Select Page

ঈদের সিনেমা খুঁজতে গিয়ে কলকাতা ঘুরে এলাম

ঈদের সিনেমা খুঁজতে গিয়ে কলকাতা ঘুরে এলাম

দুই ঈদকে সামনে রেখে সারাবছর চলতে থাকে সিনেমার শুটিং আর আমাদের মতো অতি উৎসাহী দর্শক হা করে অপেক্ষা করে থাকে। বাংলাদেশে আলাদাভাবে কোন সিনেমার গাইড নেই যেখানে লেখা থাকবে— কোন হলে কোন কোন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, উল্লেখ করা নেই ছবি পরিচালক বা শিল্পীদের নাম। তাই বাধ্য হয়েই পত্রিকার ওপর ভরসা করতে হয়। আর এ লেখার লক্ষ্যও বিনোদন পাতায় কী খুজেঁ পেলাম।

প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর বিনোদন পাতা যথাক্রমে বলিউড, হলিউড ও ঢালিউড— এই তিন ক্যাটাগরিতে নিউজ আপডেট করছে। মজার বিষয় হচ্ছে কলকাতার বাংলা সিনেমার জন্য আলাদা সেগমেন্ট নেই। কারণ, ওপার বাংলার সব সিনেমার খবর ঢালিউড পাতায় পাওয়া যায়। যৌথ প্রযোজনা সিনেমার মতোই এর নাম দেওয়া যাক— যৌথ নিউজ। ওদের দেশের প্রায় সব সিনেমার নিউজ আমাদের পত্রিকাওয়ালারা খুব ঘটা করেই দিচ্ছেন। আর না দিয়ে উপায় তো নেই, ঈদের প্রায় সব ছবিই যৌথ উদ্যোগে নির্মিত।

একটি তরতাজা বাংলাদেশের সিনেমা দেখব বলে হন্য হয়ে গুগল সার্চ দিই, কারণ পত্রিকাগুলোতে কেবল নুসরাত ফারিয়ার ‘আল্লাহ মেহেরবান’ গানের ওপর উকিল নোটিশের বৃত্তান্ত। দেশের কোন তারকার সফলতার গল্প তেমন নেই বললেই চলে। বার বার তাই প্রশ্ন জাগে— এই যে এত এত অভিনয়শিল্পী-পরিচালক, এফডিসি-তে ভোটাভুটি আসলে কিসের জন্য?

ঈদের সিনেমা খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধানী চোখ যা পেল

ঈদের ছবি হিসেবে সব চাইতে আগে যে নামটা চোখে পড়েছে তা হচ্ছে নবাব। জাজ মাল্টিমিডিয়া ও কলকাতার এসকে মুভিজের যৌথ প্রযোজনায় শাকিব খানের বিপরীতে আছেন শুভশ্রী গাঙ্গুলি। পরিচালনা করেছেন জয়দীপ মুখার্জি।

‘আল্লাহ মেহেরবান’ গানটিকে অশ্লীলভাবে প্রদর্শনের জন্য দায়ী সিনেমার নাম বস টু, যা কিনা ২০১৩ সালে কলকাতায় মুক্তি পাওয়া বস-এর সিক্যুয়াল। বাবা যাদব পরিচালিত ছবিটিতে আছেন জিৎ, নুসরাত ফারিয়া ও শুভশ্রী গাঙ্গুলি। প্রযোজনা করছে জাজ ও গ্রাসরুট এন্টারটেইনমেন্ট।

ভারতের শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ঢাকা অফিস প্রযোজনা করছে রংবাজ। শামীম আহমেদ রনি ও আবদুল মান্নানের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও শবনম বুবলি। আরো আছে বুলবুল বিশ্বাস পরিচালিত ও শাকিব-অপু বিশ্বাসের রাজনীতি।

