Select Page

উর্দু সিনেমায় বাঙালিদের অবদান যেভাবে ভুলে গেছে পাকিস্তান

উর্দু সিনেমায় বাঙালিদের অবদান যেভাবে ভুলে গেছে পাকিস্তান

(বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত পাকিস্তানি গবেষক আকিল জাফেরির লেখাটি বিএমডিবি পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো)

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয় ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিটি দিয়ে। এটি মুক্তি পায় ২৫ মে ১৯৫৯। ‘সামাজিক বাস্তবতা’ নিয়ে ভারতে তৈরি ‘পথের পাঁচালি’ আর ‘দো বিঘা জমিন’ ছবি দুটি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ক্ষেত্রে।

ছবিটির কাহিনি নেয়া হয়েছিল বাঙালি ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ থেকে। কাহিনিটি বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন জহির রায়হান এবং সেটি উর্দুতে অনুবাদ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।

ছবিটির প্রযোজক ছিলেন নোমান তাসির এবং পরিচালক এ জে কারদার। সঙ্গীত রচয়িতা ছিলেন তিমির বরণ এবং চিত্রনাট্য ও গানের কথা ছিল ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’র শুটিং হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে এবং প্রধান ভূমিকায় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন খান আতাউর রহমান, তৃপ্তি মিত্র এবং জুরাইন রক্ষী।

মেঘনা নদীর পাড়ের এক গ্রামের মাঝিদের জীবন সংগ্রাম এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রের সাথে তাদের লড়াইয়ের কাহিনি এটি।

ছবিটি পাকিস্তানে তৈরি প্রথম আর্ট ফিল্ম। সে কারণেই হয়ত ছবিটি পাকিস্তানে বক্স-অফিস সাফল্য পায়নি। তবে ‘দ্য ডে শ্যাল ডন’ নাম দিয়ে ছবিটি যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রদর্শিত হয়, তখন এটি খুবই সমাদৃত হয়।

চলচ্চিত্রটি ১৯৬০ সালে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু অস্কার না পেলেও ছবিটি বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পুরস্কারের জন্য মনোনীত ছবির তালিকায় স্থান পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’ বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং বেশ কিছু পুরস্কার পায় ছবিটি, যার মধ্যে ছিল মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার। আমেরিকায় রবার্ট ফ্লাই হার্টলি ফাউন্ডেশনে এটি বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবির সম্মান পায়। ছবিটি ইংরেজি ও ফরাসি সাবটাইটেল সহ প্রদর্শিত হয় আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, পূর্ব আফ্রিকা ও চীনে।

পকিস্তান চলচ্চিত্র শিল্পের জন্মলগ্ন

ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রথম ছবি ছিল একটি বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। এটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে।

ছবিটির নির্মাতা ও পরিচালক ছিলেন আবদুল জব্বার খান, যিনি নিজে ছিলেন একজন মঞ্চাভিনেতা। চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে তিনি জানতেন খুবই কম। কিন্তু ছবি তৈরির অদম্য ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে তিনি একটি প্রযোজনা সংস্থা তৈরি করেছিলেন ইকবাল ফিল্মস নামে। তার লেখা উপন্যাস ‘ডাকাত’ অবলম্বনে তিনি তৈরি করেন ‘মুখ ও মুখোশ’।

ছবিটি মুক্তি পায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনায়। কারিগরি দক্ষতার অভাবে চলচ্চিত্রটি তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও এই ছবির হাত ধরেই পূর্ব পাকিস্তানে ছায়াছবি নির্মাণের দরোজা খুলে যায়।

পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বিল- ১৯৫৭’ পেশ করেন, যে বিল পাসের মাধ্যমে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন’।

ঢাকায় ১৯৬০ সালে তৈরি হয় আধুনিক একটি ফিল্ম স্টুডিও, যার সমকক্ষ কোন চলচ্চিত্র স্টুডিও পশ্চিম পাকিস্তানে তখন ছিল না।

