Select Page

দীপংকর দীপনের রিভিউ: নুহাশ হুমায়ুনের ‘মশারি’, স্বল্প কিন্তু অল্প না

দীপংকর দীপনের রিভিউ: নুহাশ হুমায়ুনের ‘মশারি’, স্বল্প কিন্তু অল্প না

 (কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে নুহাশ হুমায়ূনের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘মশারি’। সেই ছবির রিভিউ করেছেন খ্যাতিমান নির্মাতা দীপংকর দীপন। রিভিউটি তার ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া।)

সুনেরাহ বিনতে কামাল

আচ্ছা মশারির ইংরেজি কি? নেট? মাসকিটো নেট? দি প্রটেক্টর, তখন আমাদের প্রডিসার বললো- ইংরেজী করতে হবে কেন- নাম মশারিই থাকুক। আমাদের খুব পছন্দ হলো ওর কথা। ছবির নাম রাখলাম – মশারি। জাস্ট মশারি। বিদেশীদের আমরা বাংলা শেখাবো। বলছিল নুহাশ। মশারি শর্ট ফিল্মের বিশেষ প্রদর্শনীতে। খুব যে গম্ভীর গম্ভীর দেশপ্রেমের কথা বলছিল – তা না । দুষ্টামি করছিল বেশি। ছবির শুরুতে বলছিল- আপনাদের সবার সিটের নিচে থ্রিডি গ্লাস রাখা আছে। সবাই একটা ধাক্কা খেল- তারপর নুহাশ হেসে বলল ফান করছি।

নুহাশ বা তার নির্মাণ বন্ধুরা সেই আমাকে চেনেনা, কেউ কেউ ম্যাক্সিমাম আমার নাম জানে হয়তো। আমি গিয়েছিলাম সুনেরাহর গেস্ট হিসাবে। আমি অ্যাম্বিভার্ট মানুষ। নিজে থেকে মেশা হয়না। নিজেদের স্ক্রিনিং ফলে কোন মিডিয়া ছিল না- ছিল না সিনেমার চেনা মানুষেরা। আর ইংলিশ মিডিয়াম এই সার্কেলটার কারো সাথে আড্ডা মারার মত সখ্যতা আমার নেই। ফলে এক কোনায় একাকী বসেছিলাম এসকেএস টাওয়ারের স্টার সিনেপ্লেক্সের একটি হলে।

পথের জ্যাম। ছবি একটা পরেই শুরু হলো। ২০ মিনিটের ছবি। সবাই যতটা না ছবি দেখলো আমি একজন মেকারকে দেখলাম। আমি মেকিং দেখলাম। ডিসটোপিয়ান গল্প। বিষাক্ত মশার প্রাদৃর্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে। সাথে মশা মনস্টার, ভ্যাম্পায়ার। পুরো পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ মরে শেষ। বার বার মাইকিং করে বলা হচ্ছে, সন্ধ্যার পরে কোন ভাবেই মশারির বাইরে না থাকতে। শহরে অল্প কিছু মানুষ বেঁচে রয়েছে-  সেই শহরের দুটো বোন – তাদের সারভাইভের গল্প।

প্লট অসাধারণভাবে পোট্রেট করেছে নুহাশ। আমি নুহাশের মধ্যে এক দুর্দান্ত মেকার দেখেছি। আমার বারবার মনে হচ্ছি ইশশ নুহাশকে যদি একটা প্যানাভিশন ক্যামেরা আর টিম দিতে পারতাম- এই ছবি শুট করার সময়। একটা ১৫ লাখ টাকা আর ১৫ কোটি টাকার ক্যামেরার পিকচার কোয়ালিটির যে পার্থক্য সেই পার্থক্য ছাড়া মশারির সব কিছু আন্তর্জাতিক মানের। আমার কয়েকবার মনে হয়েছে চিলড্রেন অব মেন- এর মত কিছু দেখছি। ভাবা যায়- এই যা এখন কেউ আবার বলবে- আমি বেশি প্রশংসা করে ফেলি- তাদের জন্য আজ একটু ব্যাখ্যা করে বলি।

একটি ছবির যে কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর ছবির ইমপ্যাক্ট তৈরি হয়ে, সেগুলো বিচারে বলি—