আওয়াজ দেওয়া সিনেমার মধ্যে ছিল অহংকার। যাতে শাকিবের নায়িকা শবনম বুবলি। সৈকত নাসির পরিচালিত পাষাণ-এ অভিনয় করেছেন কলকাতার ওম ও ঢাকার বিদ্যা সিনহা মীম। প্রযোজনা করছে জাজ মাল্টিমিডিয়া।

[su_note note_color=”#ecf0f5″ text_color=”#ffffff” radius=”5″]

এই লেখাটি বিএমডিবি ঈদ সংখ্যা ই-বুক ২০১৭ এর অংশ। পুরো ই-বুক টি ডাউনলোড করুন এখানে

ডাউনলোড করুন[/su_note]

মাহির বিপরীতে মনে রেখো-তে অভিনয় করেছেন কলকাতার বনি সেনগুপ্ত। পরিচালনায় আছেন ওয়াজেদ আলী সুমন। প্রযোজনা করেছে হার্টবিট প্রোডাকশন।

কলকাতার প্রোডাকশন হিসেবে শ্রী ভেঙ্কটেশের নাম ঠিক না হওয়া একটি ছবি শেষ করেছেন শাকিব। রাজীব পরিচালিত ছবিটিতে নায়িকা হিসেবে আছেন সায়ন্তিকা ও নুসরাত জাহান।

উপরের তথ্য অনুযায়ী স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে শাকিব-অপু-বুবলি এই তিন তারকা ছাড়া আর কোন শিল্পীই (মীম ছাড়া) নেই। অবশ্য গেল দুই মাসে এই তিন তারকা বাংলাদেশের সমস্ত দর্শককে যেভাবে টেলিভিশন দেখাতে বাধ্য করেছিলেন তেমনি যদি সব দর্শকদের হলে গিয়ে বাংলা সিনেমাও দেখাতে পারেন তাহলে কিন্তু হল মালিকদের পোয়াবারো।

এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশে কি এককভাবে কোন সিনেমা হচ্ছে না যেখানে শিল্পী থেকে সব কলাকুশলী কেবলই বাংলাদেশি। উত্তর খতিয়ে দেখতে গিয়ে কিছু বাংলা সিনেমা পাওয়া গেছে, যা এখনো সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে।

রাজিবুল হোসেনের অ্যাডভেঞ্চারভিত্তিক চলচ্চিত্র হৃদয়ের রংধনু আটকে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে সিনেমাটি পর্যটন শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আরো বলা হয়, ছবিতে একই সংলাপ একাধিকবার একই সময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ব্যবহার, অর্থহীন সংলাপের ব্যবহার ও নিম্নমানের অভিনয় দর্শকদের বিরক্তির উদ্বেগ করতে পারে।

বাংলাদেশে চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র মর থেঙ্গারি বা মাই বাইসাইকেল নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সেনাবাহিনী৷ তাই ছবিটি শেষ পর্যন্ত সেন্সর বোর্ড পেরিয়ে প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি। পরিচালক অং রাখাইন মাই বাইসাইকেল-এর জন্য গত দশ বছর ধরে কাজ করলেও ছবির দৃশ্যধারণ শুরু করেন ২০১২ সালে। এরপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার একটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয় মর থেঙ্গারি৷ কিন্তু দেশের কোন প্রেক্ষাগৃহে এখনো সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়নি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জগতের সমস্ত সেন্সর বাংলা সিনেমায় এসে ঠেকেছে। কী চাচ্ছে এই সেন্সর বোর্ড?