এরপর তৈরি হয় ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’। এই ছবির হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তানে একের পর এক উর্দু চলচ্চিত্র তৈরির জোয়ার আসে। উর্দু চলচ্চিত্র শিল্পের প্রসারে পশ্চিম পাকিস্তানে এই ছায়াছবি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আর এই ছবি থেকেই উঠে এসেছিলেন এই শিল্পের শ্রেষ্ঠ কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী, সঙ্গীতকার, সঙ্গীতশিল্পী এবং পরিচালক।

এ বিষয়ে আরও একটি লেখা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পাকিস্তানের সিনেমা শিল্প যা হারিয়েছে

পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত যে ছবিগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘সঙ্গম’, ‘মিলন’, ‘বন্ধন’, ‘কাজল’, ‘বাহানা’, ‘লাস্ট স্টেশন’, ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লাহ’, ‘চাকোরী’, ‘দর্শন’, ‘ছোটে সাহেব’, ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’, ‘তুম মেরে হো’, ‘চাঁন্দ আওর চাঁন্দনি’, ‘কুলি’, ‘দাগ’, ‘কুঙ্গন’, ‘আনাড়ী’ এবং ‘শহীদ তিতুমীর’।

ঢাকার উর্দু ছায়াছবির জগৎ থেকে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে যারা উল্লেখযোগ্য নাম হয়ে উঠেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেত্রী শবনম, শাবানা, নাসিমা খান, সুলতানা জামান, রেশমা এবং কবরী। অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন রহমান, আনোয়ার হোসেন এবং নাদিম।

পরিচালকদের মধ্যে নাম করেছিলেন এহতেশাম, মুস্তাফিজ, রহমান, জহির রায়হান, নজরুল ইসলাম এবং খান আতাউর রহমান। কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আখতার ইউসুফ, শাহরিয়ার ইউসুফ এবং শাহরিয়ার সিদ্দিকী আর সঙ্গীতকারদের মধ্যে রবীন ঘোষ, মুসলেহ উদ্দিন ও বশির আহমেদ।

পরে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ছায়াছবির জগতে ২৫ বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য করেছেন শবনম।

রহমানের কাজ ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতে।

নাদিম বেগ: পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে তারকা

পূর্ব পাকিস্তানের ছায়াছবির জগৎ পশ্চিম পাকিস্তানকে দিয়েছিল নাদিম বেগের মত অভিনেতাকে। নাদিমের প্রথম ছবি ছিল ‘চকোরী’। উর্দু ছবিটির প্রযোজক ছিলেন এফ দোসানি এবং পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশাম-উর রহমান, পরিচিত এহতেশাম নামে। সঙ্গীত পরিচালনা করেন রবিন ঘোষ, গীতিকার ছিলেন আখতার ইউসুফ।

নাদিম ছায়াছবির জগতে আসেন গায়ক হতে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনি ‘চকোরীর’ নাম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান।

ঢাকায় ঈদুল আযহা উপলক্ষে চকোরী মুক্তি পায় ২২ মার্চ ১৯৬৭ সালে। প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানের ছায়াছবির জগৎ ছবিটিকে কোন গুরুত্ব দেয়নি। কারণ নায়ক নাদিম এবং নায়িকা শাবানা দুজনেই ছিলেন নতুন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ছবিটির সাফল্যের খবর যখন পশ্চিমে পৌঁছায়, তখন করাচির প্যারাডাইস সিনেমায় ছবিটি দেখানো হয় সে বছরই ১৯ মে।

নাদিম থাকতেন করাচিতে। তিনি ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন। শোনা যায় ‘চকোরী’র পরিবেশক কলেজের শিক্ষার্থীদের ছবিটি দেখার জন্য বিনামূল্যের পাস বিলি করেছিলেন।

ছবিতে নাদিমের অভিনয়ে মুগ্ধ ছাত্ররা সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে নাদিমের নামে শ্লোগান দিতে শুরু করে। এই শ্লোগানধ্বনি ছবিটিকে হিট করে তোলে এবং শুধু করাচিতে নয়, গোটা পশ্চিম পাকিস্তানে ছবিটি আলোড়ন ফেলে দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানে ‘আরমান’ ছবির পর ‘চকোরী’ টানা দেড় বছরের ওপর চলার পর দ্বিতীয় হীরক জয়ন্তী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। এই ছবির পর নাদিমকে আর পেছন দিকে তাকাতে হয়নি।