ভিজ্যুয়াল ও আর্ট: অসাধারণ ভিজ্যূয়াল তৈরী করেছে নুহাশ ও তার টিম। চেনা বাংলাদেশ ভীষন অন্য ভাবে দেখয়েছে, সিনেমাট্রোগ্রাফি-আর্ট-কালার-লাইট মিলে ডিসটোপিয়ান, ভাইরাস আক্রান্ত এক শহরের ছবি দেখিয়েছে, যেটা দেখে অচেনা একটি অনুভূতি হচ্ছিল। যেটা এই ছবিটাতে খুব দরকার ছিল। দুই বোনের বাড়ী যেখানে দেখিয়েছে- সেটা আরো ভালো, আবছায়া রাতের আলো, হেইজ এর ফিল সব মিলিয়ে একদম ঠিকঠাক। না একটু বেশি না একটু কম।

কনটেন্ট ও স্টোরি: ডিসটোপিয়ান গল্প পৃথিবীতে অনেক হয়েছে- সেই ভিড়ে চিলড্রেন অফ মেন আর কুয়ারনও আছে। গল্পটাকে সেই লেভেলে নিয়ে গেছে নুহাশ। নয়ার-হরর-জম্বি-সব মিলে একটা এমন জায়গায় পৌছেছে ছবিটা, কখনও লিঞ্চ, কখনো ডেল তরোর ছাপ পাচ্ছিলাম।

অভিনয়: সুনেরাহ জাস্ট অসাধারণ করেছে। কী সুন্দর ক্যারেক্টারটা ধরেছে ও এবং শেষ পর্যন্ত ছাড়ে নাই এক বিন্দুও। ইমপ্যাক্ট ফুল অভিনয়- ইন্টারন্যাশনাল লেভেলের। সত্যি সুনেরাহ – তুই অসাধারণ অভিনেত্রী- শুধু তোকে ঠিকমত ব্যবহার করার জন্য ক্যারেক্টর চাই। ছোট বোনটি অনেরাও খুব অসামান্য। তাকে যেহেতু আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না- জানি না সে এই রকমই কিনা- আর কোন কাজও দেখি নাই – অ্যাক্ট্রেস হিসাবে তাকে জাজ করতে পারছি না- কিন্তু এই ছবিতে সে অসাধারন করেছে- মিশে গেছে ছবির সাথে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কে বেশি ভাল করছে – সুনেরাহ নাকি অনেরা- সে এক মধুর যন্ত্রণা।

অনেরা

সিন মেকিং: সিন মেকিং বলতে শট বাই শট জোড়া দেয়া এবং সেই সাথে সিন বাই সিন জোড়া দেয়া- যেখানে শেষে গিয়ে মনে হয় পুরো ছবিটা আসলে একটি সিন। মনেই হয়না অনেক শট দেখেছেন, আরেকটু গভীরে গিয়ে বললে  আপনার মনেই হবে না আপনি শট দেখছেন- মনে হবে আপনি সেখানেই আছেন। সেটা তখনই হয়- যখন আপনি যা দেখতে চান অবচেতনে পরিচালক সেটাই দেখায়। যেটা তখনই হয়, যখন শট গুলো শক্তিশালী আর জোড়া দেয়াটা ( সম্পাদনা)  বুদ্ধিদীপ্ত হয়,  সেটা মশারিতে পুরোপুরি পেরেছেন নুহাশ- একজন শক্তিশালী মেকারের গুনটা এখানেই।

শব্দ: আবহে- স্কোরে একটা ডিসটোপিয়ান ফিল তৈরি করা খুব দরকার ছিল এই ছবিটাকে। শুরুতে একটি মাইকিং আছে- মসজিদের মাইকিং- যেখানে ভোকালটা ছিল প্রীতমের। সেটা থেকে শুরু করে  ফলি , এস এফ এক্স আর ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক সব মিলে শব্দের যে জগত নুহাশের দল গড়েছে তাতে ভয় আছে- সাসপেন্স আছে- থ্রিল আছে- আছে বিষন্নতা। ভয় আর বিষন্নতার মিশেল – মশারির বড় গুন।

