Select Page

এগারো আগস্ট এবং ‘ওরা ১১ জন’

এগারো আগস্ট এবং ‘ওরা ১১ জন’

এগারো সংখ্যাটার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক কিছু। যেমন-মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ফুটবল ও ক্রিকেট। ফুটবল বা ক্রিকেটের খেলোয়াড় সংখ্যার মতো মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ছিল এগারোটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা যার অনেকটাই অর্ন্তভূক্ত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফায়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পেয়েছিল বাংলাদেশকে তুমুল ঝাঁকুনি দেয়া এক ছবি ‘ওরা ১১ জন’! স্বাধীন বাংলাদেশে শুটিং শুরু করে মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি এটি, যাতে অংশ নিয়েছিলেন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা। ছবির শুরুটা হয়েছিল ছয়বার তোপধ্বনির মাধ্যমে যা ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার প্রতীক!১১ আগস্ট ফাঁসি হয়েছিল ক্ষুদিরামের! ওরা ১১ জন ছবিতে ক্ষুদিরাম নিয়েও একটা গান আছে!

১১ আগস্ট মুক্তি পাওয়া ‘ওরা ১১ জন’ আরও কয়েকটা কারণে মানুষের মনে গেথে আছে। প্রথম কারণ তিন নারী। একজন কেয়া, একজন মিতা আর অন্যজন শিলা। মিতা মেডিকাল কলেজের ছাত্রী। মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় সে নিজেকে নিয়োজিত করে। পাকিস্তানী সেনাদের হাতে সে ধর্ষিতা হয়। বেদনার সব রঙ লুকিয়ে তবু মিতা ফিরে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে! মিতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাবানা। রাজ্জাক এই ছবিতে পারভেজ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নির্যাতন সয়ে তারও মুক্তি মেলে বিজয়ের পর। সে ফিরে আসে তার প্রেমিকা মিতার কাছেই। বীরাঙ্গনাদের জীবনে ফেরার গল্পও কিন্তু ‘ওরা ১১ জন’।

কেয়া এই সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধা নায়ক খসরুর কাছে অস্ত্র ও যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নেন। গ্রামে ফিরে কেয়া জানতে পারেন তার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। বাবার সামনে এসে কেয়ার চোখে জল এলেও সে গুলি করে মেরে ফেলে তার বাবাকে! আর শিলার বেদনাও মিতার মতো কিন্তু যুদ্ধ তাকে বাঁচতে দেয়নি। তাকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে আটকে রাখে,অমানবিক নির্যাতন চালায়। শিলার সাথে খসরুর বিয়ে হবার কথা ছিল। সিনেমার শেষ দৃশ্যে পাকিস্তানীদের পতনের পর মুক্তি পায় শিলা। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যুদ্ধফেরত খসরুর বুকেই সে মারা যায়। শিলার চরিত্রে রূপদান করেছেন ‘নূতন’।

যুদ্ধে অংশ নেয়া ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার ভেতরে শুধু আলতাফই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। খসরু, ফিরোজ, আতা, বেবি, নান্টু, মুরাদ, হেলাল, ওলীন, মঞ্জু এবং আবু এই দশজন সম্মুখযোদ্ধার কোন অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না। চৌদ্দ বছর ধরে সহকারি পরিচালকের কাজ করে হাত পাকানো প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই ছবির পরিচালক। খুব যত্নের সাথে তিনি সেইসময়কার টেলিভিশন ফুটেজ,জীবন বাঁচাতে মানুষের পালানোর দৃশ্য, বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ, ভারতে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষের জন্য তৈরি শরণার্থী শিবির ও পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দৃশ্য বদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করেছিলেন ছবিতে।

এই ছবির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ ওরফে পরবর্তীতে নায়ক সোহেল রানা কয়েকবার বলেছেন যে তাজা গোলা বারুদ এবং অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল এই ছবিতে। কালিয়াকৈরের ভাঙ্গা একটা সেতুতে শুটিংয়ের সময়ে তাজা বিষ্ফোরকের ব্যবহারের কারণে জল উঠে গিয়েছিল অনেক ওপরে,বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল সেই জল। মাছ মরে গিয়েছিল যা ধরে শুটিং এর মানুষদের খাওয়ানো হয়েছিল,এলাকার মানুষ বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে এগারজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়েই এই ছবি নির্মাণের কথা হয়েছিল। পরে লগ্নিকৃত টাকা ফেরত এবং ছবিটি ঠিক মতো যেন চলে সে কারণে রাজ্জাক, শাবানা, এটিএম শামসুজ্জামান, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, হাসান ইমাম ও মিনারা জামানদের নেয়া হয়েছিল। চাষী নজরুল ও সোহেল রানা একবার ভেবেছিলেন রাজাকারদের বিচারের দৃশ্যে আসল রাজাকারদের ধরে আনা হবে ও তাদের ব্রাশফায়ার করে মারা হবে। তবে ছবির বিদেশ ফেরত চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদ এই ভয়াবহ দৃশ্য শুটিং করতে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ছবিটি দেখেছিলেন।

ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন খোন্দকার নুরুল আলম। বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ এবং ‘একসাগরের রক্তের বিনিময়ে’ এই দুটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, যা এখনও সমান জনপ্রিয় আছে।

চাষী নজরুল ইসলাম, রাজ্জাক, সুমিতা দেবী, আলতাফের মতো ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হয়তো আরও নির্মিত হবে কিন্তু ‘ওরা ১১ জন’ বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের সমান্তরাল হয়ে!


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আহসান কবির

অভিনেতা ও লেখক

মন্তব্য করুন