ঢালিউডের চোখে সেই টলিউড
আমরা এমন এক জাতি বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করে অন্যের গুণগান করি বেশি বা নিজের সমৃদ্ধ অতীত না জেনে অন্যদের নিয়ে অহেতুক বড়াই করি। ঠিক ঢালিউডি মুভি ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে দর্শকদের মানসিকতা বেশিরভাগই তেমন। আশার কথা সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে যখন আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অস্তিত্ব ও সফল ছবি নিয়ে টলিউডি তারকা, ইউটিউবাররা কথা বলতে শুরু করেছে। এখন দর্শক কিছুটা হলেও আমাদের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ অতীত নিয়ে জানতে আগ্রহী হয়েছে দেরিতে হলেও। তো আজকের এ লেখা তাদেরই জন্য।
বিখ্যাত ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় আশির দশকের ভারতীয় শিল্পীদের ঢালিউডে কাজের জোয়ার নিয়ে রিপোর্ট হয়েছিল। শিরোনাম ছিল-‘কিসের টানে ওরা এখানে আসেন?’ ব্যাখ্যাটা টানতে সেকাল-একাল সমীকরণে হাত দিতে হবে।
যৌথ প্রযোজনাও একসময় ঠিকমতো হত যেখানে ঢালিউডের অংশগ্রহণও দারুণভাবে ছিল। আশির দশক থেকে যৌথ প্রযোজনা ঢালিউডে দারুণভাবে শুরু হয়েছিল। ‘ব্যবধান, এপার ওপার, দূরদেশ’ এ ছবিগুলো সার্থক যৌথ ছবি। যৌথ-র বাইরেও আমাদের মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ছবিতে ভারতীয়/পাকিস্তানি শিল্পীরা কাজ করেছে যেখানে দাপট ছিল আমাদের পরিচালকদের। তখন ভারতীয় জয়শ্রী কবির, দেবশ্রী রায় তাদের পাশাপাশি পাকিস্তানি নাদিম, মোহাম্মদ আলী-রাও কাজ করতেন। এই সিনিয়রদের পাশাপাশি জুনিয়র সুনেত্রা, চাঙ্কি পাণ্ডে, ঋতুপর্ণা-রা তো ছিলই। তখন ঢালিউডে একটা কাজের মৌসুম ছিল। একের পর এক ছবি সুপারহিট হত। কলকাতাকেন্দ্রিক টলিউড ইন্ডাস্ট্রি উত্তম কুমার, সৌমিত্র চ্যাটার্জী-দের পরে প্রসেনজিৎ ছাড়া তখন পায়ের ওপর ভর করার মতো তারকা তখন তৈরি হয়নি। প্রসেনজিৎ-ও ঢালিউডের কপিরাইটের অনেক ছবি রিমেকে অভিনয় করে নিজের শিরদাঁড়া শক্ত করেছিল। এ পরিবেশে আমাদের রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ জসিম, শাবানা, অলিভিয়া, ববিতা, চম্পা, দিতি, সোহেল রানা, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেল, সালমান শাহ, বাপ্পারাজ এত এত তারকাদের ভিড়ে টলিউডে বিট দেবার মতো তারকা ছিলই না। ওদের অনেকেই তাই ঢালিউডে আসত সিনেমা করতে। মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়ালে তখন আমাদের জোয়ার ছিল সে সুযোগটা তারা ভালোই কাজে লাগিয়েছিল।
