিতে দর্শক পাবেন, বড় হিট পাবেন। আর আপনাদের এই সাফল্যটা চাই বলেই এত বাক্য খরচ করা। কারণ, এফডিসির ওই নোংরা বলয় থেকে নির্বাণ লাভের এটাইতো একমাত্র পথ।


Leave a reply