এক মুঠো ভাত: যে সমাজে ক্ষুধার্ত মানুষ নাই, সেই সমাজে অপরাধ নাই!
যতটুকু মনে পড়ে ১৯৮৫ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত’ উজালা সিনেমায় চলছিল। ইয়া বড় বিলবোর্ড। সেই বিলবোর্ডে জাফর ইকবাল দড়ির সিঁড়ি বেয়ে হেলিকপ্টারে উঠছে। দৃশ্যটি খুব রোমাঞ্চকর ছিল।
তখন আমি সিনেমা দেখতাম না। শুধু পোস্টার দেখতাম। সকাল-বিকেল উজালা সিনেমার সামনে গিয়ে পোস্টার দেখতাম। পোস্টার দেখেই মুগ্ধ হতাম। পোস্টারগুলোর নান্দনিকতা আমাকে মুগ্ধ করতো।
তখন যেমন সুন্দর ছিল ছবির নাম, তেমনি সুন্দর ছিল পোস্টারের ডিজাইন। উজালা সিনেমা থেকে ১০০ গজ দূরে আমার বাসা ছিল। তাই আমি সুযোগ পেলে পোস্টার দেখতে যেতাম, হলের সামনে।
আমার সিনেমা দেখার অভিযান শুরু হয় ১৯৮৬ থেকে। যতটুকু মনে পড়ে নভেম্বরে ‘এক মুঠো ভাত’ দেখি। টাইগারপাস মামা-ভাগিনার মাজারের সামনে নেভাল অডিটোরিয়ামে। তিন টাকা দিয়ে টিকেট নিয়ে দেখেছিলাম।
জুম্মাবারে জন্ম তাই নাম জুম্মন। জুম্মন চরিত্রে অভিনয় করেছে রোমিও নায়ক জাফর ইকবাল। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিল।
জুম্মনের বাবা নাই। মা অসুস্থ, ঔষধ নেই। ঘরে চাল নাই, ডাল নাই। জুম্মনের কাছে একটি কলম ছিল। যা দিয়ে সে স্কুলে লিখতো। সেই কলম নিয়ে বাহির হলো। কলম বিক্রি করে যদি মা জন্য এক মুঠো ভাত যোগাড় করতে পারে। পথে কলমটি কয়েকজন বখাটে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তখন অপরাধ জগতের গডফাদার জসিমের সঙ্গে দেখা। জসিম জাফরকে ভাত-তরকারির ব্যবস্থা করে দেয়।
বাসায় এসে মাকে বলে, মা তোমার জন্য ভাত এনেছি। তুমি ভাত খেলে ভালো হয়ে যাবে। কোনো উত্তর না পেয়ে গিয়ে দেখে মা আর জীবিত নাই। তখন জাফর কান্নায় ভেঙে পড়ে। জসিম ঘরে প্রবেশ করে। জাফরকে সাথে করে নিয়ে যায়।
জসিম জাফরকে অপরাধ জগতের রাজা বানায়। জাফরকে দিয়ে জসিম সকল প্রকার অপরাধ করিয়ে ফায়দা নিতো। একসময় জাফর অপরাধ করতে চায় না। জসিমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জসিম চায় না জাফর দল থেকে বাহির হোক, কারণ জাফর দলের সব গোপন খবর জানে। কিন্তু জাফর বের হয়ে যায়।
জসিম ভাতের দোকানে ভাত খেতে যায়। তখন অনেক রাত। দোকানদারের কাছে এক প্লেট ভাতই আছে। এমন সময় মিজুও আসে ভাত খেতে। ভাত এক প্লেট ক্ষুধার্ত দু’জন। জাফর চায় দুজন মিলে খেতে। মিজু চায় একাই খেতে। শুরু হয় লড়াই। লড়াইতে দুর্ঘটনাবশত জাফরের হাতে মিজু খুন হয়। খুনের দায়ে জাফরের ফাঁসির রায় হয়।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে জাফরকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় জসিমের গ্যাং-এর সদস্যরা। হেলিকপ্টার থেকে আক্রমণ করে জেল প্রাঙ্গণে। তারপর জাফরকে নিয়ে যায়। পুলিশের ফায়ারিংয়ে হেলিকপ্টার ক্র্যাশ হয়। নদীতে পড়ে হেলিকপ্টারের টুকরোগুলো। এর আগে হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়ে জাফর।
জাফর ট্রেনে করে অজানার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনে পরিচয় এক যুবকের সঙ্গে। সেই যুবক জাফরকে খাবার ভাগ করে দেয়। হঠাৎ যুবক বুঝতে পারে জাফর জেল পলাতক আসামী। তখন যুবক জাফরকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে চায়। তখন জাফর সেই যুবকে ট্রেন থেকে নদীতে ফেলে দেয়।
কাকতালীয়ভাবে জাফর সেই যুবকের গ্রামে আসে এবং সেই যুবকের মা-বাবার কাছে আশ্রয় নেয়। সেই যুবকের মা-বাবা ছিল অন্ধ। জাফর যখন বুঝতে পারে সেই যুবকের মা-বাবা এরা তখন মনে মনে অনুতপ্ত হয়।