নাদিমের বিপরীতে ‘চকোরী’তে অভিনয় করেছিলেন শাবানা। নাদিমের মতই এটা ছিল নায়িকার চরিত্রে তার প্রথম অভিনয়। ছবিটির সাফল্যের পর এই জুটি আরও অনেকগুলো ছবি করেছিলেন যেমন, ‘ছোটে সাহিব’, ‘তুম মেরে হো’, ‘কুলি’, ‘চাঁন্দ আউর চাঁন্দনি’, ‘চাঁন্দ সূরয’ এবং ‘আনাড়ী’।

ঢাকার উর্দু ছবির জগত স্মরণীয় হয়ে আছে পাকিস্তান চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বহু ক্ষেত্রে প্রথম অবদানের জন্য।

পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন ছবি

পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন ছবি তৈরি হয়েছিল ঢাকায়। উর্দু ছবিটির নাম ছিল ‘সঙ্গম’। ১৯৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল ঈদুল আযহায় মুক্তি পায় ছবিটি। ছবির পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। সঙ্গমের গীতিকার ছিলেন শাহরিয়ার সিদ্দিকী ও সুরকার ছিলেন খান আতাউর রহমান।

প্রধান ভূমিকায় ছিলেন হারুণ রশীদ ও রোজী সামাদ। এই ছবির একটি গান ‘হাযার সাল কা জো বুড্ঢা মর্ গ্যয়া’ সম্ভবত এই ছবির পুরনো ভক্তদের স্মৃতির মণিকোঠায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে পারেনি, কিন্তু ‘সঙ্গম’এর বাণিজ্যিক সাফল্য ছিল বিশাল। আর পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি হবার সুবাদে দেশটির চলচ্চিত্র ইতিহাসে ছবিটি চিরকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে।

ঐ বছরই ৪ ডিসেম্বর আরেকটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল যেটিও পাকিস্তানে চলচ্চিত্র ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নেয়। ছবির নাম ‘ক্যারাভান’ এবং পুরোপুরি বিদেশে ধারণ করা প্রথম ছবি এটি।

প্রযোজক এসএম সাদিক এবং পরিচালক এসএম পারভেজের এই ছবির পুরোটাই তোলা হয় নেপালের বর্ণাঢ্য রাজপ্রাসাদে। নায়িকার ভূমিকায় শবনম ও নায়কের ভূমিকায় হারুণ অভিনীত এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রবিন ঘোষ।

‘ক্যারাভান’ ছবির সেটে শবনম ও হারুন

পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’ও ছিল ঢাকায় তৈরি। জহির রায়হানের পরিচালনা এবং খান আতাউর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় এই উর্দু ছবিটির কিছু দৃশ্য তোলা হয়েছিল করাচিতে। ছবিতে দুটি গান ছিল করাচিকে নিয়ে লেখা- ‘শেহের কা নাম করাচি’ আর ‘ঢাকা দেখা, পিণ্ডি দেখি অওর দেখা লাহোর’।

নায়িকা কবরী সারোয়ারের অভিনয়ে শেষ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আইরিন পারভিন। এই ছবিটিও মুক্তি পায় ১৯৬৫র ঈদুল আযহায়।

ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়েও বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হয় ঢাকায়। এর মধ্যে শীর্ষে ছিল মাহবুবুর রহমান এবং খান আতাউর রহমানের ছবি ‘নওয়াব সিরাজউদ্দৌল্লাহ’ এবং ইবনে মিজানের ছবি ‘শহীদ তিতুমীর’। দুটি চলচ্চিত্রেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আনোয়ার হোসেন।

‘দর্শন’ ছবির নাম উল্লেখ না করলে ঢাকায় তৈরি উর্দু ছবির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

রহমানের পরিচালনায় এবং তিনি ও শবনম জুটি অভিনীত ১৯৬৮-র সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া দর্শন খুবই সফল একটি ছবি। এই ছবিতে বশির আহমেদের লেখা, সুর দেয়া এবং গাওয়া অনবদ্য বেশ কিছু গান দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল।

গোটা পাকিস্তানে বিপুল জনপ্রিয় হওয়া চলচ্চিত্রের গানগুলোর মধ্যে ছিল “ইয়ে মওসোম, ইয়ে মাস্ত নজরে”, “দিন রাত খ্যায়ালো ম্যে তুঝে ইয়াদ করোগা”, “গুলশান বাহারো ম্যে তু হারে” ইত্যাদি।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মত ঢাকাতে আরও অনেক পরীক্ষামূলক ছায়াছবি তৈরি হয়েছিল, যেগুলো আজকের আর্ট ফিল্মের বিচারে প্রথম সারির চলচ্চিত্র ছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’, ‘সাগর’, এবং ‘ইন্ধন’।

ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্প লাহোর এবং করাচির চলচ্চিত্র শিল্পকেও বড় ধরনের সমর্থন জুগিয়েছে। লাহোর আর করাচিতে তৈরি ছায়াছবি ঢাকাতেও ভাল ব্যবসা করত। অনেক সময় এমন হয়েছে যে ছবি করাচি বা লাহোরে ফ্লপ সেই ছবি পূর্ব পাকিস্তানে সুপারহিট। এরকম একটা ছবি ছিল ‘এক নাগিনা’।

কোন কোন চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র ইতিহাস এবং ওয়েবসাইট অনুযায়ী ঢাকায় তৈরি শেষ উর্দু ছবির নাম ‘জ্বলতে সূরয কে নিচে’। এই ছবিটি মুক্তি পায় ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। এর পরে ঢাকায় তৈরি আর কোন উর্দু ছায়াছবি মুক্তি পায়নি।

যদিও এর পরেও ‘বালা’, ‘মির্জা মহল’ আর ‘রাহি’ নামে তিনটি উর্দু চলচ্চিত্র ঢাকায় নির্মিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই সেগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল, কিন্তু সেগুলি আর কোনদিন রূপালি পর্দায় মুক্তি পায়নি।

আরেকটি উর্দু চলচ্চিত্র ঢাকায় তৈরি হয় ১৯৭৪ সালে- নাম ‘জানে আনজানে’, কিন্তু সেটি শুধু মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশে। পাকিস্তানে সেই ছবি কোনদিন যায়নি।

পাকিস্তানের চলচ্চিত্র ইতিহাসে খ্যাতির শীর্ষে কয়েকটি নাম

পূর্ব পাকিস্তানের উর্দু চলচ্চিত্র শিল্পের যেসব তারকা তখন খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার শিখরে ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথমেই আসে শবনমের নাম।

শবনম

পাকিস্তানের উর্দু ছবির জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়িকা ছিলেন শবনম। শবনম আর নাদিমের জুটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছায়াছবির জগতে ২৫ বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য করেছেন শবনম।

শবনমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায়। আসল নাম ঝর্ণা বসাক।

উর্দু ছবি ‘চান্দা’র মধ্যে দিয়ে উর্দু চলচ্চিত্র জগতে শবনমকে নিয়ে আসেন পরিচালক এহতেশাম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি শবনম সমগ্র পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন।

বাংলা চলচ্চিত্র ‘হারানো দিনে’র মাধ্যমে ১৯৬১ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শবনম।

এই ছবিতেই নায়িকা হিসাবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন শবনম নামে। তার এই নামকরণ করেন এহতেশাম। হারানো দিন ছবিটির পরিচালক ছিলেন মুস্তাফিজ, যিনি ছিলেন এহতেশামের ভাই, নিজেও একজন চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক। মুস্তাফিজের প্রথম উর্দু ছবি ‘তালাশ’ মুক্তি পায় ১৯৬৩ সালে।

‘তালাশ’ও শবনমের সুপারহিট একটি ছবি।

সত্তর দশকের শুরুতে শবনম পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেছিলেন।

পাকিস্তানের প্রায় সবগুলো শীর্ষ পুরষ্কার জিতেছেন শবনম, নিগার অ্যাওয়ার্ড জয় করেছেন তের বার, যা আজও একটি রেকর্ড। পাশাপাশি পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কারও তিনি লাভ করেন তিনবার। এছাড়াও আরও বহু পুরস্কার তিনি জিতেছেন।

প্রায় চার দশকের অভিনয় জীবনে উর্দু ও বাংলা ছবি মিলিয়ে তিনি অভিনয় করেছেন শ’তিনেক চলচ্চিত্রে।

শবনম বিয়ে করেছিলেন সফল সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষকে।

রুনা লায়লা

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিলেটে রুনা লায়লার জন্ম ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর।

তার মা ও বড় বোন ডিনা লায়লা দুজনেই ছিলেন সঙ্গীতে আসক্ত। ফলে খুবই ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন রুনা লায়লা।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘হাম দোনো’ ছবির জন্য শওকত আলি নশাদের সুরে তিনি একটি গান রেকর্ড করেন। গানের কথা ছিল ‘ইন কি ন্যযরো সে জো মুহাব্বত কা পয়গম সুনা’। গানটি সুপারহিট হয়।

এরপর ফিল্ম ও টেলিভিশনে সঙ্গীতের দিগন্ত খুলে যায় রুনা লায়লার জন্য।

বহু সঙ্গীতকারের সাথে গান রেকর্ড করেছেন তিনি। তবে নিসার বাযমির সুরারোপিত গান তাকে সবচেয়ে খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন রুনা। ৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ তিনি পাকিস্তান ছেড়ে যান।

পাকিস্তানে থাকাকালীন তিনি নিগার অ্যাওয়ার্ড জেতেন দুবার। এছাড়াও আরও অন্যান্য পুরস্কারে ভূষিত হন পাকিস্তানে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও ভারতেও বহু পুরস্কার জিতেছেন রুনা লায়লা।

রুনা লায়লা বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি ও আরবীসহ ১৭টি ভাষায় গান করে বিরল সম্মানে ভূষিত হন।

এহতেশাম

এহতেশামের জন্ম ১৯২৭ সালে ঢাকায়। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় আসেন ১৯৫০এ চিত্র পরিবেশক হিসাবে। ১৯৫৬এ ‘এ দেশ তুমহারা’ ছবির পরিচালক হিসাবে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র শিল্পে নিজের জায়গা করে নেন।

চিত্র পরিচালক এহতেশাম-এর প্রথম বাণিজ্য সফল উর্দু ছবি ‘চান্দা’ ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

তার প্রথম বাণিজ্য সফল উর্দু ছবি ‘চান্দা’ ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৬৭ সালে তার ছায়াছবি ‘চকোরী’তে তিনি নাদিমকে নায়কের ভূমিকায় নিয়ে আসেন এবং তার ছবি সাফল্যের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।

তার তৃতীয় ছবি ১৯৬৮তে ‘চাঁন্দ আওর চাঁন্দনি, চতুর্থ ছবি ১৯৬এ ‘দাগ’।

নাদিম ১৯৭৪ সালে তার একটি ছবি পরিচালনার অনুরোধ জানান এহতেশামকে, কিন্তু ছবিটি ফ্লপ হয়। এহতেশাম বাংলাদেশে ফিরে যান। ২০০২ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশে মারা যান।

জহির রায়হান

জহির রায়হানের আসল নাম ছিল মোহম্মদ জহিরুল্লাহ। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট তার জন্ম নোয়াখালির মজুপুর গ্রামে। বাংলায় স্নাতক জহির রায়হানের তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের মতই লেখায় ছিল নেশা। মাকর্সবাদে তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন।

গোটা পাকিস্তানে ১৯৫১ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তিনি আত্মগোপন করেন। তখন তিনি জহিরুল্লাহর বদলে রায়হান নামে তার কাজকর্ম চালাতেন। আত্মগোপনে থাকা নেতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল তার।

পরে তিনি নাম নেন জহির রায়হান। ৫২-র ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এ সময় তিনি কারারুদ্ধ হন। লেখক হিসাবে তার সুনাম ছিল। ১৯৬৪ সালে তার ছোট গল্পের সঙ্কলনের জন্য তিনি আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান এবং ১৯৭২ সালে নিখোঁজ হয়ে যাবার পর তিনি মরণোত্তর বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার পান।

তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র তিনি পরিচালনা করেন ১৯৬১ সালে এবং এরপর অনেকগুলো বাংলা ছবি তিনি করেছেন। তার স্মরণীয় উর্দু ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সঙ্গম’ এবং ‘বাহানা’। সঙ্গম পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি।

মার্চ ১৯৭১এ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হবার পর তিনি কলকাতায় পালিয়ে যান এবং সেখানে তিনি তৈরি করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের বিরুদ্ধে তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’।

ভারত সরকারের সহযোগিতায় এই ছবি দেখানো হয় সারা বিশ্বে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল তার ওই তথ্যচিত্র।

ঢাকায় ফিরে আসেন জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার ঠিক পরেই। তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রথিতযশা লেখক, চিত্র নির্মাতা, পরিচালক ও অভিনেতা জহির রায়হানও ভাইকে খুঁজতে গিয়ে চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান তার কিছুদিন পরেই।

রবিন ঘোষ

ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্ম রবিন ঘোষের। বাবা কাজ করতেন আন্তর্জাতিক রেড ক্রসে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোস্টিং ছিল বাগদাদে।

বাবা ছিলেন বাঙালি খ্রিস্টান, মা আরব খ্রিস্টান। রবিন ছোটবেলা পড়াশোনা করেন বাগদাদের কনভেন্ট স্কুলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তারা ঢাকায় ফিরে যান। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতে তার ছিল দারুণ আগ্রহ। গ্রামাফোন রেকর্ড সংগ্রহ করতেন, হারমোনিয়াম বাজাতেন।

এন্ট্রাস পাশ করার পর কলকাতায় গিয়ে সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতদলে যোগ দেন এবং সঙ্গীত জগতের রহস্যের খোঁজ পান সেসময়ই।

পরে চাকরি নেন ঢাকা রেডিও স্টেশনে। সেখানেই আলাপ হয় বন্ধুর বোন অভিনেত্রী ঝর্ণা বসাকের সঙ্গে। যিনি পরে রূপালি পর্দার একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন শবনম নামে। দুজনের বিয়ে হয় ১৯৬৪ সালে।

সঙ্গীত রচয়িতা মুসলেহ উদ্দিন যখন ১৯৬০ সালে উর্দু ছবি ‘হাম সফর’-এর জন্য কাজ করছিলেন তখন তার সহকারী হিসাবে কাজ করার সুযোগ হয় রবিন ঘোষের।

পরিচালক এহতেশাম ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া তার বাংলা ছবি ‘রাজধানীর বুকে’র জন্য সঙ্গীত রচনা করতে বলেন রবিন ঘোষকে।

এরপর বহু উর্দু ও বাংলা ছবির গানে সুর দিয়েছেন রবিন ঘোষ, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে হিট ছবি ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘চকোরী’, ‘পয়সা’, ‘তুম মেরে হো’ ইত্যাদি।

রবিনের সঙ্গীত আর শবনমের অভিনয় ছিল পাকিস্তানে খুবই জনপ্রিয়। ‘তুম মেরে হো’ মুক্তি পাবার পর রবিন এবং শবনম প্রথম করাচিতে যান, সেখান থেকে লাহোর এবং সেখানে বহু বছর তারা কাজ করেছেন বহু ব্যবসা সফল ছায়াছবিতে।

হীরক জয়্ন্তী ছবি ‘আইনা’ তাদের খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল।

সঙ্গীত রচনার জন্য রবিন ঘোষ ছয়বার নিগার অ্যাওয়ার্ড-এ পুরস্কৃত হন। ১৯৬৩ সালে তালাশের সঙ্গীত রচনার জন্য তিনি এই সম্মান পান। এছাড়াও অন্য আর যে ৫টি ছায়াছবিতে সঙ্গীত রচনার জন্য তিনি এই খেতাব পেয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল ‘চকোরী’, এবং ‘আইনা’।

ঢাকার এক হাসপাতালে ২০১৬ সালে মারা যান প্রতিভাধর সঙ্গীতকার রবিন ঘোষ।


Leave a reply