Select Page

নাসিমা খানের আত্মকথন: তারকালোকের দিনগুলো

নাসিমা খানের আত্মকথন: তারকালোকের দিনগুলো

[ঢাকাই সিনেমার প্রথম দিকের অভিনেত্রী নাসিমা খান। ছোট একটি চরিত্রে এ জে কারদারের বিখ্যাত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রের আগমন। পরবর্তীতে নায়িকা হিসেবে ঢাকা-লাহোরে সমান তালে অভিনয় করেন। একাত্তর-পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছা চলচ্চিত্র ছেড়ে যান। এরপর প্রায় এক দশক পর টিভিতে ফেরেন উপস্থাপনা নিয়ে। আবার বিরতি। নাসিমা খানের সাক্ষাৎকারটি ১৯৯০ সালে ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যায় প্রকাশ হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি চলচ্চিত্রে আর না ফেরার কথা জানান। এমনকি নিজের তৎকালীন কোনো স্থিরচিত্র প্রকাশে অনাগ্রহী ছিলেন। তবে ওই দশকের মাঝামাঝিতে তিনি চলচ্চিত্রে ফেরেন। বিচিত্রায় প্রকাশিত আত্মকথন অনুলিখনের ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক মাহমুদা চৌধুরী। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অজানা অনেক গল্প আছে এ লেখায়। সেই গল্প থাকল বিএমডিবি পাঠকের জন্য। আর দু-একটা শব্দ ছাড়া পুরো লেখা অবিকৃত থাকল।]

আমি যেদিন জন্মেছিলাম, বাড়িতে খুশীর ঘুম পড়ে গিয়েছিল। আমার ছিল ছয় ফুপু। বাড়িতে আরও একটা মেয়ে জন্মেছে বলে তারা দুঃখ না করে বরং বলে বেড়াতেন ‘জানিস, আমাদের বাড়িতে একটা পরীর বাচ্চা জন্মেছে।’ জানি না কথাটা সত্যি না মিথ্যে, সবই শোনা কথা। তবে একটু বলতে পারি, বাড়িতে সকলেরই আমি ছিলাম অতি আদরের। বিরাট যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। কত যে আত্মীয়-স্বজন, কত যে আশ্রিত ছিল আমাদের বাড়িতে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে ডিসি পর্যন্ত হয়েছেন। সময়ের স্রোতে আজ তারা কোথায় ছিটকে পড়েছেন, কে তার খবর রাখে।

আমার দাদার নাম খান বাহাদুর আব্দুল জলিল খান। তাঁর বাবা উকীল ছিলেন। বিক্রমপুর থেকে দাদা লালবাগে এসে স্থায়ী বাস গড়ে তোলেন। দাদার পুত্রসংখ্যা তিন। বড় চাচা বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারী পড়তে। সেখানে প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তার আলাপ। লেখাপড়া ছেড়ে, বড়ুয়ার ছবি এসিস্ট করতে কলকাতা চলে আসেন তিনি। প্রথম সন্তানের এহেন দুর্মতিতে দাদা পাগলের মত ছুটে যান কলকাতায়। ছেলেকে ধরে এনে ফেরত পাঠান বিলেতে। আমার বাবা পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে ব্যবসা করতে নামেন। কাঠের ব্যবসা ছিল তার।

তবে ছোট চাচা দাদার আকাঙ্খা পূরণ করেন। তিনি ডিপুটি মেজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতবান। সেইদিনে আমার ফুপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। আমি নাচ শিখেছি ওস্তাদের কাছে। কামরুননেসা স্কুলে পড়তাম। লালবাগ থেকে স্কুল বাসে করে যেতাম। খুব মিশুকে ছিলাম না বলে স্কুল জীবনে কোন মেয়ের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন খান আতাউর রহমান। তাদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।

মাত্র বার বছর বয়সে আমি ‘জাগো হয়া সাভেরা’ (১৯৫৮) ছবিতে ছোট্ট একটি দৃশ্যে অভিনয় করি। আমার চরিত্রটি কী ছিল— সেসব বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে, শুধু আবছা আবছা এটুকু মনে পড়ে, তৃপ্তি মিত্র, শ্যামলা মতন দেখতে। মুখটা কাটা কাটা ছাঁচের। ভারী সুন্দর করে কথা বলতেন তিনি। এই ছবির অফার কে নিয়ে এসেছিল আজ তা পরিষ্কার মনে পড়ছে না। তবে আশরাফ না কি যেন নাম ছিল তার, লাহোরী ছবিতে নৃত্য পরিচালক ছিলেন, সম্ভবত তিনিই আমার ছবিতে নামার যোগসূত্র।

