গলুই: ম্যাজিক, দ্বিধা, সম্ভাবনা ও হতাশা
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: যারা মাশালা, থ্রিলার, সুপার হিরো বা মার্ভেল সিরিজের উদ্ভট সিনেমার আসক্ত এবং যারা শাকিবের ‘মুই কি হনু রে’ টাইপ রিয়্যাক্ট সিনেমার ভক্ত, ‘গলুই’ তাদের জন্য নয়।
এবারের ঈদের সিনেমার সবচেয়ে বড় ম্যাজিকের নাম ‘গলুই’। প্রভাবশালী প্রযোজক থাকার পরও কম হলে মুক্তি কিন্তু আলোচনায় সবার চেয়ে এগিয়ে। এটাই ম্যাজিক। সুপার-ডুপার হিট সিনেমা এবং গানের পরিচালক এস এ হক অলিক বছর কয়েক বিভিন্ন প্লাটফর্মের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে অবশেষে সিনেমা নির্মাণে ফিরলেন, যা আশাব্যঞ্জক।
এই সিনেমাটির বড় ম্যাজিক তিনটি। প্রথমত সেট/লোকেশন এরেঞ্জমেন্ট খুব ভালো। দ্বিতীয়ত নৌকাবাইচের শুটিং কতটা শ্রম পেয়েছে তা পরিস্কার বোঝা গেছে। ড্রোন শটের বাইরে ক্যামেরার শটগুলো ইউনিটের শ্রম ও যথাযথ খরচের ব্যপারটাকে সামনে এনেছে। এ জন্য সাধুবাদ।
সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় ম্যাজিক হচ্ছে ‘পূজা চেরি’। পর্দায় রীতিমতো শাকিব খানকে ডোমিনেট করেছে। যাকে আমরা সিনেমার ভাষায় বলি: সহ ক্যারেক্টারকে খেয়ে দেয়া। বিভিন্ন সময় চরিত্রের নানান পরিবর্তন খুব ভালভাবে সামাল দিয়েছে সে। এই সময়ের যে কোন নায়িকার চেয়ে অনেক বেশি সাবলীল ও অনেক বেশি চরিত্র ধারণ করতে পারার ক্ষমতা সে দেখিয়েছে। তাকে এই সময়ের নাম্বার ওয়ান বলার সময় বোধহয় কাছাকাছি চলে এসেছে। অন্যদিকে শাকিব খান সাবলীল। লুঙ্গিপড়া শাকিব সবসময়ই আমার পছন্দের। তবে দূর্বল চিত্রনাট্যের কারণে তাকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যতটুকু শাকিব দেখিয়েছে, পুরোটাই তার নিজস্ব দক্ষতা।
‘গলুই’র আরেকটা ব্যাপার ভালো লেগেছে। ছোটবেলা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট স্টাবলিশ করে, বড় বেলায় তা কন্টিনিউ করা। শাকিব ও পূজা দুজনই সেটা ভালভাবে টেনে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে ৬ ইঞ্চি থেকে ২২ ইঞ্চি মনিটরে সিনেমা/গান দেখা প্রজন্ম ৬০-৭০ ফিট পর্দার ম্যাজিক সম্পর্কে ধারণা রাখে না। তাই তারা বড়পর্দায় শাকিব-পূজা দ্বৈরথ নিয়ে মানা-না মানার সিদ্ধান্তে ভুল করেছে বলেই মনে করি। বড় পর্দায় আসলেই তারা মানানসই ছিল।
পিরিয়ডিক সিনেমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে সময়কে পর্দায় হাজির করা। অ্যানালগ যুগের ডিজিটাল ব্যানার জানিয়েছে বাংলা ১৩৯৭ সালের গল্প এটি। অ্যানালাইসিসে কস্টিউম ইস্যুকে মানা গেলেও মেকআপ খুবই বাজে ছিল। সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিদ্যুৎহীন চরের জীবনযাপন ইত্যাদি ব্যপারের সাথে আজকের প্রজন্ম কোনভাবেই পরিচিত নয়। ফলে তারা সিনেমাটির সাথে একাত্ব সেভাবে হতে পারবে না বলেই মনে করি। অন্যদিকে সিনেমাটি একটু ধীরগতির। ফলে ২০২২ সালে বসে ১৯৯০ পরবর্তী জীবনটা প্রজন্মকে ধরাতে গেলে যে ম্যাজিকটার প্রয়োজন ছিল, তা গল্প-চিত্রনাট্য কোথাও ছিল না। তার উপর শাকিব খান নিজে বছরের পর বছর ধরে নিম্নমানের মাশালা সিনেমা করে দর্শক রুচির যে অধঃপতন ঘটিয়েছে, তার ফলাফলও এই সিনেমাটিকে আক্রান্ত করেছে।
সিনেমার গানগুলো দেখতে মোটামুটি উত্তম হলেও, শুনতে সেভাবে আবেদন রাখেনি। হাবিব ওয়াহিদ কি এই প্রথম কোন সিনেমার গানে ফ্লপ করলো! বাকি গানগুলোও তেমন কিছু হয়নি। তবে বৃষ্টির প্রতি প্রার্থনার গানটাকে পাশ নাম্বার দেয়া যেতে পারে।
সিনেমাটি দেখতে মানুষ হলে যাচ্ছে এটা পজিটিভ ব্যপার। অনেকে পরিবার নিয়ে যাচ্ছে এটা আরো বড় খবর। তবে সিনেমা হলগুলোর সিট, ফ্যান, প্রজেক্টর, পর্দা, সাউন্ড এবং সর্বশেষ টয়লেট, এসব ব্যপারে হল মালিকদের একটু সভ্য হতে হবে। যে দর্শক সিনেমাটি দেখতে আসছে, এটাই যেন তার এই হলে শেষবারের মতো আসা না হয়।
একটা আগাম তথ্য দেই। সিনেমাটির শিল্প নির্দেশক, নৃত্য পরিচালক ও চিত্রগ্রাহক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ব্যপক ফাইট দেবে। তবে জোরজবরদস্তি করে বেশকিছু বিভাগে পুরস্কার বগলদাবা করার চেষ্টা করবে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। হয়ত সফলও হবে। অথচ সেগুলো আসলে পাবার যোগ্য নয়।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ টানি। ‘গলুই’কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের জন্য যে জুরিবোর্ড সুপারিশ/বাছাই করেছে, তাদের বিচার হওয়া উচিত। নৌকা বাইচ আর বৃষ্টির জন্য গান, সর্বোচ্চ ৭/৮ মিনিট। এটুকুর বাইরে এই সিনেমার গল্পে কী এমন ছিল যে অনুদান দিতে হলো! এই যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের মমি বানিয়ে ফিল্ম-আর্কাইভে রাখার দাবি জানাই। অনুদানের সিনেমাতে এমন অনেক কিছু থাকা লাগে যা সংস্কৃতি-সভ্যতা-ইতিহাসকে তুলে ধরে। যা প্রজন্মকে সেই সময়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ অনুদানের সিনেমা এক প্রকার ইতিহাসের খেরোখাতা বা আর্কাইভ হিসেবে বিবেচ্য। সেখানে এই সিনেমাটিতে তার কিছুই নাই। না ক্লাসিক মুভি, না আর্ট ফিল্ম, না মাশালা সিনেমা!