গ্রামের ত্রাণ চোর, রেশন চোর, চাল চোর মহাজনের খপ্পর থেকে সেই যুবকের মা-বাবাকে জাফর রক্ষা করে। সেই গ্রামের মেয়ে ববিতা জানতো জাফরের আসল পরিচয়। জাফরের ভিতর ভালোমানুষী দেখে ববিতা জাফরের প্রেমে পড়ে যায়। পুলিশ খুঁজতে খুঁজতে সেই গ্রামে চলে আসে। জসিমও জাফরকে খুঁজতে খুঁজতে সেই গ্রামে আসে।
সেই যুবকের মা-বাবা যাকে জানতো সন্তানের বন্ধু, সে যে আসলে সন্তানের খুনি জানতো না। একসময় সেই যুবকও ফিরে আসে। সেই যুবক মরেনি, একটি পা হারিয়েছে। সেই যুবক জাফরকে ক্ষমা করে দেয়। কারণ, জাফর তার মা-বাবার দেখাশোনা করেছে। সে যুবক জাফরকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।
এই ছবি দেখে যা শিখলাম: ক্ষুধার্ত যখন আর ক্ষুধা সইতে পারে না, তখন অপরাধ করে। তাই আমাদের প্রত্যকের উচিৎ নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করা। কেউ যেন ক্ষুধার্ত হয়ে অপরাধী না হয়, সে দিকে দৃষ্টি রাখা। প্রয়োজনে নিজের প্লেট থেকে আধা প্লেট ভাত দিয়ে হলেও ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবারণ করা।
গডফাদাররা ক্ষুধার্ত, সুবিধা বঞ্চিতদের অসহায়ত্বে সুযোগ নিয়ে অপরাধী বানায়। নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। তাই আমরা যতই অসহায় হই না কেন- আমরা যেন সমাজের মুখোশধারী গডফাদারের নাচের পুতুল না হই।
একবার অপরাধের জগতে প্রবেশ করলে বাহির হওয়া কঠিন। ভালো মানুষ মন্দ হতে যত সহজ। মন্দ মানুষ ভালো হওয়া তত কঠিন। যেমন জাফর ভালো হতে যেয়ে আরো অপরাধী হয়ে যায়। তাই আমরা যেন ভুলেও অপরাধ জগতে উঁকিও না মারি।
জাফর যখন ববিতার দোকানে খাবার চুরি করে। তখন ববিতা তাকে একটি রুটি দেয় আর কুকুরকে একটি রুটি দেয়। এর অর্থ চোর আর কুকুর সমান। জাফর তো ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করেছে। কিন্তু সমাজে কিছু চোর আছে তাদের বলা হয় পুকুর চোর। তারা সমাজের মাথা, তারা সমাজের প্রতিনিধি মুখোশ পড়ে চুরি করে। যেমন ত্রাণ চোর। এই ছবিতে একজন রেশন চোর আছে- এই রেশন চোররা যখন যা পায় তাই চুরি করে। ত্রাণ হোক আর রেশন হোক।
আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো— জাফর কারণে সেই যুবক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। একটি পা হারায়। তবুও ক্ষমা করে কারণ, জাফর তার মা-বাবার উপকার করে। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মা-বাবা প্রতি ভালোবাসা অপূর্ব। সেসব সন্তান মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তাদের শেখার আছে অনেককিছু।
যখন খাবার সীমিত থাকে তখন সবাই মিলেমিশে খাওয়া উচিৎ। মিজুর মতো একলা খাবো নীতি পরিত্যাগ করা উচিৎ। না হয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। যেমন; মিজু খুন হলো আর জাফরের ফাঁসির আদেশ হলো। তাই আপস-মীমাংসার পথ বেছে নেওয়া উচিৎ, দাঙ্গা-ফ্যাসাদের নয়।
ববিতা জানতে পেরেছিলো জাফর পলাতক আসামী, খুনি। কিন্তু জাফরের মাঝে যে অনুশোচনা দেখে তাতে ববিতা প্রেমে পড়ে যায়। অপরাধী যখন আন্তরিক ভাবে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে যায়। তখন সব অপরাধ ছাই হয়ে যায়। শাস্তি তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
আমি সবসময় সিনেমার শিক্ষণীয় দিক বিবেচনা করি। শিক্ষাগ্রহণ করি। আমি সিনেমাকে শুধু বিনোদন মাধ্যম হিসাবে দেখি না।
চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা; ৩ মে ২০২০, রবিবার