সেযুগে লালবাগের ডিপুটি বাড়ির মেয়েরা যত মডার্নই হোন, যতই স্কুল কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করুন না কেন— সিনেমায় নামার চিন্তা কারও মাথায় ঘৃণাক্ষরেও আসেনি। সিনেমা দেখতো সবাই। কিন্তু তা বলে বাড়ির মেয়ে সিনেমায় নামবে? তাও খান বাহাদুরের নাতনী হয়ে? বিনা মেঘে বজ্রপাত হওয়ার অবস্থা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু বড় চাচা, যেহেতু সিনেমা সম্পর্কে তার প্রাকটিক্যাল ধারণা ছিল, তিনি বাবাকে হুকুম দিলেন, ‘না বাবলী অভিনয় করবে।’ তবে, এর সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেয়া হল ‘লেখাপড়ায় গাফিলতি চলবে না।’

আমি তাতেই রাজি। এতদিন পর্দায় মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছি সুচিত্রা উত্তম, মধুবালা, দিলীপ, নার্গিস, রাজকাপুরকে। এবার আমাকে দেখবে লক্ষ জন। স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতাম এ নিয়ে।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ‘আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়ে যায়। এরপর বেবী কাকু আসেন তার ‘তানহা’ ছবির ছোট্ট একটা রোলে অভিনয় করে দেয়ার জন্যে। ছবির নায়িকা শামীম আরা, নায়ক হারুণ। হারুণ ছিলেন বিরাট ধনী সন্তান। বেবী আইসক্রিম নামে এদেশে ওদের ছিল একচেটিয়া আইসক্রিম ব্যবসা। ছোট রোলে সেদিন সুমিতাদি, শবনম (সেদিন যাকে সবাই ঝর্ণা নামেই চিনতো) ও আমি অভিনয় করি।

একটা দুটো দৃশ্যে আমাকে সংলাপ বলতে হয়েছিল হয়ত আজ আর তার কিছুই মনে নেই। সে সময় এখানে ছবি হত হাতে গোনা। ‘রূপবান’-এর পরিচালক সালাউদ্দীন চাচার প্রথম ছবি ‘যে নদী মরু পথে’ (১৯৬১)। সেই ছবির নায়ক কে ছিলেন মনে নেই। নায়িকা ছিলেন রওশন আরা। মিটফোর্ড হাসপাতালে এলএমএফ ডাক্তারী পড়তেন তিনি। উত্তর বঙ্গের মেয়ে। তার ছোট বোনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য আমার ডাক পড়ল। কি করেছিলাম, কি বলেছিলাম আজ আর কিছুই মনে পড়ে না।

