টিকেটের দাম বাড়িয়ে সিনেমার উন্নতি হবে না
কাকরাইলের রাজমনি সিনেমাহলটা আজ নেই। আমার ক্যাম্পাসের পাশে হওয়াতে প্রচুর সিনেমা দেখতাম এই হলে। হঠাৎ আজ এই সিনেমা হলের কথা মনে পড়লো ক্যান?মূলত আমার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে এই হলের ভিতরে। তখন তৌকির আহমেদের ‘হালদা’ রিলিজ হলো।
আমি আর আমার এক বন্ধু দেখতে গেলাম ছবিটা।
ছবি শুরুর আগে জাতীয় সংগীতের সময় আমি আর আমার বন্ধু সম্মানপ্রদর্শন করে দাড়ালাম। আমরা দাঁড়ানোর পরপরই পিছন থেকে দুটো ছেলে বলতাছে ‘ভাই দাঁড়িয়ে কেন বসেন?’ আমি বললাম জাতীয় সংগীত চলছে। দুটো ছেলের মধ্যে একজন বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বলে উঠলো, এত দেশপ্রেম চু*ইতে হবে না মিঞা’! আমি কোনো উত্তর দেই নি। কারণ ছেলেগুলোর চেহারা-সুরত দেখে মনে হয়েছে তারা স্থানীয় আর কিছুটা বখাটে। তবে উত্তর দেওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছে ছিলো আমার কিন্তু বন্ধু আমাকে আটকিয়ে দিয়েছিলো।
আমি সিনেপ্লেক্সে খুব কম সিনেমা দেখেছি। আমার জীবনে দেখা ৯০ পারসেন্ট সিনেমা আমি সিনেমা হলে বসে দেখেছি। অনেক বাজে অভিজ্ঞতা হয় সিনেমা হলে ছবি দেখতে গেলে। জাতীয় সংগীতে দাঁড়াতে গেলে পিছন থেকে হাসাহাসি, সিটের সামনে পা দিয়ে বসে থাকা, সিগারেট খাওয়া অনেক সময় কোনো নারী দর্শক আসলে একটু বেশী ওভারস্মার্ট হয়ে চিল্লাচিল্লি করা! এমন আরও বহু কিছুর সম্মুখীন হতে হয় সিনেমা হলে।
এক সময় এই দেশের সিনেমা বিজনেসের প্রায় পুরোটাই আসতো এসব সিঙ্গেল স্ক্রিন থেকে কিন্তু আজ উল্টো হয়ে গেছে। সিঙ্গেল স্ক্রিনে দর্শক কম কিন্তু সিনেপ্লেক্সে জাতীয় মাল্টিপ্লেক্সে প্রচুর দর্শক।
প্রথাগত সিনেমা হলের এই দশা হওয়ার কারণ কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো। সিনেমাকে ভালোবেসে খুব কম মানুষ এখন সিনেমা হলে যায়। যে কারণে আমাদের সিনেমা ঈদ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কারণ ঈদে সময় কাটানোর জন্য হলেও মানুষ সিনেমাহলে যাবে, তাই প্রডিউসাররা ঈদে রিলিজ দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই ঈদে দেখেন, ১১টা সিনেমা রিলিজ হয়েছে। অনেকে সমালোচনা করছেন বিষয়টার! কিন্তু প্রডিউসার জানে, ঈদ ছাড়া দর্শক তেমন একটা সিনেমাহলে আসবে না। ঈদে হোক শিক্ষিত বা মুর্খ কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা ; সময় কাটানোর জন্য অবশ্যই সিনেমা হলে দর্শক আসবে। প্রডিউসাররা মূলত এই বিষয়টাকেই মাথায় রাখেন।
এখন মানুষ সিনেপ্লেক্সের হয়ে কথা বলে। তারা বলেন যে- সিনেমাহল এখন অচল – সময় এখন সিনেপ্লেক্সের। আমি এই কথাটার সঙ্গে পুরোপুরি একমত কখনোই না।
সিনেপ্লেক্স অবশ্যই ছবি দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো এবং উত্তম যায়গা তবে সিনেমা হলকে একদম নাই করে দেওয়া যাবে না। তার কারণ আমি বলছি- এখনো বাংলাদেশে ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ছবির দেখার দর্শক খু্ব কম। বিশেষ করে আমাদের দেশে স্টুডেন্ট, বেকার, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাটায় বেশী। তাদের বড় অংশই সিনেপ্লেক্স ছবি দেখতে অতটা আগাবে না, কারণ টিকিটের মূল!
আমি নিজেই সিনেমা হলে বেশী ছবি দেখি তার কারণ কিন্তু এটাই, টিকিট মূল্য। শুধু যে ছবিগুলো সিনেমা হলে আসার সম্ভাবনা কম থাকতো বা থাকে সেগুলো শুধু আমি সিনেপ্লেক্সে দেখি। তাই সাধারণ মানুষের কথা ভেবে হলেও সিনেমা হল থাকাটা জরুরি।
কিন্তু সমস্যা কী, সিনেমা হলগুলো সংস্কার হচ্ছে না কেন? সরকার সিনেমাহল সংস্কারের জন্য ঋণ দিচ্ছে কিন্তু সেটা নিতে আগ্রহ নেই হল মালিকদের। এর পিছনে কারণ হচ্ছে এই সরকারি ঋণ নিয়ে হল সংস্কার করলে বাধ্যতামূলক ই-টিকেটিং চালু করতে হবে। ই-টিকেটিং চালু হলে তো প্রযোজক-পরিবেশকের সাথে আবার টিকিট নিয়ে বাটপারি করতে পারবে না হল মালিক তাই মূলত হল মালিকরা অনাগ্রহী ঋণটা নিয়ে।
তবে আমার মনে হয়, প্রযোজক, পরিবেশক এবং হল মালিক সমিতিকে একত্র হয়ে বিষয়টাকে নিয়ে কাজ করতে হবে। হল মালিকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে পাশাপাশি তাদের চাওয়াটা বুঝে কাজ করতে হবে সমিতিগুলোর। আর হ্যাঁ, শুধু ঈদকেন্দ্রিক ছবি না বানিয়ে সারা বছরই যাতে ছবি চলে এমন স্থিতিশীল অবস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে সবকিছুর সমাধান আসবে। পরিশেষে বলতে চাই, সিনেমাহলের গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। সব শ্রেণীর মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে এবং পরিবার নিয়ে সুন্দর পরিবেশে বসে ছবি উপভোগ করতে পারে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে।