Select Page

নেগেটিভ নষ্ট হওয়ার পর যেভাবে আবার তৈরি হয় ‘শিরি ফরহাদ’

নেগেটিভ নষ্ট হওয়ার পর যেভাবে আবার তৈরি হয় ‘শিরি ফরহাদ’

শাবনূররিয়াজকে জুটি করে গাজী মাহবুব নির্মিত ‘প্রেমের তাজমহল’কে এখনো স্মরণ করেন দুই তারকার ভক্তরা। সেই পরিচালক ও অভিনয়শিল্পী জুটির পরের ছবি ছিল ক্ল্যাসিক কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘শিরি ফরহাদ’। ছবিটি ততটা সাড়া পায়নি। এর পেছনে রয়েছে নির্মাণ জটিলতা, যথা সময়ে মুক্তি না পাওয়াসহ কিছু সমস্যা।

সম্প্রতি পরিচালক ফেসবুকে পোস্টে জানালেন ক্যামেরার সাটার কম্পনে নেগেটিভ নষ্ট হওয়ার পর কীভারে কাঠখড় পুড়িয়ে সিনেমাটি তৈরি করেন। অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শাবনূর ভক্তদের নিন্দার স্বীকার হন গাজী মাহবুব।

পরের নিন সেই পোস্ট—

প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার মতিন রহমান এবং বেলাল আহমেদ এর কাছে আমার অনেক ঋণ।

২০০৬ সাল।

ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর ব্যানারে “শিরি ফরহাদ” ছবিটি আরম্ভ করি। ছবিটির শুটিং পর্ব শেষে নেগেটিভ ডেভলাপ করে রাশ করার পর দেখা যায় কারিগরি ত্রুটির জন্য ১২৮০০ ফুট এক্সপোজড নেগেটিভ ক্যামেরার সাটার কম্পনে নষ্ট হয়ে যায়। যা পুনরায় শুটিং করা ছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কেননা ইমপ্রেস এর সাথে চুক্তিবদ্ধ বাজেট ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তার উপর এই ক্ষতি সামলানো আমার জন্য কঠিন। কমপক্ষে ১৫ দিন রিশুটিং করা লাগবে। বিষয়টি চাষী ভাই (চাষী নজরুল ইসলাম), হায়াৎ ভাই (কাজী হায়াৎ), আমার বড় ভাই (গাজী জাহাঙ্গীর) গুলজার ভাই (মুশফিকুর রহমান গুলজার) এর সাথে শেয়ার করি এবং সাগর ভাইকে (ফরিদুর রেজা সাগর) হাসান ভাইকে (ইবনে হাসান খাঁন) সমস্যাটা বিস্তারিতভাবে জানালে অতিরিক্ত বাজেট প্রদান সাপেক্ষে ছবিটি সম্পন্ন করতে নিরুৎসাহিত করেন।

নানান দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করলো-শিরি ফরহাদ ছবিটি ক্যামেরা দুর্ঘটনায় বাক্সবন্দী হলো, আলোর মুখ দেখবে না কোনদিন! এফডিসির ষ্টোরে অন্যান্য ছবির মতো এই ছবির নেগেটিভও নষ্ট হবে! পঁচবে! কি করা যায়- এমন ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একদিন চলচ্চিত্র ইতিহাসে অসমাপ্ত ছবির তালিকায় এটিও যুক্ত হবে। আর শোকের একটি পাথর বুকে নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে…পথ চলতে হবে…!!