যখন সেভেনে পড়ি তখন ‘সূর্যস্নানের’ (১৯৬২) দ্বিতীয় নায়িকার ভূমিকার জন্য সালাউদ্দীন চাচা আমাকে নির্বাচন করলেন। এ ছবির নায়ক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। মিলের শ্রমিক। আমি তার বৌ। জীবনের প্রথম রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে আমার দুরবস্থার সীমা রইল না। আমার প্রথম দিনের কাজটা ছিল, রাতের বেলার দাম্পত্য জীবনের অন্তরঙ্গ দৃশ্যর। অন্তরঙ্গ হলেও, এখনকার মত জড়াজড়ির দৃশ্য নয়। স্বামী কাজ থেকে ঘরে ফিরে এসেছে। আমাকে আদর করে বুকে টেনে নিল। আমি আবেশে প্রেমাকাঙ্খায় স্বামীর বুকে মাথা রাখলাম। কিন্তু প্রেমের আবেশ আমার চেহারায় কিছুতেই ফোটাতে পারছিলাম না। যার বার এনজি হচ্ছিল। ক্রমে ইউনিটের সবাই বিরক্ত হয়ে উঠল আমার ওপর। নায়ক আনোয়ার হোসেন অধৈর্য হয়ে এক পর্যায়ে বলে ফেললেন, ‘সালাউদ্দীন ভাই, আপনার নায়িকা বদল করুন। স্কুলে পড়া মেয়ে দিয়ে এসব হবে টবে না।’ লজ্জায় আমি আরও বরফের মত হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ধৈর্য বটে সালাউদ্দীন চাচার। তিনি আমাকে আমার অভিব্যক্তির প্রত্যেকটা ডিটেলস বলে দিতে লাগলেন। ‘হ্যাঁ, বুকে মাথা রাখ, মুখ তোল, একটু হাস, চোখ বন্ধ কর। হ্যাঁ, এই তো-এই তো, বাবলী পারছে। কিরে বাবলী পারবি না?’ দুঃখে রুদ্ধ কণ্ঠ আমার। কোন মতে উত্তর দেই ‘পারব।’ বার/চৌদ্দবার টেক নেয়ার পর কোনমতে দৃশ্যটি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। পরে তো ‘সূর্যস্নান’ প্রশংসাধন্য হয়। এই ছবিতে পিতৃপ্রতীম কাজী খালেক ছিলেন ভিলেন। তার কন্যা রওশন আরা। একমাত্র আদুরে মেয়ে কলেজে পড়তেন। কন্যার চাইতে কনিষ্ঠা একজন শ্রমিক বধূকে কাজী খালেক ধর্ষণ করেন এই ছবিতে। কৌমার্য হানি হওয়ার মনোবেদনায় বধূটি আত্মহত্যা করে। আনোয়ার হোসেন জেল থেকে বেরিয়ে, এই সংবাদ শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি রওশন আরাকে অপহরণ করেন। পলাতক জীবনে রওশন আরা আনোয়ার হোসেনকে ঘৃণা করতে করতে এক সময় ভালবেসে ফেলেন। সাধারণত সব ছবিতেই ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ এই নীতি অনুসৃত হয়। ‘সূর্যস্নান’ এই টেন্ডের বাইরের ছবি। রওশন আরার মিল মালিক বাবা ও পুলিশের সাহায্যে কন্যাকে উদ্ধার করে আর পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আনোয়ার হোসেন। কি যে চমৎকার এই কাহিনী ছিল— কী বলব। ছবিটি ভাল ব্যবসা করেছিল। এখন, এ ধরনের গল্প নিয়ে ছবি বানায় কেউ। এর জন্য মেধা সাহস ও ক্ষমতা চাই।

এ ছবির সাফল্যে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ভাল অভিনয় কীভাবে শেখা যায়, জানার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠি। আমাদের সময় অভিনয় শেখার জন্য কোন স্কুল বা ইনস্টিটিউট ছিল না। তাই একে ওকে ধরে অভিনয়ের কলা-কৌশলগুলো জানার চেষ্টা করতাম। প্রচুর বই পড়তাম, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা। কণ্ঠাভিনয়ের উন্নতির জন্য খান আতাউর রহমান আমাকে চমৎকার একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘বাবলী, সুন্দর বাচনভঙ্গী এবং শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য জোরে জোরে কবিতা আবৃত্তি করবি। গল্প শব্দ করে পড়বি।’ তার এই উপদেশ অনুসরণ করেই অভিনয়ের মান উন্নতি করতে পেরেছিলাম আমি।

আমাদের শিক্ষক আসলে ওঁরাই ছিলেন। চলতে ফিরতে ওঁদের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চয় করে আমাদের ভান্ডার পূর্ণ করার চেষ্টা। এই জন্য ওঁরা যদি বলতেন ‘এইখানে বসে থাকবি।’ আদেশ মনে করে আমরা তাই করতাম।

মুশকিল হল, অভিনয়ের পাশাপাশি আমাকে লেখাপড়াটাও চালাতে হত। বাড়ি থেকে কড়া হুকুম— লেখাপড়ায় গাফিলতি করলে অভিনয় বন্ধ। অভিনয় আমাকে তখন নেশার মতো পেয়ে বসেছে। সালাউদ্দিন চাচার পরের ছবি ‘ধারাপাত’। সৈয়দ শামসুল হকের গল্প অবলম্বনে এই ছবির চিত্রনাট্য রচনা হয়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন কাজী খালেক। আমি আর সুজাতা প্রধান দুটি নারী চরিত্রে অভিনয় করি। তবে, কলকাতার ‘হেডমাস্টার’ ধাঁচের এই গল্পটি দর্শকরা ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।