এই বছর বেশ ঘটা করেই চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এক নজরে তা দেখে আসি—
জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা ২০১৭
১. চলচ্চিত্রে সরাসরি ধর্ষণের দৃশ্যসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যমূলক আচরণ বা হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডকে উদ্বুদ্ধ করে এমন দৃশ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ।
২. সেন্সর বোর্ডের নাম পরিবর্তে হয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ড।
৩. কোনো চলচ্চিত্রেই রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। সমুন্নত রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা; পরিহার করতে হবে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা।
৪. কোনো অশোভন উক্তি, আচরণ এবং অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন, যা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন ও মাত্রা আনতে সহায়ক হতে পারে, এমন দৃশ্য পরিহার করতে হবে।
৫. চলচ্চিত্রের সংলাপে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা পরিহার করতে হবে।

উপরে উল্লিখিত নীতিমালার ভয়েই কিনা জানিনা, বাংলাদেশের পরিচালকরা সিনেমায় টাকা লগ্নি করা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। নতুন চিত্রনাট্যকারদের সমাজের সব নেতিবাচক ঘটনা এড়িয়ে গল্প লিখতে হবে, এর চাইতে ঢের ভালো তামিল সিনেমা কপি করে দিয়ে যৌথ প্রযোজনায় যাওয়া যাতে কোনভাবেই পরিচালকের সেলুলয়েড ফিতেয় সেন্সরের কাঁচির দখলে না পড়ে।

২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ তথ্য মন্ত্রণালয় বলে আসছে, সরাসরি ইংরেজি নাম নয়, কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশি সিনেমার নাম দিতে হবে বাংলাতেই। বাংলা চলচ্চিত্রে ঢালাওভাবে ইংরেজি নাম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতেই এই উদ্যোগ। কিন্তু অনেকে ইংরেজি নাম দিয়েই সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন।

২০১৭ সালে এসেও বছরের প্রথম সেন্সরে প্রদর্শিত সিনেমাটিও ইংরেজি নাম নিয়ে সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়। ক্রাইম রোড শিরোনামের সিনেমাটি গত ১৫ জানুয়ারি সেন্সরে প্রদর্শিত হয়। পরে এ নামেই হলে মুক্তি পায়।

কথা হচ্ছে, যৌথ প্রযোজনা নিয়ে কী কোনই নীতিমালা থাকবে না তথ্য মন্ত্রণালয়ের? সেটা আছে বৈকি! বস টু এটা তবে কোন দেশের ভাষা? বাংলাদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দু-দুটি চলচ্চিত্রে দাপটের সাথে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করে গেলেন যথাক্রমে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও বরুন চন্দ। ভুবন মাঝি আর রিনা ব্রাউন দেখে বুঝে গেছি এই দেশ আর কোন শক্তিমান শিল্পীর সঠিক মূল্যায়ন করবে না। শেষ অব্দি মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রটাও যদি অন্য দেশের অভিনেতাদের দিয়ে করাতে হয় তবে আর কী বা বলার থাকে!
বস টু ছবিতে শিল্পী নেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি যৌথ প্রযোজনার নিয়ম। এমন আভিযোগ উঠেছে ছবিটিকে ঘিরে। সম্প্রতি চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সেন্সর প্রিভিউ কমিটিকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। বিএফডিসিতে সেন্সর প্রিভিউ কমিটি ছবিটি দেখেন। সে সূত্রে এ ছবিটির অধিকাংশ শিল্পী কলকাতার বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে প্রিভিউ কমিটির সদস্য নাসিরউদ্দিন দিলু বলেন, দুই দেশের শিল্পীদের মধ্যে সমতা কম মনে হয়েছে আমার কাছে। সবাই মিলে মতামত জানিয়ে দিয়েছি আমরা। এরপর সেন্সরবোর্ড বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো কী? তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ সুবিধা পেল সিনেমাটি।

পরিশেষে, ঈদের দিন মজা করে সময় কাটাবার জন্য উপাদেয় কোন বাংলা সিনেমা না পেলেও রোজার মাসে হল জুড়ে কী ধরনের অশ্লীল সিনেমা চলছে তার খোঁজ ঠিকঠাক পেয়ে গিয়েছি সংবাদমাধ্যমে। এই সিনেমাগুলো কীভাবে হলে গেল আর অবাধে কীভাবে চলছে তা একমাত্র তথ্য মন্ত্রণালয় এবং তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন।

রোদেলা নীলা: কবি


মন্তব্য করুন