Select Page

উইন্ড অব চেঞ্জ থেকে কোক স্টুডিও বাংলা

উইন্ড অব চেঞ্জ থেকে কোক স্টুডিও বাংলা

সম্ভবত আপনার পছন্দের সংগীতটি রচিত হয়েছিল ১৬০০ সালে মন্টেভের্দির হাতে, ১৭০০ সালে বাখের হাতে, ১৮০০ সালে বেথোভেনের হাতে, ১৯০০ সালে এলগারের হাতে, কিংবা ২০০০ সালে এসে কোল্ডপ্লের মাধ্যমে। সেটা যেটাই হোক, ব্যাপার হচ্ছে এর প্রত্যেকটিকে এই বিষয়গুলো আবিষ্কার করতে হয়েছে কর্ড, মেলোডি এবং রিদম। যা কিনা ১৪৫০ সালের দিকেই আবিষ্কৃত হয়ে গেছেÑ স্মৃতি থেকে লেখায় একটু এদিক সেদিক হতে পারে, তবে এরকমই কিছু কথা লেখা আছে হাওয়ার্ড গুডঅলের ‘দ্য স্টোরি অফ মিউজিক’ নামের বইয়ের একেবারে শুরুর দিকে। অর্থাৎ সংগীতের বিবর্তন যেভাবেই হোক না কেন, কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এর ভেতর সব সময় আছে। সে বিবর্তনের ধারাতেই আমরা আজ এসে নানা ধরনের ফিউশন মিউজিক দেখছি। যেগুলো মৌলিক কোনো কাজ না। বরং বিভিন্ন পরিচিত ও কিংবদন্তি মৌলিক গানগুলোর নতুন কিংবা ভিন্নধর্মী উপস্থাপন।

পাশ্চাত্যে শুরু হওয়া এই ধারা দক্ষিণ এশিয়ায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে পাকিস্তানি টিভি শো ‘কোক স্টুডিও’র মাধ্যমে। ২০০৮ সালে শুরু হয় কোক স্টুডিওর পাকিস্তানি সংস্করণ। যা পরে ভারতেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ক্ল্যাসিকাল, ফোক, সুফি, হিপ হপ, রক এবং পপ জঁরা জনপ্রিয় গানগুলোকে নতুন করে সংগীত আয়োজনের মাধ্যমে উপস্থাপন করে তারা। এর জনপ্রিয়তা পরে দেশগুলোর সীমানাকেও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের দেশেও তার ঢেউ লাগতে দেরি হয়নি।

বিভিন্ন নামে ফিউশনধর্মী এই সংগীত আমাদের এখানেও আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। কোক স্টুডিওর আগে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া গানবাংলা টিভির ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ সম্ভবত সবচেয়ে বড় কলেবরের আয়োজন ছিল।

আগেই বলে রাখা ভালো যে, ফিউশনধর্মী এই মিউজিক শুদ্ধ কিছু না, সেই দাবিও তারা করে না। এ নিয়ে সমালোচনারও কমতি নেই। পাকিস্তান ও ভারতের মতো বাংলাদেশের মানুষও এই স্টুডিও রেকর্ডেড সংগীতকে দারুণভাবে গ্রহণ করে। কিছু সমালোচনা যে ছিল না তা নয়। সেসব অবশ্য সবকিছুতেই থাকে।

উইন্ড অব চেঞ্জ-এর সঙ্গে কোক স্টুডিওর একটা তুলনার মধ্য দিয়ে আমরা এখানকার ফিউশনের প্রবণতাকে বুঝতে পারি। উইমড অব চেঞ্জে সর্বশেষ যে সংগীতটি শুনলাম সেটি ছিল মহর্ষী মনমোহন দত্তর ‘কানার হাট বাজার’। যেটি গেয়েছেন রিংকু। ক্লোজআপ ওয়ান দিয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠা রিংকু এই গানটি অনেক বছর ধরেই কাভার করে আসছেন। তবে উইন্ড অব চেঞ্জ মঞ্চে এসে সেটি ভিন্ন একটি মাত্রা লাভ করতে দেখি। নিছক ভালো বা খারাপের দিকে না দেখে বলতে পারি, শুধু গানের আয়োজনই ক্যানভাসটাকে অনেক বড় করে দেয়। বাউল গানের এমন উপস্থাপন অনেকের হয়তো পছন্দ নাও হতে পারে। সেটা দোষের কিছু না। কেউ কেউ হয়তো একটি বিষয়কে সেটি যেমনটা ছিল সেভাবেই দেখতে পছন্দ করে, কিন্তু সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে এমন না। এমনকি সে অর্থে যারা এই ঘরানার গানের ভক্ত নন, তারাও নতুন এই উপস্থাপনে আগ্রহী হতে পারেন। উইন্ড অব চেঞ্জ থেকে কোক স্টুডিও বাংলা

এর আগে ২০১৬ সাল থেকেই এই বাংলাদেশের বিভিন্ন জঁরার জনপ্রিয় গানগুলোকে তারা নতুন করে সামনে আনতে শুরু করে। বারী সিদ্দিকী, কুদ্দুস বয়াতী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, সুবীর নন্দী থেকে শুরু করে আইয়ুব বাচ্চু এবং জেমসের মতো ব্যান্ড তারকাদেরও এই মঞ্চে নিয়ে আসে তারা। দেশের কিংবদন্তিতুল্য এই সংগীত মহীরুহরা নিজেদের গানগুলোকেই নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। এই গানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর ইনস্ট্রুমেন্টাল ও কোরাস পার্ট।

যেখানে আন্তর্জাতিকতা আনার দারুণ একটা প্রয়াস নিয়েছিল গানবাংলা বা উইন্ড অফ চেঞ্জ। পাশাপাশি যেসব খ্যাতিমান মিউজিশিয়ানদের তারা নিয়ে এসেছে তাও ছিল দেখার মতো। ড্যানিশ ড্রামার মার্কো মিনেমান, ভারতের বিখ্যাত পারকেশনিস্ট শিবামনি, মার্কিন গিটারিস্ট রনথাল বাম্বলফুট, ভারতীয় বেইজিস্ট মোহিনী দেসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নামকরা সংগীত তারকাদের বাংলা গানের সঙ্গে তাল মেলাতে দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল দারুণ ব্যাপার। এমন না যে খুব জাতীয়তাবাদী আবেগের জায়গা থেকে আমি বিষয়টিকে বিবেচনা করছি। তবে বাংলা গানে তাদের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে ভিন্ন একটা মাত্রা দিয়েছে।

এক পর্যায়ে অবশ্য তারা ভারতের জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়েও বাংলা গান করানোর চেষ্টাও করেছে। কৈলাস খের, পাপনদের নিয়ে উইন্ড অফ চেঞ্জের এই উদ্যোগ মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে এমন ভাবনা যে অভিনব ছিল তা বলাই বাহুল্য। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা এক্সপেরিমেন্টালই ছিল বলা যায়। কখনো কখনো আবার ফিউশনকে তার মাত্রা ছাড়াতেও দেখা যায়।

উইন্ড অব চেঞ্জ-এর একটি ব্যাপার ছিল যে, সংগীত আয়োজনের ক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট কোনো বলয়ে বা আদর্শের নিচে চাপা পড়েনি। যে কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোও নিজেদের ইচ্ছে মতো করতে পেরেছে তারা এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো সাধারণ শ্রোতারা পছন্দও করেছে। কিছু কিছু আবার সমালোচিতও হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে গানগুলো আলাদা কিছু সংযোজন করেছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, গানবাংলা যখন প্রথম উইন্ড অব চেঞ্জ নিয়ে এসেছিল, তখন বেশিরভাগ মানুষই এটাকে ইন্টারন্যাশনাল কোক স্টুডিওর বাংলা সংস্করণ বলে ধরে নিয়েছিল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল এটিতে কোক স্টুডিওর অনুকরণের চেয়ে অনুপ্রেরণাই ছিল বেশি। তবে এর মাঝে ক’দিন আগে বেশ ঘটা করে কোক স্টুডিওর বাংলা সংস্করণও সামনে এসেছে। যার সমন্বয়কের কাজ করছেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলা গানে নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছিলেন অর্ণব। তাই কোক স্টুডিওর আগমনী বার্তায় মানুষের প্রত্যাশাও ছিল আকাশসম।

তবে আন্তর্জাতিক কোক স্টুডিওর আগে অর্ণবের মূল চ্যালেঞ্জটা ছিল দেশীয় উইন্ড অব চেঞ্জকে অতিক্রম করা বা তারচেয়ে ভিন্ন কিছু নিয়ে আসা। অবশ্য এমন না যে ফিউশনে এ দুটি অংশই শুধু সক্রিয়। ছোট-বড় পরিসরে টেলিভিশনে কিংবা অন্তর্জালে আরও একাধিক একই ধরনের উদ্যোগ সক্রিয় রয়েছে। এ ক্ষেত্র হাতিরপুল সেশনের কথাও আমরা বলতে পারি। যারা দুর্দান্ত কিছু কাজ করেছে অনেকটাই আড়ালে থেকে। ইতিমধ্যে কোক স্টুডিওর বেশ কিছু গানও সামনে এসেছে। সেই গানগুলো নিয়েও ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধারণাই তৈরি হয়েছে শ্রোতাদের মনে। সে সঙ্গে তৈরি হয়েছে কিছু আনুষঙ্গিক বিতর্কও।

তবে উইন্ড অব চেঞ্জের চেয়ে আলাদা কিছু বা নিজস্ব কোনো ওয়াও-ফ্যাক্টর তারা আনতে পেরেছে এমনটা আমার মনে হয়নি। সাময়িক একটা উন্মাদনা এনেছে ঠিকই। কিছু গানে আলোড়ন দেখা গেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আর আন্তর্জাতিক কোক স্টুডিওর মানদণ্ডে পৌঁছাতে হলেও অনেক দূর পাড়ি দিতে হবে বাংলা কোক স্টুডিওকে। এর মধ্যে বাংলা সংস্করণের দ্বিতীয় সিজনও এসেছে। সত্যি কথা হচ্ছে, এখনো সেই অর্থে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু আমি পাইনি। আমি শুধু সকালে ওঠা সূর্য নিয়ে কিছু কথা বললাম। দিন গড়াতে থাকলে বাকিটা হয়তো আরও অনেক কিছু স্পষ্ট করে ধরা পড়বে।


Leave a reply