মূলত উত্তম কুমারের পর টলিউড ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের মোটাদাগে বলার মতো নাম দাঁড়িয়েছিল রঞ্জিত মল্লিক, ভিক্টর ব্যানার্জী, তাপস পাল, চিরঞ্জীত, প্রসেনজিত-দের। কিন্তু ঢালিউডের স্বর্ণযুগের কথা বললে খুবই কম এটা। আমাদের রাজ্জাক থেকে শুরু করে বুলবুল আহমেদ, জসিম, সোহেল রানা, ফারুক, উজ্জ্বল, আলমগীর, সালমান শাহ, ইলিয়াস কাঞ্চন, রুবেল, মান্না, বাপ্পারাজ, ওমর সানী, আমিন খান, রিয়াজ পর্যন্ত যে নামগুলো আসে তাতে টলিউডের থেকে উজ্জ্বল মনে হয়। এমনকি নব্বই দশকের শেষের বছরের আবিষ্কার শাকিব খানও বর্তমান টলিউডের কোনো কোনো নায়কদের থেকে বেটার কমার্শিয়াল হিরো।
টলিউডে আশির শেষ এবং নব্বই দশকে ইন্ডাস্ট্রিতে টাকার ক্রাইসিস চলে আসে। ১০/১২ লাখ টাকায় ছবি হতে থাকে। ছবির সেট দেখলে বোঝা যায়। একঘর থেকে আরেকঘর, কৃত্রিম নদী, পার্ক বানিয়ে রোমান্টিক গানের শুট করা হত। আমাদের ঢালিউড তখন কমার্শিয়াল ছবির রমরমা রাজত্বে পরিণত হয়েছে। নায়করাজ রাজ্জাকর সাথে কথা বলে তখন আমাদের পরিচালক স্বপন সাহা-কে টলিউডে হায়ার করে নেয়া হয় কিছু ছবি বানানোর জন্য। স্বপন সাহার পাশাপাশি নারায়ণ ঘোষ মিতা, দীলিপ বিশ্বাস (উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাসের বাবা), এ জে মিন্টু তাঁদের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদেরও নিয়ে যাওয়া হয় সেখানকার চলচ্চিত্রে একটা সুবাতাস আনার জন্য। তাঁদের চেষ্টায় সেটা সফলও হয়। দীলিপ বিশ্বাসের ‘আমাদের সংসার’ ছবির শুটিং-এর স্টিল পিক পাওয়া যায় যেখানে লাবণী সরকারকে দেখা যায়।
তখন তাদের প্রযোজক, পরিচালকরা ঢালিউডে আসত আমাদের ছবির কপিরাইট কিনে নিতে। কপিরাইটের জন্য এফডিসিতে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত। তাদের ওখানে মৌলিক গল্পের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সিনেমার বড়ই অভাব ছিল। তাদের ওখানে প্রথম জোয়ারটা আসল আমাদের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’-র রিমেক দিয়ে। এ ছবিটা আমাদের মতো সেখানেই রেকর্ড ব্রেকিং বিজনেস করল এবং ইন্ডাস্ট্রির মোড় ঘুরে গেল। তারপর একে একে আমাদের ‘বাবা কেন চাকর’ থেকে ‘বাবা কেন চাকর’, ‘সন্তান যখন শত্রু’ থেকে ‘সৎভাই’, ‘দাঙ্গা’ থেকে ‘দাঙ্গা’, ‘স্নেহের প্রতিদান’ থেকে ‘স্নেহের প্রতিদান’, ‘প্রেমের সমাধি’ থেকে ‘বকুল প্রিয়া’, ‘মায়ের অধিকার’ থেকে ‘মায়ের অধিকার’, ‘ঝিনুক মালা’ থেকে ‘ঝিনুক মালা, ‘নয়নের আলো’ থেকে ‘নয়নের আলো’, ‘এই ঘর এই সংসার’ থেকে ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘সুজন সখি’ থেকে ‘সুজন সখি’, ‘মা যখন বিচারক’ থেকে ‘অন্যায় অত্যাচার’, ‘জজ ব্যারিস্টার’ থেকে ‘সবার উপরে মা’, ‘নিষ্পাপ’ থেকে ‘সাথী তুমি কার’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ থেকে ‘তোমাকে চাই’, ‘মায়ের দোয়া’ থেকে ‘মায়ের আশীর্বাদ’, ‘চাকরানী’ থেকে ‘আদরের বোন’, ‘অজান্তে’ থেকে ‘আমার মা’, ‘মনপুরা’ থেকে ‘অচিন পাখি’, ‘খায়রুন সুন্দরী’ থেকে ‘প্রাণের স্বামী’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ থেকে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘নসিমন’ থেকে ‘বৌমার বনবাস’। এভাবে প্রায় ১০০+ ছবি তারা রিমেক করেছিল যেগুলো তাদের মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ছবির বাজার ঠিক করে দিয়েছিল। গান থেকেও গানও হুবহু কপি করেছিল যেমন- বাপ্পারাজের ‘তুমি বন্ধু আমার চিরসুখে থেকো’ গানটা ‘বকুল প্রিয়া’তে ব্যবহার হয়েছিল প্রসেনজিতের লিপে। ‘ঝিনুক মালা’-র ফারুকের লিপে ‘তুমি আমার মনের মাঝি, চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি’ ব্যবহার হয়েছিল প্রসেনজিতের ‘ঝিনুক মালা’-তে। ‘মায়ের অধিকার’ ছবির ‘পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন, মেয়ে তো নয়রে পাগলী’ গানগুলো ব্যবহার হয়েছে বিপ্লব প্রসাদ, প্রসেনজিতের লিপে। আমাদের ‘আশার আলো’ ছবির সুবীর নন্দী-র কালজয়ী গান ‘তুমি যে আমার চির আশার আলো’ ব্যবহার হয়েছিল ওদের ‘আমাদের সংসার’ ছবিতে যার লিপে ছিল ফেরদৌস, বিপরীতে শ্রীলেখা। ‘বাবা কেন চাকর, সন্তান যখন শত্রু, প্রেমের সমাধি’ ছবির সবগুলো গান তাদের ছবিতেও ব্যবহার হয়েছে। মান্নার ‘গুন্ডা নাম্বার ওয়ান’ ছবির ‘যারা প্রতিদিন ক্ষমতার জোরে’ গানের কপি করেও ‘অন্যায় অত্যাচার’ ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
মূলত প্রসেনজিত ছিল তখনকার সময়ে আমাদের ছবির রিমেকের প্রধান নায়ক। ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে তাকে একসময় গণহারে ছবি করতে হয়েছে। বর্তমান প্রসেজিতের অবস্থান কি সেটা আমরা জানি এবং সম্মান জানাই কিন্তু নব্বই দশকীয় প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান আমাদের ইন্ডাস্ট্রির নায়কদের তুলনায় অনেক পেছনে ছিল। সালমান শাহ-র ‘মায়ের অধিকার’ ছবির অভিনয় দেখার পর প্রসেনজিতেরটা দেখলেই বোঝা যাবে তার অভিনয়ের দিকটাও তখন নাজুক ছিল। সালমান শাহ তো দূরের কথা শুধু বাপ্পারাজকেই যদি ধরি ‘প্রেমের সমাধি’ ছবির অভিনয়ের কথা। নিজ দায়িত্বে ইউটিউব থেকে ‘প্রেমের সমাধি ভেঙে’ এবং ‘তুমি বন্ধু আমার চিরসুখে থেকো’ গান দুটি দেখে আসুন বাপ্পারাজের অভিনয়ের গভীরতায় প্রসেনজিতকে তেমন কিছু মনে হবে না। আমাদের ছবি ‘প্রিয়শত্রু’-তে প্রসেনজিৎ দিতির নায়ক ছিল আর ভিলেন ছিল সোহেল চৌধুরী। এ ছবিতে সোহেল চৌধুরীর স্ক্রিনটাইম প্রসেনজিতের থেকে বেশি ছিল এবং অভিনয়েও সোহেল এগিয়ে ছিল। ইভেন তাদের ছবির যে সেট ছিল তখন সেটাও আমাদের সাথে তুলনার মধ্যে আসতে পারেনি। ‘প্রেমের সমাধি’ আর ‘বকুল প্রিয়া’ ছবির স্টার্টিং সিকোয়েন্সটাই যদি শুধু দেখেন তাহলেও প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের রমরমা অবস্থার সময় প্রসেনজিত যখন রিমেক ছবিতে কাজ করেছিলো বলিউডের তখন মিঠুন চক্রবর্তী, শক্তি কাপুররা, নাসিরউদ্দিন শাহরাও আমাদের ছবিতে কাজ করে যাচ্ছিল। শক্তি কাপুর নব্বইয়ে ‘জামিন নাই’ এবং ২০০০ পরবর্তী সময়ে ‘এরই নাম দোস্তী’ ছবিতে কাজ করেছিল। নাসিরউদ্দিন শাহ ‘ফুল আর পাথর’ ছবিতে কাজ করেছিল। মিঠুন তো পরে দায়িত্ব নিয়ে টলিউডের কমার্শিয়াল ছবির নতুন বিপ্লব আনে এবং সেখানেও ‘ফাটাকেস্ট’-র মতো বড়মাপের ছবির ধারাও আমাদের পরিচালক সেই স্বপন সাহা দিয়েই শুরু হয়েছিল যেটি মিঠুনের ল্যান্ডমার্ক কাজ ছিল।
দ্বিতীয়ত ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের কথা আসে। শাবানার সহযোগিতায় ‘স্বামী কেন আসামী, মেয়েরাও মানুষ’ ছবি দুটি করে আলোচনায় আসে। তারপর এখানকার নিয়মিত কাজ পেতে লাগল। যেমন – রাঙা বৌ, তোমার আমার প্রেম, সাগরিকা। পরে মান্নার সাথে ‘স্বামী ছিনতাই’- এর মতো হিট ছবির নায়িকাও ছিল। মান্না নিজের পারিশ্রমিক না নিয়ে ঋতুপর্ণাকে পারিশ্রমিক পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এমন উদাহরণও আছে। এর পাশাপাশি রচনা ব্যানার্জী মান্নার বিপরীতে পরবর্তীতে ‘সত্যের বিজয়’, শাকিব খানের বিপরীতে ‘ওরা দালাল’ ছবিতে কাজ করেছিল এমনকি ‘খায়রুন সুন্দরী’-র মতো ইন্ডাস্ট্রি হিট ছবির রিমেক ‘প্রাণের স্বামী’-তে টলিউডে কাজ করেছিল যেটি তার ক্যারিয়ারেরও অন্যতম ওয়ার্ড অফ মাউথ ছবিতে পরিণত হয়েছিল।
টলিউডে জিতের ‘সাথী’ ছবির ব্যাপক সাফল্যের পর সেখানে নতুন পরিবর্তন আসে। ২০১০ পরবর্তী সময়ে টলিউড বলিউডি সাপোর্ট পেয়ে আপগ্রেড হতে থাকে এবং কয়েক বছর দারুণ সময় পার করে যার শুরুটা হয়েছিল ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ দিয়ে এবং ধারাবাহিকভাবে ‘প্রেম আমার, অমানুষ, বোঝে না সে বোঝে না, পাগলু’ এ ধরনের কিছু ছবি দিয়ে। এটুকু ছাড়া আগের টলিউড উত্তম কুমার ব্যতীত মোটাদাগে নিষ্প্রভই বলা যায়। বিপরীতে ঢালিউড মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে নব্বই দশক ও অশ্লীল সময়ের আগ পর্যন্ত এমনকি অশ্লীলের সময়ও নির্মিত মানসম্মত কিছু ছবির সময়টাতেও দীর্ঘ সময় বেটার পজিশনে ছিল। বর্তমান প্রজন্মের উচিত নিজের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস জানা এবং প্রয়োজন মোতাবেক বর্তমান সময়ের মতো প্রতিবাদী ভূমিকা রাখা।
হ্যাপি ঢালিউড।