২০০৮ সাল।

সিদ্ধান্ত নেই ক্ষতিগ্রস্ত শুটিংসহ অবশিষ্ট কাজ অর্থ জোগাড় করে আমাকেই শেষ করতে হবে। গুলজার ভাইর মধ্যস্থতায় শিরি ফরহাদ ছবিটি সম্পন্নের লক্ষ্যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের জন্য আমার প্রযোজনা সংস্থা বি-বাড়ীয়া ফিল্মস্ এর সাথে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি মোতাবেক ৫০% মালিকানা স্বত্ত্ব বি-বাড়ীয়া ফিল্মস্ এর।

২০১০ সাল।

শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। অর্থ জোগানের ব্যবস্থা হলো। নতুন করে শিডিউল এর জন্য শিল্পী কুশলীদের কাছে চাওয়া হলো। রিয়াজ, শাবনুর, মিন্টুভাই (জেড এইচ মিন্টু) সহ সকলেই খুশী হলেন। সহযোগীতার হাত বাড়ালেন। শুধুমাত্র শাবনুর অতিরিক্ত ২ লক্ষ টাকা সম্মানী দাবী করলো। বুঝানোর চেষ্টা করলাম নেগেটিভ নষ্ট হয়েছে কারো হাত ছিল না। ইমপ্রেস ছবিটি শেষ করবে না, আমি নিজের অর্থায়নে ধারদেনা করে রিশুটিং সহ যাবতীয় কাজগুলো এখন থেকে করবো। তুমি ৭দিন শিডিউল দিয়ে সহযোগীতা করো, পাশে থাকো। শাবনুর নাছোরবান্দা- দুইমাস পর আবার চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া, ফিরবে কবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। অস্ট্রেলিয়া গেলে এক বছরের নিচে দেশে আসেনা। ভয়! উৎকন্ঠা! শেষ পর্যন্ত ২ লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হলাম তবু ছবিটি বছরের পর বছর বাক্সবন্দী হয়ে না থাকুক। অব্যবস্থাপনায় এফডিসি’র ষ্টোরে না পঁচুক। সিদ্ধান্ত নিলাম আমার হাত দিয়ে টাকাটা দিব না শিডিউলও নেবো না- এই সিদ্ধান্ত থেকে খসরু ভাইকে (খোরশেদ আলম খসরু) বিষয়টি খুলে বললাম- আপনার মাধ্যমে শাবনূরকে টাকাটা দিতে চাই এবং আপনি আমার শিডিউলটা শাবনুর থেকে এডজাষ্ট করে দিবেন। আমি ওর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে একদম কথা বলতে চাই না। বলতে গেলে আমার মাথা ধরে- আমার এখন একমাএ লক্ষ্য  শিরি ফরহাদ ছবিটি শেষ করার স্বার্থে যা করনীয় তা করা।

খসরু ভাই রাজী হলেন। ২দিন পর ডাবিং থিয়েটারে শাবনুরের হাতে খসরু ভাই টাকাটা তুলে দিলেন এবং প্রয়োজনীয় শিডিউলটা তিনি শাবনুর থেকে গ্রহণ করে আমাকে দিলেন।

শুরু হলো নষ্ট নেগেটিভের পুনরায় শুটিং পর্ব। শুটিং শেষ হলো। এডিটিং, ডাবিং, ব্যাকগ্রাউন্ড, আর-আর শেষ হলো। ছবিটি এখন সেন্সর প্রিন্ট এর জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তত।  সকল কাজ শেষ হবার পরও  বুলবুল ভাই (আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল) বিনয়ের সাথে আমাকে অনুরোধ করলো ছবিটি গতিশীল করতে আরো সম্পাদনা প্রয়োজন এবং চিত্রনাট্যের গতি সৃষ্টিতে সম্পাদনায় গভীর চিন্তার সংযোজন ঘটালে আরো কিছু অসংগতিও কমে আসতে পারে। বুলবুল ভাই আমাকে আশ্বস্ত করে-পুনরায় আর-আর বা যা করণীয় তা তিনি করবেন ছবিটির স্বার্থে। নায়ক রিয়াজ ও সাউন্ড রেকর্ডিষ্ট বাদল ভাইও (রেজাউল করিম বাদল) বুলবুল ভাইয়ের সাথে সহমত পোষণ করেন। ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। যদিও ছবিতে কিছু অসংগতি পাশ কাটিয়েই সমাপ্ত করা হয়েছে। ভাবলাম আমি আর এডিটিং করবো না- অভিজ্ঞ সিনিয়র এমন কারো মাধ্যমে হলেই ভালো।

যেই ভাবনা, সেই কাজ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা দুই চলচ্চিত্রকার মতিন ভাই (মতিন রহমান) এবং বেলাল ভাই (বেলাল আহমেদ) কে বিষয়টি বলি এবং অনুরোধ করি, আর-আর সাউন্ড সহ ছবিটি প্রজেকশনে দেখে কারেকশন দিতে এবং এডিটিং টেবিলে মতিন ভাই বেলাল ভাই যেন সময় দেন। আমি নির্দেশিত হবো। আমার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেনি এই দুই কিংবদন্তী নির্মাতা। প্রজেকশনে ছবি দেখলেন- খাতায় নোট করলেন- এডিটিং শিফট নেয়া হলো, ধৈর্য্যের সাথে অনুজ একজন পরিচালকের অনুরোধে কয়েকদিন সময় দিলেন এই দুই গুণী নির্মাতা। পরামর্শ অনুযায়ী পুনরায় সম্পাদনা হলো। সম্পাদনা শেষে সকল কাজের পর্ব শেষ করে সেন্সর প্রিন্ট হলো।

সম্পাদনার টেবিলে ‘শিরি ফরহাদ’

২০১১ সাল।

সেন্সর হলো। সেন্সর হওয়ার পর ৩৫ এম এম থেকে ডিজিটালে কনভার্ট করা হলো।

২০১৩ সাল।

২২শে মার্চ ৪৩টি সিনেমা হলে ডিজিটাল ভার্সানে ছবিটি মুক্তি পেলো।

এতো দীর্ঘ উপসংহারে  মূল কারন আমার প্রিয় অগ্রজ পরম শ্রদ্ধেয় মতিন রহমান এবং পরম শ্রদ্ধেয় বেলাল আহমেদ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা জানানো। আমরা জানি এই দুইজন মানুষ আমাদের প্রিয়  পরিচালক সমিতিতে তাঁদের নান্দনিক আলোচনা আমাদের  প্রাণবন্ত করে তুলতো। বেলাল ভাই অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে পরপাড়ে পাড়ি দিয়েছেন। মহান আল্লাহ যেনো তাঁকে বেহেস্ত নসীব করেন।

আর মতিন ভাইয়ের জন্য রইল নেকহায়াৎ সহ দীর্ঘায়ু কামনা। তখন অনেক ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের মোহ আর শ্রদ্ধার এই দুইজন নির্মাতা আমার অনুরোধকে গুরুত্ব দিয়ে সময় দিয়েছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন শিরি ফরহাদ ছবিটির ভুলত্রুটি কতটা কমিয়ে আনা যায়, কতটা গতিশীল করা যায়। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে ঋণী হয়ে রইলাম। তাঁদের কাছে আমার অনেক ঋণ। মতিন ভাই এবং বেলাল ভাইয়ের এই অনন্য মাত্রার মহত্ব অন্তিমকাল পর্যন্ত অনুপ্রেরণা জোগাবে।

পুনশ্চ. পোস্টটি অসমাপ্ত। আরো কিছু তথ্য যুক্ত হবে।”

এভাবে নির্মাণ শুরুর ৭ বছর পর সিনেমাটি মুক্তি পায়। তত দিনে শাবনূর বা রিয়াজ কারোই যথাযথ ফিটনেস বা ব্যবসায়িক কদর ছিল না। সিনেমাটি ব্যবসার ক্ষেত্রে ভালো কিছু করতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া  নির্মাণও ছিল না আহামরি। কিন্তু একজন হিসেবে গাজী মাহবুবের লেগে থাকা হলো মন কাড়ার বিষয়।


মন্তব্য করুন