কতটা রং ছড়িয়ে ছিল ‘মেঘের অনেক রং’
ঢালিউডে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নির্ভর অন্যতম সিনেমা ‘মেঘের অনেক রং’। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি পরিচালনা করেন হারুনর রশীদ। বোদ্ধাদের মন জয় করলেও সাধারণ দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে পারেননি ক্লাসিকটি।
১৯৭৬ সালে সেরা সিনেমা, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক (ফেরদৌসী রহমান), চিত্রগ্রাহক (হারুন অর রশিদ) ও শিশুশিল্পী (মাস্টার আদনান) বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় সিনেমাটি।
‘মেঘের অনেক রং’ প্রসঙ্গে ১৯৭৭ সালের আগস্টে ত্রৈমাসিক ‘চলচ্চিত্রিক’-এ লেখেন শুকদেব বসু। অনুপম হায়াৎ রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ বইতে লেখাটি সংকলিত হয় ১৯৮৭ সালে। লেখাটি থেকে জানা যায় ওই সময়েও একটু অন্য ধরনের সিনেমার ভাগ্য এখানকার চেয়ে কোনো অর্থে ভাল ছিল না। কিন্তু লেখাটি বলে দেয় কিছু বোদ্ধা তো ছিলেনই! নিচে লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
এক.
মেট্রোপলিটন ঢাকা এবার যখন বৃষ্টিতে অতিরিক্ত ভিজে ভিজে শ্রীহীন তখন আকাশও মরুময়, ধূসর। দলছুট রং-এরা তখন কোথায়। ছাই-পাশ মেঘ শুধু বৃষ্টি ঝরায়। এর মধ্যে তুমুল দাবীতে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় একটিমাত্র প্রেক্ষাগৃহে ‘মেঘের অনেক রং’ অপমানের প্রতিশোধ স্পৃহায় আবার এসে দর্শকের মন হারায়।
নাজ-এর স্বল্পায়তনে ‘মেঘের অনেক রং’ বিভোর ভেসে বেড়ায়। প্রদর্শক. অর্থকামী প্রদর্শক দর্শকের অক্ষয় বিপুল স্বরে রজত-সূবর্ণ-স্বর্ণ রজন্তীর স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। দুঃস্বপ্নের মতো।
সে শ্রাবণে দু’একদিন দর্শক হুতাসনের পর পুনরপি ‘মেঘের অনেক রং’ ক্ষুদ্র-ভদ্র নাজে এক সপ্তাহের মুক্তি-বিলাসে প্রণত হয়।
দুই.
১৯৭৫-এ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত ফিল্ম এ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স যখন ঘোর নিয়মানুপাতে চলছে তখন শিক্ষাকক্ষে মাঝে মাঝে অনুপস্থিত থাকতেন একজন। পরে তার অনুপস্থিত সময়ের কারণ সার শুনতাম দীর্ঘ সময় ধরে। যখন তিনি প্রবল উচ্ছ্বাস, প্রত্যয়ে, রুদ্ধশ্বাসে বলতেন তার ‘ভালো ছবি’-র গল্প। “মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একটা পরিচ্ছন্ন ছবি করছি-ব্যাস” এইটুকু ছিল তার বিনয়-ভাষণ। অন্যত্র উপস্থিত সেই অনুপস্থিত একজন ছিলেন ‘মেঘের অনেক রং’-এর তরুণ ভেদী প্রযোজক আনোয়ার আশরাফ। ছবিটার তখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। আনোয়ার আশরাফের সঙ্গে তখন সৃষ্টি-কর্মে উত্তেজিত দিন অতিক্রম করছেন পরিচালক হারুনর রশীদও। অগত্যা আমরাও প্রবল আগ্রহে ছবিটির পরিণতির জন্য তৈরী হয়ে রইলাম সেদিন থেকেই। কারণ ইতিমধ্যেই আনোয়ার আশরাফ এবং হারুনর রশীদের নাম নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের সীমানায় সু-চিহ্নিত।
তিন.
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরুল- বাংলাদেশের প্রথম রঙ্গীন ছবি ‘মেঘের অনেক রং’। কিন্তু প্রথম হলো না। দিন-মুক্তির সৌভাগ্য প্রথম হলো ‘বাদশা’। দ্বিতীয় ‘মেঘের অনেক রং’ প্রথম হোল অন্যত্র। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমে। চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি এবং চলচ্চিত্রকার সমিতির বিচারেও যোগ্য সম্মান অর্জল করল ছবিটি।
কিন্তু ‘মেঘের অনেক রং’ ধ্রুব হয়ে উঠল অন্যত্র। অথর্ব ইতিহাসের করুণ অধ্যায়ে এসে সে স্থবির, চিত্রার্পিত হয়ে রইল। স্বর্ণাক্ষরী পুরস্কারের পেলব পৃষ্ঠপেষণে প্রদর্শকদের ‘ঐক্যবদ্ধ বদমায়েশীর’ ব্যারিকেড ভেঙ্গে সে স্থবিরতা নাশ কার সাধ্য।
চার.
যুক্ত-প্রতীক্ষার দিন ক্ষয় হতে হতে যখন শূন্যগামী তখন একদা নাজ প্রেক্ষাগৃহে ‘মেঘের অনেক রং’-এর একটি/দুটি প্রাক-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন প্রযোজক কর্তৃপক্ষ। সে সময় ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় একটি ‘ভাল ছবি’-ই দেখেছিলাম— বছরে তিন ডজন বাংলাদেশী বায়োস্কোপবাজীর হুলুস্থুলে।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নির্ভরতায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশের যে ছবিগুলো নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে শিল্প-সামর্থে ‘মেঘের অনেক রং’ বিশিষ্ট। কারণ বিশ্বাসের পক্ষে হানিকর কোন অলৌকিক বীরগাঁথা ছবিটিকে বক্তব্য-চ্যুত করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একটি তরুণ দম্পতির মধ্যে যখন অতীত এসে স্থিত হয় তখন কিছুক্ষণের জন্য বিপর্যস্ত হয় সেই দম্পতির সেই চলিষ্ণু জীবন। ‘সুখ তৃপ্তি আর তাদের চোখে-মুখে ডাকটিকিটের মত লেগে থাকে না’। এবং সেই অতীত সময়টা মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। যে সময়ে তরুণ ডাক্তার তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এবং ভালবেসে পুনর্বিবাহ করে একটি উপজাতি মেয়েকে। ঘটনার ক্রমাগ্রসরতায় তরুণ ডাক্তারের লাঞ্ছিতা স্ত্রী নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে একদা তার স্বামীর গৃহে পৌঁছে দেয় তার সন্তানকে এবং নিজে আত্মহত্যা করে। অতঃপর সেই সন্তানই তাদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। এভাবেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ঘটনা-দুর্ঘটনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। জীবন তাকে বয়ে চলে।
ছবির কাহিনী বর্ণনায় কোন আরোপিত চমৎকারিত্ব নেই। নিরীক্ষার মৈত্রীভাব অলংঘনীয় কোন দুর্বোধ্যতাকেও প্রশ্রয় দেননি পরিচালক। সূবর্ণ চলচ্চিত্রায়নে তিনি সাধারণ একটা গল্পকে বিশ্বাস-নির্ভর করেছেন ‘মেঘের অনেক রং’এ। দীর্ঘদিন পর এই প্রথম বাংলাদেশের একটি ছবিতে সঙ্গীতের প্রযোজনীয় সখ্যতা অনুভূত হোল (ফেরদৌসী রহমানের) পরিমিত আবহ সঞ্চারের কারণে। অকারণ সঙ্গীত-স্থুলতা যেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
অসম-অর্থনীতি-শিষ্ট শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শিল্পমনস্ক চলচ্চিত্রে আমাদের অলস-নিরলস প্রত্যাশায় ‘মেঘের অনেক রং’ অজস্র চিন্তা-ক্ষরণ ঘটায়। কারণ এর ধরনের শিল্প-প্রেমী সৎ চলচ্চিত্র কর্মীদের কবজা থেকেই ‘মেঘের অনেক রং’ উর্ধ্বায়ূ হয়। আর এইসবের পেছনে থাকে একটা অমিত সাহস। এইসব সমবেত সাহস একদিন দুঃসাহসে পরিণত হলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘শিল্প’ হয়ে উঠবে।