বাংলাদেশের প্রথম হাসির ছবি ‘কার বৌ’। ১৯৬৬ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। আমি একা নায়িকা। নায়ক হাফ ডজন। হারুণ, গোলাম মোস্তফা, সুভাষ দত্ত। এরা সবাই আমার স্বামী। একেবারে দ্রৌপদী। তবে আসল স্বামী ছিলেন হারুণ। তার সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের দিন এক দুর্ঘটনায় আমি ‘সিজোফ্রেনিয়াক’ হয়ে যাই। যাকে পাই তাকে মনে করি এই আমার স্বামী। এই ছবিতে অভিনয় করার সময় দারুণ মজাদার একটা ঘটনা ঘটে। অবশ্য সেই ঘটনাটিকে আজ মজাদার বললেও, সেদিন কিন্তু মনে হয়েছিল ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।’ এখনকার মত, সেই আমলে ডামির ব্যবহার প্রায়ই ছিলই না। ঘোড়ায় আমাদের নিজেদেরই চড়তে হত। ভেসপা, হুন্ডা, সাইকেল, মোটর গাড়ি আমাদের নিজেদেরই চালাতে হত। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে হত আমাদেরই। এই রকম সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য ছিল ‘কার বৌ’-এ। পরিচালক নজরুল ইসলাম, আমাকে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিলেন, এরপর তিনি ক্যামেরা পার্সন আফজাল চৌধুরীর সঙ্গে কী কী সব পরামর্শ করলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘ওকে, ক্যামেরা রেডী।’ অ্যাকশন শুরু হল। বিয়ের পর নতুন বৌ আমি সোফায় বসে আছি। স্বামী হারুণ গেছেন গাড়ি নিয়ে একজন অতিথিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। হঠাৎ খবর এল হারুণ কার এক্সিডেন্ট করেছেন। আমার কাজ হল কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি ‘না’ বলে এক চিৎকার দিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাব। দৃশ্যটি দুটি শটে ভাগ করা। নজুভাইয়ের নির্দেশমত দৌড় লাগালাম সিঁড়ির দিকে। এরই মধ্যে নজু ভাই হঠাৎ করে এমন এক ধাক্কা মারলেন, আমাকে যে, তাল-গোল পাকিয়ে গড়াতে গড়াতে আমি একেবারে নীচে। সংবিত ফিরতেই শুনি, ক্যামেরাম্যান আফজাল ভাই হাততালি দিয়ে বলছেন, ‘ওয়েল ডান ওয়েল ডান বাবলী।’

গাত্রদাহের চেয়ে মনদাহ তখন আমার প্রবল। চোখের পানি মুছতে মুছতে আমি বলে চলি, ‘আগে বলুন কে আমাকে ধাক্কা মেরেছে। তাকেও আমি ধাক্কা মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়ে বুঝিয়ে দেব সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ার কষ্টটা কি?’ এরপর তিনদিন পর্যন্ত নড়তে চড়তে পারিনি।

এই নজুভাই কানে শুনতেন কম। চিৎকার করে তার সঙ্গে কথা বলতে হত। মস্করা করে বলতাম, বাসর ঘরের বৌয়ের কথা শুনবেন কী ভাবে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেই তিনি আমার চুল টেনে দিতেন। জানি না, এরকম ঘরোয়া পরিবেশ বর্তমান প্রজন্মের পরিচালক, শিল্পী-কুশলীদের মধ্যে আছে কী না। আমি যখন নায়িকা ছিলাম, সে সময় আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের চাইতেও বড় ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, প্রত্যেকেই কালচারালী ডেভলপড ছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রতি তাদের টান ছিল অন্য রকম। তাদের সকলের মধ্যেই কমবেশী স্বদেশ প্রেম ছিল। বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করলেও সুরুচিকে প্রাধান্য দিতেন। এবং লক্ষণীয় যে, সে সময়, মেধাসম্পন্ন, শিক্ষিত পরিচালক, শিল্পী, কলা-কুশলীদেরই প্রাধান্য ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে। ছিলেন দেশ ও চলচ্চিত্রে নিবেদিতপ্রাণ জহির রায়হার। যদিও মাত্র একটা ছবিতে, তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল, তবু, তার কর্মপদ্ধতি, নিষ্ঠা, একাগ্রতার মধ্যে আমি বড় মাপের একজন শিল্পীকে খুঁজে পেয়েছিলাম।

