Select Page

বাংলাদেশের সিনেমা এক কল্পরাজ্যের গল্পই বলে গেছে

বাংলাদেশের সিনেমা এক কল্পরাজ্যের গল্পই বলে গেছে

আমাদের সিনেমা, বাংলাদেশের সিনেমা চিরকাল এক কল্পরাজ্যের গল্পই বলে গেছে। খুব দুর্বল হলেও বাস্তবতা থেকে মানুষের আর কোথাও হারাবার জায়গা ছিলো না বলে সিনেমাই আশ্রয় হয়ে ওঠে।

সাত টাকা বা বড়জোর পনের টাকায় সিনেমাহলের আড়াইটি ঘণ্টা ছিলো জীবনের রূঢ়তা থেকে বের হয়ে নতুন এক পৃথিবীতে ভ্রমণের মতোই আনন্দের। আমি কেবল আমার সময়ের কথাই বলতে পারি।

১৯৯০ থেকে ২০২০ একত্রিশ বছরের বাংলাদেশের সিনেমায় বাণিজ্যিক ধারাই বলুন, আর আর্ট ফিল্মই বলুন কোন সিনেমাই প্রকৃত জীবনকে ধারণ করেনি। এইসব সিনেমা আমাদের নিয়ে গেছে বাস্তব ও কল্পনা মিশ্রিত এক ভুবনে।

নব্বই দশকের সিনেমাগুলোর কথাই যদি ধরি। দেখবেন তথাকথিত বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর গল্প সব একই প্রায়। ওই সময়টাতে সিনিয়র নায়ক-নায়িকা ও জুনিয়র নায়ক-নায়িকার (নায়ক-নায়িকাই, ঠিক অভিনেতা নয়) মেলবন্ধনের একটা বিষয় ছিলো।

ধরুন প্রথমে আলমগীর-শাবানা বা ফারুক-ববিতা কিংবা রাজ্জাক-কবরী, সোহেল রানা-সুচরিতা বা জসিম-রোজিনা একটা সংঘাতের ভেতর দিয়ে মিলিত হন বটে, কিন্তু সেই সংঘাত রয়ে যায়, যা ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, মান্না-চম্পা, ওমর সানী-মৌসুমী, সালমান শাহ-শাবনুর বা অমিত হাসান-শাহনাজ এই সংঘাতের ভেতর প্রেম আবিষ্কার করে এবং শেষে মারপিটের মাধ্যমে সংঘাতের শেষ এবং সুখে বসবাসের ইঙ্গিত দিয়ে সিনেমা শেষ হয়।

এই সংঘাত অর্থনৈতিক ও সামাজিক। এবং এইসব সিনেমার প্রায়গুলোতে দিলদারের উপস্থিতি ছিলো একই রকম। প্রায় সব সিনেমাতেই একই পারিবারিক গল্প। শুধু উনিশ-বিশ।

তবে আমাদের সিনেমা মূলত ভারতীয় (হিন্দি ও দক্ষিণ ভারতীয়) সিনেমার কঙ্কালের উপরই বসানো মাংসের প্রলেপ। সিনেমার শেষ দৃশ্যে আমরা দেখি গোডাউনে সার করে রাখা মালামালের বাকশো, ড্রাম। এবং মারামারি শুরু হওয়ার আগে ভিলেনরা নায়িকাদের তুলে নিয়ে এসে নাচাতেন। এটা মেবি ভারতীয়দেরই অনুকরণ। আবার আমাদের সমাজে মজুতদাররা আদতে ভিলেন এমন একটা ধারণাও পাওয়া যায়। এ কথা অবশ্য এটিএম শামসুজ্জামানের ক্ষেত্রে অনেক সময় খাটে না। কারণ সাধারণত গ্রামের মোড়ল, দুষ্টু লোক হিসেবেই তাকে দেখেছি।

এ কথাও ঠিক নব্বইয়ের সিনেমা মূলত গ্রামকে শহরের দিকেই ঠেলে আনে। এর আগে আশির দশকে আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান প্রমুখ বিভিন্ন সিনেমায় গ্রামের সমাজকে তুলে ধরলেও, নব্বইয়ের দিকে গ্রাম ঠিক আগের মতো জায়গা পায় না। কোন কোন সিনেমা গ্রামে শুরু হলেও তাতে ঠিকই শহর ঢুকে যায়। যেমন: অনুতপ্ত, বিচার হবে ইত্যাদি। এর মাঝে ব্যতিক্রম বলতে গেলে শহীদুল ইসলাম খোকন, কাজী হায়াৎ। গল্পের প্যাটার্ন একই থাকলেও শহীদুল ইসলাম খোকন যুক্ত করেছিলেন থ্রিল, কুংফু অ্যাকশান। আর কাজী হায়াৎ সিনেমায় তুলে এনেছিলেন সমাজের ক্ষতমাখা গল্প।

আপনারা যদি শহীদুল ইসলাম খোকনের উত্থান-পতন, অপহরণ, কমান্ডার, সতর্ক শয়তান প্রভৃতি সিনেমা দেখেন, দেখবেন সেখানে নতুন কিছু চরিত্র তৈরি হয়েছে। আর এটাও অবশ্য সম্ভব হয়েছে হুমায়ুন ফরীদির জন্যই, কুংফু অনুসঙ্গ ছিলো রুবেল। অপরদিকে কাজী হায়াতের সিনেমা যেমন দাঙ্গা, ত্রাস বা চাঁদাবাজ সিনেমাগুলো সামাজিক অসঙ্গতি প্রকটভাবে তুলে নিয়ে আসে। সেখানে মান্না ও রাজীব আর এক আধিপাত্য তৈরি করে দর্শক মনে।

নব্বইয়ের সূচনায় বাংলাদেশের কথিত বাণিজ্যিক সিনেমা উদ্ভট রাজা-বাদশার গল্প ও চিত্রায়ন থেকে মুক্তি পেলেও দেলোয়ার জাহান ঝন্টু সাপের রাজত্বে নিয়ে যান।

শাবনাজ-নাঈমকে নিয়ে কয়েকজন পরিচালক মিষ্টি প্রেমের গল্পের নির্মাণ সূচনা করেন নব্বইয়ের শুরুতেই। চাঁদনী, লাভ, দিল, চোখে চোখে, অনুতপ্ত, সোনিয়া প্রভৃতি সিনেমা কলেজ স্টুডেন্টদের জীবনকে মোহিত করে। ওই সময়ে শাবানা যেমন ঘরের বউয়ের আদর্শ উদাহরণ, তেমনই শাবনাজ হয়ে ওঠেন প্রেমিকার অবয়ব। এ কথা অবশ্য ১৯৯১-১৯৯৩ পর্যন্ত স্বল্প পরিসরে খাটে। কেয়ামত থেকে কেয়ামতে সালমান শাহ মৌসুমীর আবির্ভাব ও তাদের জনপ্রিয়তা শাবনাজ-নাঈম জুটিকে ছাড়িয়ে যায়।

কলেজ পড়ুয়া তরুণদের কল্পনার প্রেমিকারা হয়ে ওঠে মৌসুমীর মতো। পরবর্তীতে শাবনুর সেখানে যুক্ত হলেও, ওমর সানীর মতো বলে রাখতে চাই ধনীর দুলালি হিসেবে মৌসুমী এগিয়ে যায় এবং মধ্যবিত্ত ও গরীব ঘরের মেয়ে হিসেবে শাবনুর সিনেমার সেলুলয়েড ফিতায় আটেক যায়।


মন্তব্য করুন