ছবির এন্ড টাইটেলে একটা বাংলা গানের অভাবে বোধ করছিলাম। ন ডরাই-এর যন্ত্রণার মত জেফার এর কোন ট্র্যাক। সেটা পাইনি। অতৃপ্তি এই একটা জায়গাতেই। মশারির ইন্টারন্যাশনাল স্বীকৃতি অনেক। অনেক ভালো ভালো জায়গায় অনেক বড় ফিল্ম মেকারের সাথে নুহাশের মশারি দেখানো হয়েছে সেখানে। এসেছে স্বীকৃতি- পুরস্কার- সামনে আরো যাবার পথ আছে। যুক্ত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্টরা নুহাশের সাথে। প্রসংশা পেয়েছে অনেক- সামনেও অনেক জায়গায় যাবার আছে। 

সবার আসে না। নুহাশের আসে, নুহাশ পারে। নুহাশকে সত্যি আমার আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম মেকার মনে হয়েছে। তবে নুহাশ তোমাকে পথ চলতে হবে আরো অনেক পথ। যে পথের স্টেশনে টিকেট কিনতে পেরেছে নুহাশ- ট্রেনটা এখনও আসেনি। তুমি অপেক্ষা করছো স্টেশনে। গোটা দশের ট্রেন বদলে তারপর অনেক দুরে তোমার গন্তব্য। সাথে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। নুহাশ তোমার মধ্যে অমিত সম্ভাবনা আছে। সেটা লালন করো।  আমি  আমি তোমাকে বলবো না সবাইকে ম্যানেজ করে কথা বলতে শেখ- বলবো না গুরু জনকে সম্মান কর- অহংকারী হয়োনা- এসবের সাথে চলচ্চিত্রের কোন সম্পর্ক নাই। বরং বলবো নিজের মত করে নিজেকে ছেড়ে দাও। যা মনে আসে কর- যেভাবে ভাল লাগে কোর। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের গল্প বদলে ফেলনা। তোমার মধ্যে যা আছে- সেটাকে লালন কর প্রকাশ কর- শুধু একটা কথা বলবো যে কোন মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়া- থেকে দুরে থাক। এসবে সময় ব্যায় কোরনা। তোমাকে নিয়ে সময় ব্যায় করবে মানুষ। যাদের সাথে তরিকা মেলে, তাদের সাথেই থাক, তাদের নিয়েই থাক। বাহাসে কিচ্ছু হয় না। অ্যাক্ট কর,  রিঅ্যাক্ট না। ইগনোর করা শেখ। সারোয়ারের কাছে (ফারুকী)  কাছে এই গুনটা ধার নাও। আর তোমার টিমটাকে আগলে রেখ। অসাধারণ একটা টিম। 

দীপংকর দীপন

লেখাটা শেষ করবো – মশারির টিম নিয়ে। সুনেরাহ আর প্রীতম ছাড়া এই টিমের কাউকেই আমি চিনিনা। টিমটা অসাধারণ। বার বার টাকা ফুরিয়ে গেছে – টাকা জোগাড় করে কাজ হচ্ছে- যাকে মুম্বাইওয়ালা বলে যুগার- এই যুগারের উপর তৈরী হয়ে অনুরাগের প্রথম দিককার ছবি গুলো- আরো অনেক অনেক ইনডিপেনডেন্ট ছবি। জোগাড় করতে করতে এই টিম বানিয়ে ফেলে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের একটি ছবি।

গতকাল (২৮ এপ্রিল) আমি একটা গুড ফিল নিয়ে বের হয়েছি স্ক্রিনিং থেকে — সেখান থেকে বেরিয়ে গেছি বাপ্পাদার স্টুডিও- সেখানে অপারেশন সুন্দরবন ছবির একটি গানের রেকর্ডিং চলছিল। আমিই লিডার এ পরিচালক তপুও ছিল। বাপ্পাদা বলছিল- বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ কি দাদা? বাপ্পাদাকে বলছিলাম, সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ বলতে পারি না, তবে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। কারণ জাস্ট আমি মশারির একটি প্রাইভেট স্ক্রিনিং থেকে এলাম।


মন্তব্য করুন