১৯৬৮ সাল। গণঅভ্যুত্থানের ঠিক আগের বছর। পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে রোষের আগুন ধূমায়িত হচ্ছে। ক্রমশ তা চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষকেও স্পর্শ করে।। সেই বছর ঈদে দেখা গেল, শুধু উর্দু ছবি মুক্তি পাচ্ছে। স্টার কর্পোরেশনের অন্যতম মালিক ইফতেখারুল আলম, জহির রায়হানকে ডেকে সে কথা জানালেন। বললেন, ঈদের আর মাত্র কুড়ি দিন বাকি। এরমধ্যে ছবি বানান সম্ভব? অসাধ্য সাধনকারী জহিরভাই সেদিন জবাব দিয়েছিলেন ‘সম্ভব’। বাস্তবিকই, জহির রায়হান বলেই চৌদ্দ দিনে সম্ভব হয়েছিল ‘দুইভাই’ বানান। সিনে ওয়ার্কশপ নামে জহির রায়হানের যে প্রতিষ্ঠান ছিল, তাতে তাঁর প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করতেন চার-পাঁচজন পরিচালক। আমজাদ হোসেন, নূরুল হক বাচ্চু, বাবুল চৌধুরী ও রহিম নেওয়াজ। জহির ভাই ঘরে ফিরেই, দুই সাগরেদকে দিলেন স্টোরী বিল্ড করতে, আর দুজনকে পাঠালেন লোকেশন ঠিক করতে। রাতারাতি গল্প বানান, চিত্রনাট্য লেখা, সেট লোকেশন, অভিনয়, সম্পাদনা, সব মিলিয়ে দানবীয় কাজ চলতে লাগল।

এই ছবিতে কাজ করতে এসে আমি প্রথম দেখলাম জোন ওয়াইজ কাজ কাকে বলে। জহির রায়হানের মধ্যে কী প্রখর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল এটুকু থেকেই অনুমান করা যায় কিন্তু। এই জোন ওয়াইজ কাজের জন্য প্রচুর পেপারওয়ার্ক করতে হয়। ধরুন, ১, ৩, ৫, ১৫, ৩২ নং সিকোয়েন্সে আমার শট আছে। একই সেটে একটা ক্যামেরা কোণ নির্বাচন করে, তিনি শট নম্বর বের ধরে একনাগাড়ে আমার শটগুলো টেক করে নিলেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের জন্য তোলা এই শটগুলোর জন্য আমার শুধু কাপড় বদল হয়েছিল। ওই সময়ে আরও একটা সুবিধা ছিল যে হেয়ার স্টাইলের তেমন কোন বাহার ছিল না।

শ্যুটিং সেই চৌদ্দদিন, আমরা কেউই কিন্তু ঘুমাইনি। দিনের বেলা কুমিল্লায় লোকেশন শ্যুটিং হত, রাতের বেলা স্টুডিওতে। খাওয়ারই কারো নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিল না, আবার ঘুম। ঘুম যাতে না আসে, সেজন্য আমাদের এন্টি ক্লিপিং পিল পর্যন্ত খাওয়ানো হয়েছিল। আমি খুব দুধ খেতাম। বাড়ি থেকে নিয়ে যেতাম। পরে জাকারিয়া হাবীবের মুখে শুনেছি যে তিনিই আমার দুধের সঙ্গে এন্টি ক্লিপিং পিল মিশিয়ে দিয়েছিলেন।

চৌদ্দদিন পর বাড়ি ফিরে সোজা বিছানায়। নাওয়া-খাওয়া আর ঘুমের অভাবে বাস্তবিকই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুম নেই পাঁচদিন পর্যন্ত। বাড়ির সবাই এর জন্য আতঙ্কিত। চোখ বন্ধ করলেই সামনে ভেসে ওঠে ক্যামেরার নেগেটিভপুল একদিকে ঢুকছে আরেক দিক দিয়ে বের হচ্ছে। কার্যত শ্যুটিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ছবির পরিস্ফুটন হয়েছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদনা, রাশ না দেখেই। অসুবিধা কিংবা পরিশ্রম যতই থাক না, একজন ডেডিকেটেড ও শক্তিধর প্রতিভার সঙ্গে কাজ করতে যে আনন্দ তার কোন তুলনা হয় না। আপসোস, তার পরবর্তী কোন ছবিতে কাজ করতে পারিনি। তার কাজের এই ধারাও আর কারও মধ্যে দেখিনি আমি।

সিনেমার কথা বলতে গেলে আরও একজন মানুষের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। তিনি শব্দগ্রাহক ও পরিচালক মহসীন। তার আন্তরিক তত্ত্বাবধান না পেলে সিনেমায় আমার উত্তরণ কতটুকু হত, তা নিয়ে আমি নিজেই সন্দেহ পোষণ করি, এ জন্য তার কাছে আমার ঋণের অন্ত নেই।

তিনি খুব ভাল উর্দু জানতেন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ ও পরার্থপরায়ণ। মনে পড়ে, রহমানের অমন একটা এক্সিডেন্টের পর, তার জন্য মহসীন চাচা যা করেছেন অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবে না। রহমান অসুস্থ পড়ে আছেন, ‘মিলন’ বানানোর জন্য সব কিছু অর্গানাইজড তিনি একা করেছেন।

এই মহসীন চাচাকে পরিচালকরা ডেকে আনতেন উর্দু উচ্চারণ ঠিক করে দেয়ার অভিনয় নিয়েও পরিচালকরা তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন। ‘উজালা’র (১৯৬৬) পরিচালক কামাল আহমেদ। প্রযোজক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। তিনি ভাল উর্দু জানতেন না। মহসীন চাচা এলেন আমাদের উচ্চারণ ঠিক করে দিতে। আমি, আনোয়ার হোসেন, হাসান ইমাম, সুলতানা ভাবী সবাই তার সাহায্য নিয়ে অভিনয় করেছিলাম।

সে সময় আমরা কার ক্লোজ শট বেশি নেয়া হল, কাকে বেশি প্রজেক্ট করা হল, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। বরং কার অভিনয় কতটা চরিত্রানুগত হয় সেটাই ছিল আমাদের কাছে মুখ্য। ছবিতে কাজ করতে এসে সবাই হয়ে যেতাম এক পরিবারের মত। টাইম মেনে সেটে আসতাম। খাবার নিয়ে কোন নখরা ছিল না কারও। নায়িকা লোকেশনে গিয়ে রান্নার কাজে হাত লাগাচ্ছেন। আসলে এই টিম ওয়ার্কশীপ না থাকলে কোন কাজই সুষ্ঠু হয় না।

পাকিস্তানের সকল প্রধান নায়িকার সঙ্গে আমি একত্রে কাজ করেছি। কিন্তু কারও সঙ্গে গভীর সখ্যতা তেমন গড়ে ওঠেনি। অবশ্য দুশমনীও ছিল না কারও সঙ্গে। শবনমের সঙ্গে কাজ করেছি এ, এম পারভেজের ‘বেগানা’তে। (১৯৬৬)। কবরীর সঙ্গে কাজ করেছি ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’-এ (১৯৭০)। কাজের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে হৃদ্যতার কোন অভাব ছিল না।

চলচ্চিত্রাভিনয়কে শিল্প মনে করতাম বলেই পয়সার জন্যও খাই খাই করিনি। উল্টো, ছবির কাজ বন্ধ হয়ে গেলে পরিচালককে সেটে পয়সা দিয়ে বলেছি, ‘তাড়াতাড়ি ছবির কাজ শেষ করুন।’

আবার চরিত্র পছন্দ হল না। পয়সা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। কখনও মনে করিনি, এই চরিত্র আমি না করলেও অন্য নায়িকা তো করবেই, সে যদি করতে পারে আমি পারব না কেন? আসলে, আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এমনই ছিল যে, ভাল লাগার কিছু করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পান থেকে চুন খসলেই বাড়িতে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যেত।

মহসীন চাচার ‘গোরী’তে (১৯৬৮) খাট করে শাড়ি পরা নিয়েও বাড়িতে হুলুস্থুল বেঁধে গিয়েছিল। ‘গোরী’ নারীপ্রধান ছবি। মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় আমাকে অভিনয় করতে হবে। একজন গ্রামের। আরেকজন আধুনিকা। চরিত্রের ভেরিয়েশনের জন্য আমি গোরীর (গাঁয়ের মেয়ের) শাড়ি পরার স্টাইল, একটু পালটে দিয়েছিলাম। পালটেও ঠিক নয়। কারণ, এদেশের গাঁও গেরামের মেয়েরা আদুল গা, উঁচু করে শাড়ি অহরহ পরছে। কিন্তু সেটাই ছবিতে দেখাতে গিয়ে চিত্রালী’র রোষানলে পড়ে যাই। ভীষণ সমালোচনা করেছিলো চিত্রালী তখন। অথচ ষাটের দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় মিনি স্কার্টের তখন ঢল নেমেছে। উপমহাদেশের মেয়েরাও টেডী স্টাইলে তখন সালোয়ার কামিজ পরছেন। সেই লেখা পড়ে মা ভীষণ ক্ষেপে যান। এক কথা, এমন করে শাড়ি না পরলে কী চলতোই না? অথচ নতুন এই স্টাইলের শাড়ি পরার জন্য আমাকে রীতিমত কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। বড় বড় শাড়ির প্রন্থ কেটে কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে পেটের ওপর ফুলে না থাকে। ছোট পেটিকোট বানিয়েছিলাম, এই শাড়ি পরার জন্য। এত সমালোচনার পর এই স্টাইলের শাড়ি পরবর্তী নায়িকারাও পরেছে। কবরী, শাবানা, ববিতা— সবাই পরেছে। আসলে সিনেমার পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যেমন চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তেমনি সিনেমা পত্রিকাগুলোরও দায়িত্ব আছে। অতিরিক্ত পেশাধারী মনোভাব শিল্পকে কমার্স বা ব্যবসায় পরিণত করে ঠিকই কিন্তু সেই সঙ্গে কলা, কৃষ্টি এসবও উধাও হয়ে যায়। পারিবারিক সম্মান রক্ষা ছাড়াও আমার মধ্যে প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ কাজ করতো। কেউ যেন আমাকে নিয়ে কোন গসিপ না বা গুঞ্জন রটনা না লিখতে পারে তার জন্য ভীষণ সতর্ক থাকতাম। কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে যেতাম। এসব কারণেই কোন অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার সৃষ্টি হয়নি। আমার ইনট্রোভার্ট ক্যারেকটারও এ জন্য দায়ী। এসব কারণেই হাতে ছবির সংখ্যা কম ছিল। লেখাপড়াটাও আরেকটা কারণ হয়ত।

১৯৬৮-তে ‘গোরী’র প্রিমিয়াম শো হয় লাহোরে, সেই শোতে এসেছিলেন লাহোরের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক। এদিন পর তার সার নেম নিয়াজী ছাড়া আর কিছুই মনে নেই। ‘নয়ি লায়লা নয়ি মজনু’তে তিনি আমাকে নায়িকার জন্য কন্ট্রাক্ট করেন। এই ছবিতে কামাল, লেহরী ও আলেয়া আমার সহশিল্পী। এক ধনী কন্যা আর ধনীপুত্রের পরস্পরকে বোকা বানানোর ঘটনা নিয়ে গল্প। আমি কামালকে ভালবাসি না। তবু তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য এমন ভাব দেখাই যে সে আমার প্রাণেশ্বর। কামালও আমাকে চিট করার জন্য একই পন্থা অবলম্বন করে। ফাতরামীর চূড়ান্ত। কিন্তু ছবি মুক্তি পাওয়ার পর প্লাটিনাম জুবেলী হল। এই খুশীতে প্রযোজক আমাদের পুরো টিম নিয়ে ‘রোড টু সোয়াত’-এর কাজ শুরু করেন। কেবল আলেয়ার বদলে এল আসিয়া নামের ভারী সুন্দর এক নতুন অভিনেত্রী। বয়স অনুর্ধ্ব সতের। নীল টানা টানা দুখানি চোখ। বড় বড় পাপড়ি। কোমর ছাপান চুল। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও মেয়েটির মধ্যে বালিকা সুলভ কোন চাপল্য ছিল না। অধিকন্তু তার ভদ্রতাবোধ তার আচার আচরণ, মুগ্ধ করে দিত সবাইকে।

একদিন মিসেস নিয়াজী আমাকে ডেকে বললেন, ‘একরোজ, আসিয়াকো লেকর, হামারা ঘরমে আও— চা পিনে কি লিয়ে।’

আসিয়াকে দাওয়াতের কথা বললাম। ও আপত্তি করল না।

যাতায়াতের সুবিধার জন্য লাহোরে গিয়ে আমি একটা জাগুয়ার গাড়ি কিনি। সেই গাড়িতে করে আমি আর আসিয়া একদিন চললাম মিসেস নিয়াজীর গৃহাভিমুখে। বৈকালিক চায়ের দাওয়াতে গিয়ে দেখি শাহী আয়োজন। পান পর্ব হাস্যে লাস্যে শেষ হল। আসিয়া চুপচাপ ছিল ওর স্বভাবজাত কারণেই।

হঠৎ মিসেস নিয়াজী, আসিয়াকে লক্ষ্য করে এমন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলেন, যা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আজও সেই সংলাপগুলো হুবহু মনে আছে আমার। আসিয়াকে মিসেস নিয়াজী বললেন, ‘আপ তো বাজারু আওরত হ্যায়। হ্যায় না?’ প্রশ্নটা শুনে আসিয়া চমকে উঠল। মুখটা কঠিন হয়ে উঠল মুহূর্তে।

‘হা, হাম তো বাজার মে বয়ঠে হ্যায়, ইয়ে তো মেরা পেশা হ্যায়।’

— আপ নিয়াজী কো জানতে হ্যায়।

— কোন নিয়াজী। আসিয়ার সুন্দর ভ্রু কুচকে ওঠে।

— জিসনে আপকি নথ ওতারে হ্যায়, আপকি ফিল্ম কি প্রডিইসার। মিসেস নিয়াজী নাছোড়বান্দা।

