Select Page

বাণিজ্যিক সিনেমায় গান না থাকাটায় আশ্চর্যের

বাণিজ্যিক সিনেমায় গান না থাকাটায় আশ্চর্যের

সিনেমার গান নিয়ে ’৯০ দশকে ‘ছায়াছন্দ’ নামে এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হতো বিটিভিতে। রেডিওতে চলত শ্রোতাদের অনুরোধের বাংলা গানের আসর। রেডিওর চেয়ে টিভির বিষয়টা এই কারণে আনন্দের ছিল যে, পর্দায় গানের পাশাপাশি নায়ক-নায়িকাদের শরীর দোলানো কর্মটিও চাক্ষুস করা যেত মুগ্ধ নয়নে। এছাড়া নতুন সিনেমা এলে বেবিট্যাক্সিতে চলত বিজ্ঞাপনী মাইকিং। দর্শক টানার জন্য বাজানো হতো সেই সিনেমার দুয়েকটা গানের ক্যামিও। এখন যুগ পাল্টেছে। প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় চলে আসার পর থেকে মানুষ ইচ্ছেমাফিক নিজেদের চলচ্চিত্র বিনোদন খোরাক নিয়ে নিতে পারছেন মুহূর্তেই। মুহূর্তেই শুনে ফেলতে পারছেন প্রিয় গানটি। তবে বাংলাদেশের সিনেমার সোনালি যুগের মতো সোনালি গানও ফুরিয়ে গেছে। দর্শকরা আগে হল থেকে বেরিয়ে সদ্য দেখা সিনেমাটির কোনো প্রিয় গানের কলি গুনগুন করে গাইতেন বা ঠোঁটে শিষ বাজিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। নতুন শতকের শুরুর আগ পর্যন্ত এই ছিল বাংলাদেশি সিনেমাপ্রেমীদের ‘কমন সিনারিও’। তবে পরের দশকের দৃশ্যটা উল্টো। ‘ভদ্র ঘরের’ সন্তানরা বাংলা সিনেমার অশ্লীল যুগে হলে ঢুকতেন ও বের হতেন মুখ লুকিয়ে। কখনো কখনো একটু বখাটেপনা দেখানোর জন্য কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘ধর’ সিনেমার ভিলেন ডিপজলের অনুকরণে গাইতেন, ‘খাইছে আমায় খাইছে রে/মদের নেশায় পাইছে রে/তোরা সানডে মানডে ক্লুজ কইরা দে’।

কোলাজ: আগুন, সাবিনা ইয়াসমিন, কনকচাঁপা, আব্দুল জাব্বার ও অ্যান্ড্রু কিশোর

১৯৯৯ সালে ‘আম্মাজান’ ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়ার পর নায়ক মান্না ও ভিলেন ডিপজল জুটি জমে ওঠে। ‘কষ্ট’, ‘কুখ্যাত খুনি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় একসঙ্গে দেখা যায় দুজনকে। তবে ‘ধর’ ও ‘আম্মাজান’-এর আমেজ বাকিগুলোতে ছিল না। অবশ্য গানের দৃশ্যে কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গির কারণে এই দুই সিনেমার ওপরেও ওঠে অশ্লীলতার অভিযোগ।

সিনেমায় সবাক যুগের আগেই নির্বাকতাকে প্রাণ দিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবহ সংগীত এক বিশাল বিপ্লব হয়ে ওঠে। তারপর তো এলো রেকর্ড করা আবহ সংগীত ও দৃশ্য ও ঘটনার সঙ্গে পরম্পরা রেখে সংগীতায়োজন। উপমহাদেশের সিনেমাতেও সংগীত বড় জায়গা করে নিল। বাণিজ্যিক সিনেমায় গান না থাকাটায় যেন আশ্চর্যের বিষয়। এখনো সেই ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। কিন্তু মানুষের মুখে মুখে ফেরা সেসব সিনেমার গান গেল কোথায়? উল্লেখ্য, বাংলাদেশি নির্মাতারা একসময় ওয়েস্টার্ন ও বলিউডে প্রভাবিত হয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ধার করতেন। এমনকি নকল করা সুরের গান দিতেন সিনেমায়।

১৯৯৯-২০০৭ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমায় দুরবস্থা বা কথিত অশ্লীল যুগ কেবল চলচ্চিত্র অঙ্গনের কলাকুশলীদের নয়, হুমকিতে ফেলে দেয় গানকেও; বিশেষত অশ্লীলতা ছড়ায় সিনেমার গানে। এই নোংরামি পরবর্তী সময়ে ছড়িয়েছে সারা দেশের আঞ্চলিক গানগুলোতেও। মূলত খড়গটা নেমে এসেছিল গানের দৃশ্যে। এক টিকিটের দুই সিনেমায় কাটপিস তো ছিলই, দুই তরুণ-তরুণীর যৌন উদ্দীপনামূলক শারীরিক কসরতের সঙ্গে মিলিয়ে থাকত সুড়সুড়িমূলক গান।

বাংলাদেশের সিনেমার মতো এই অঙ্গনের গানেরও সোনালি যুগও ১৯৬০-৯০ দশক পর্যন্ত। আশির দশক থেকে দেশে ব্যবসায়িক সিনেমার যাত্রা শুরু হলেও গান তখনো সুরে ও কথায় আধুনিকতার মোড়কে বেশ জনপ্রিয় ছিল শ্রোতাদের কাছে। তখন সৈয়দ শামসুল হক ও রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর মতো কবি-সাহিত্যিকরাও সিনেমার জন্য গান লিখতেন। চলচ্চিত্রের বাইরের সংগীত জগৎও বেশ সমৃদ্ধ ছিল। লোক ও আধুনিক গানের পাশাপাশি নবধারার পপ ও রক মিলেমিশে দারুণ এক আবহ গড়ে তুলেছিল দেশের সংগীতে। কথায় আছে, ‘সঙ্গ দোষে লোহাও ভাসে’ রুপালি পর্দার জগতে টিকে থাকা মান্নার মতো অভিনেতারা অশ্লীলতার দোষে দোষী হয়েছেন। তেমনি যশ-নামের খাতিরে আগুনসহ আরও অনেক নামজাদা কণ্ঠশিল্পী আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। সময়টাকে দোষী সাব্যস্ত নয়, বরং এখন ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে। এর পেছনে বলিউডি চাপ ও নতুন শতাব্দীতে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলানোর কারণও থাকতে পারে।

বাংলা সিনেমার সংগীতের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে উঠে আসবে এন্ড্রু কিশোর-সাবিনা ইয়াসমিন বা এন্ড্রু কিশোর-কনক চাঁপা জুটি। এই তিনজনকে সিনেমার গানের রতœ বলায় যায়। ’৯০ দশকে প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র প্রতিটি সিনেমার জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল গান। যার অধিকাংশে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীত জগতের এই ত্রিফলা। তেমনি ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সারেং বউ’ সিনেমায় আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া’ এবং ১৯৮৪ সালের ‘নয়নের আলো’য় এন্ড্রু কিশোরের ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’ অনন্য স্থান হয়ে হয়েছে বাংলা সংগীতে। ‘নীল আকাশের নিচে আমি’, ‘আমার স্বাদ না মিটিল’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’-সহ কত কালজয়ী সিনেমার গান আজও মুখে মুখে ফেরে মানুষের। সেই তুলনায় হুমায়ূন আহমেদের ছবির কথা বাদ দিলে নতুন শতকের শেষ দিকে ও শুরুর দশকে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কেবল হাতেগোনা কয়েকটি গান। ১৯৯৭ সালে রিয়াজের প্রথম সিনেমা ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’র গান ‘পড়ে না চোখের পলক’ এবং ২০০৪ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নির্মিত ‘ব্যাচেলধর’ সিনেমায় এসআই টুটুলের গাওয়া ‘কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেমে পড়ে’ যা একটু ঠোঁট খোলাতে পেরেছিল মানুষের। ২০০৬ সালে রিয়াজ অভিনীত ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমায় হাবিবের গাওয়া ‘ভালোবাসবো বাসবো’ তো প্রায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের জাতীয় সংগীত হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে অশ্লীল সিনেমার কলঙ্ক মুছে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাসও দেয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। এরপর গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ জনপ্রিয়তা তো পায়ই, লোকজধর্মী গানগুলোও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা সিনেমায় সর্বশেষ হিট গানটি দিয়েছে ‘হাওয়া’। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানে মাথা দোলায়নি এমন দর্শক খুব কমই পাওয়া যাবে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন