Select Page

চরকির অন্যতম প্রাপ্তি ‘ষ’

চরকির অন্যতম প্রাপ্তি ‘ষ’

নুহাশ হুমায়ূনের চার পর্বের এন্থলজিক্যাল সিরিজ ‘’ মুক্তি পেয়েছে চরকিতে। হরর জনরার মাঝে সাইকোলজিক্যাল, হিউমার ও সাসপেন্স এলিমেন্ট রেখে একেকটি পর্ব সাজিয়েছেন তিনি।

এই Building এ মেয়ে নিষেধ

নুহাশ হুমায়ূন পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছেন ‘হিউমার’ আর যোগ করেছেন ক্রিয়েটিভিটি। সিরিজের প্রথম পর্ব দেখে সেটা আবারও মনে হলো।

আধঘণ্টারও কম সময়ের অ্যাপিসোডের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে পেত্নীর উপস্থিতি আছে। বাড়িতে মাছ আনলে পিছুপিছু পেত্নী আসার যে কথা ছোটবেলা সবাই শুনেছি সেটা নুহাশ গল্পের ভেতর গল্প ঢুকিয়ে দেখালেন। গল্পকথকের সঙ্গেই খালি বাসায় এক রাতে দেখা হয় পেত্নীর, যে মেঝেতে মেরে রেখেছে কথকের রুমমেটকে। এই অবস্থায় কথক নিজে বাঁচার কয়েকটা পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারপর একটা ট্রিক্স শেষমেশ এপ্লাই করে আর গল্পটা শেষ হয়েও হয় না শেষ!

গল্পের বেসিকটা দূর্বল লেগেছে। আরেকটু ভিন্ন এঙ্গেল থেকে ভেবে কথক আর পেত্নীর ফেস অফটা উপভোগ্য করা যেতো। গল্পের শেষটাও কিছু প্রশ্ন রেখে যায়। তবে হরর জনরার এমন ট্রিটমেন্ট নতুনই লেগেছে।

সোহেল রানা বরাবরের মতো একটা টোন ধরে এক্সপ্রেশন থ্রু করেছেন, যেহেতু ডায়লগ ছিল না বললেই চলে। কাঁচা মাছ টেনে টুকরো করার দৃশ্যটা বেশ ভালো। পেত্নী চরিত্রে শিরিন আক্তার শিলাকে মানিয়েছে তার মেকাপের সঙ্গে এক্সপ্রেশনের জন্য, তবে অভিনয়ে কিছু করার ছিল না।

মিষ্টি কিছু

যখনই ভাবি চঞ্চল চৌধুরীকে আমরা টাইপকাস্ট করে ফেলছি বা চঞ্চল নিজেই নিজেকে ছাড়ানোর মতো কাজ দিতে পারছেন না তখনই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

‘মিষ্টি কিছু’তে একটা দৃশ্য আছে যেখানে চঞ্চল স্মৃতির খুবই গভীরে গিয়ে মনে করার চেষ্টা করছেন তার জন্মের সময়টা, প্রচণ্ড মানসিক চাপ আর অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছেন চিৎকারে – It was OUTSTANDING!!

আগেই অনেকে জানেন এটা হরর সিরিজ, অনেকেই জানেন নুহাশ ‘হিউমার’ ব্যবহারে নিজের কাজটা আলাদা করেছেন তবে ‘মিষ্টি কিছু’ আপনার মনে দাগ কাটবে ভিন্ন কারণে। মিষ্টির দোকানে জ্বিন আসার ব্যাপারটা মোড়ক হিসাবে রেখে ভেতরে গুজে দেয়া হয়েছে আমাদের নেতিবাচক মনোবৃত্তি, জীবনের বাজে স্মৃতি ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা, সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অব্যক্ত কান্না, মানুষে মানুষে হানাহানি, ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাতের মত মারাত্মক কিছু বিষয়।

চঞ্চল চৌধুরী, দ্য গ্রেট আফজাল হোসেন কিংবা কাজী নওশাবা আহমেদের অভিনয়ের মুগ্ধতা বাদ দিলেও এই পর্বটি সুন্দর এর দারুণ বিষয়টির পরিমিত উপস্থাপনের জন্য!

লোকে বলে

এক নিমিষে দেখে ফেললাম ‘লোকে বলে…’। লোকে যা বলে তার সবটা সত্য না তবে এই বলার পেছনে অবশ্যই একটা গল্প থাকে। কথায় আছে ‘যেখানে ধোঁয়া, সেখানে আগুনও আছে’! আর এই কথাটা বেশ মানে সারা। নাগীবের সঙ্গে সারার সম্পর্কটা গভীর। দুজন মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড় আর নদী ঘেষা কোন এক প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে লোকালয় নেই, নেটওয়ার্ক নেই, অবধারিতভাবে নেই ফোনের চার্জার পাওয়া যাবে এমন কোন দোকান। এর মধ্যে নাগীবের ফোনে অপ্রীতিকর কিছু দেখে অভিমান করে বসে সারা। পথিমধ্যে দেখা হয় এক বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধার সঙ্গে। যারা দাবি করে এই গ্রাম থেকেই সব কুসংস্কারের উৎপত্তি ও ছড়িয়ে পড়া। সারা আর নাগীব মুখোমুখি হয় সেসব গল্পের!

এই পর্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ‘মেটাফোর’-এর ব্যতিক্রমী ব্যবহার। পুতুলনাচ দিয়ে একটার পর একটা কুসংস্কারের পেছনের গল্প আর সব গল্পের কম্বিনেশনের ট্রিটমেন্টটা দারুণ..দারুণ..এবং দারুণ! অবাক হয়ে দেখলাম, পুতুলনাচ দিয়ে নুহাশ গল্প বলে গেলেন কত অবলীলায়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ন্যারেশান খুব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে শেষে এই পুতুলনাচের জন্যই। স্পেশাল থ্যাংকস আমার রইলো সেই শিশুশিল্পীর জন্য যাকে ঘিরে পুরো গল্পের আবহ!

সৈয়দা তাসলিমা হোসেন নদীর কাজ থিয়েটারে দেখেছিলাম। সে পর্দাতে খুব সহজাত ছিল, কোন অভিনয় করেছে বলে মনেই হয়নি। কার্টুন আঁকার মানুষ মোরশেদ মিশু চমকে দিয়েছে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে। তবে বৃদ্ধের চরিত্রে তৌফিকুল ইমন আর বৃদ্ধা গীতশ্রী চৌধুরীর ন্যারেশান চমৎকার ছিল!

এই পর্বের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর বাচ্চার শিরশির হাসিটা খুব ভালো ফিল এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে খুব ভালো ছিল। এটাকে আমি ‘মিষ্টি কিছু’র পরেই রাখব।

নিশির ডাক

এই পর্বটা আসলে পুরো সিরিজের একটা সারাংশের মত, এমনকি সেকেন্ড সিজন করার রেশটাও ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এই পর্বটা অনেকবেশি আত্মিক ও এনালিটিক্যাল লেগেছে।

গল্পে দেখা যায়, একজন এনজিওকর্মী যে মানসিকভাবে একটা বাজে সময় পার করছে। কক্সবাজারের সমুদ্রের আবহের সঙ্গে তার একাকীত্ব আর হারিয়ে ফেলা মানুষের বিরহের মিল আছে বলেই হয়তো সে বারবার সমুদ্রে যায়। তবে গল্পের নামটা এসেছে নিশি নামের এক অশরীরীর আচরণ থেকে যে ডাক দিয়ে সাগরে মানুষকে নিয়ে তলিয়ে ফেলে, বিষয়টা অনেকটাই হিপনোটাইজড লেভেলের। এই এনজিওকর্মী তার কলিগকে এই নিশির ডাক নিয়ে সায়েন্স আর রিউমারকে ব্যাখ্যা করলেও একসময় তার জীবনেই একটা চ্যালেঞ্জ আসে।

নুহাশ হুমায়ূন এই পর্বে হরর অংশটুকু থেকে সাইকোলজিক্যাল অংশে জোর দিয়েছেন বেশি। যার জন্য প্রীতমের ক্যারেক্টারটা সবসময় একটা কনফিউজিং মাইন্ড অফ স্টেটে থেকেছে। প্রীতম অভিনেতা হিসেবে দিন দিন ভালো করছে এটা ভালো দিক, তার এক্সপ্রেশনে অনেক উন্নতি চোখে পড়েছে। নভেরা রহমানের সবচেয়ে ভালো লাগার দিক তার এডাপ্টিবিলিটি। ক্যারেক্টার সে খুব সহজাতভাবে ধারণ করে, অল্প সময় থাকলেও এখানে ভালো করেছে সে। মাসুদা খান একটা দৃশ্যে বেশ ভয় ধরিয়ে দিয়েছে তবে তার উন্নতির অনেক জায়গা আছে।

এই সিরিজটি চরকির অন্যতম প্রাপ্তি বলে আমার মনে হয়। এক্সপেরিমেন্টাল এই কাজটা আরো চলুক পরের বছর, তাই চাই।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

Graduated from Mawlana Bhashani Science & Technology University. Film maker and writer.

মন্তব্য করুন