এই কথার পর আসিয়া একটা পা, আরেকটা পায়ের উপর তুলে দিল। দুর্বিনীত হয় উঠল ওর কণ্ঠ। বলল, ‘কৌন নিয়াজী হ্যায়। কোন আখতার, আউর কোন কামাল হ্যায়, কিসকা কেয়া নাম হ্যায় উসমে মেরা কোই মতলব নেই হ্যায়। আউর আপকা খাওয়ান কো (স্বামী) মেরে কো পাস আনে কা কোই এহতেরাজ (আপত্তি) হ্যায় তো, আপ উনসে রোকিয়ে। আগার হর শাদী শুদা মরদ হাম ওমাপাস ভেজ দে তো হামারা কারবার ক্যায়েসে চলে গা?’

কথা শেষ করেই আসিয়া কোনদিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে হন হন করে বেরিয়ে গেল। এই ঘটনার জন্য আমি আদপেই প্রস্তুত ছিলাম না। মিসেস নিয়াজীর কাছেই প্রথম জানলাম যে আসিয়া হীরামন্ডীর মেয়ে। সম্প্রতি নিয়াজী ওর নথ খুলেছে। নথ খোলাটা হীরামন্ডীর একটা নিজস্ব প্রথা। ওটা কৌমার্যের চিহ্ন।

১৯৬৩ সালের পাকিস্তান রেডিও করাচির একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী কলা-কুশলীদের সঙ্গে

হীরামন্ডীর মেয়েদের ছেলে বয়সে নাক ফুঁটো করে, একটা নথ পরিয়ে দেয়া হয়। সেই নথ খোলা হয় যৌবনবতী হওয়ার পর। নথ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে ব্যবসায় নামার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। মূলত পাকিস্তানীদের সংস্কৃতি, কলার ধারক এই তাওয়াইফ শ্রেণী। নৃত্য-গীত-শায়ের, হীরামন্ডী সমাজেই লালিত ও চর্চিত হয়ে থাকে।

আসিয়ার সঙ্গে মিসেস নিয়াজীর এই বাক-বিতন্ডায় আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। ওই শান্ত, নিরীহ, মেয়েটির মধ্যে আমি যে সংযমবোধ দেখেছি, তার সঙ্গে আলাপচারিতায় তার মনের যে সৌন্দর্যের সন্ধান পেয়েছি— তাকে হীরামন্ডীর মেয়ে ভাবতেও আমার সত্যি কষ্ট হয়েছিল। মিসেস নিয়াজীর কোন কথাই আমার বিশ্বাস হয়নি। পরে আসিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, ওই দিনের ঘটনার কোন উল্লেখই করলো না সে। কিন্তু কৌতূহলে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি নিজে যেচে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। আলিয়া কিন্তু অকপটে স্বীকার করে যে সে হীরামন্ডীর মেয়ে। এবং সম্প্রতি নিয়াজী তার নথ খুলেছে। ও বলে যে, দেখ, তোমাদের যেমন কলেমা পড়ে বিয়ে হয়। আমাদের নথ খোলার অর্থটাও তাই। নথ পরাটা কৌমার্যের চিহ্ন। এই নথ যে পুরুষ খুলবে আমার দেহের অধিকার তার হবে। তার হুকুম মত আমাকে চলতে ফিরতে হবে। সন্তান হলে, তার পিতৃপরিচয় তার নামেই হবে। আমাদের সমাজে এসব দুষণীয় নয়। পুরুষরা আমাদের কাছে আসে বিনোদনের যাবতীয় রস উপভোগ করতে। আমরা হলাহল গপান করি, দেই অমৃত। তবু তোমাদের কাছে আমরা ‘বাজারী অওরত’ বলে চিহ্নিত। তুমি বল, মিসেস নিয়াজীর চাইতে আমার কী কম আছে? উনি যদি স্বামীর ঘর করতে পারেন, আমি কেন পারব না? খোদার কাছে, আমি কি অপরাধ করেছিলাম যে, এই সমাজে একজন মানুষের প্রাপ্য সম্মানটুকু আমি পাব না। বলতে বলতে আসিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে আসিয়া বলেছিল, হীরামন্ডি থেকে সিনেমায় কে আসেনি। সাবিহা, তিনিও এই হীরামন্ডীয়। সাবিহার মা ‘বালো’ উচ্চবংশজাত ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলেন। সাবিহার বাবা একজন কোচোয়ান। বালোর সঙ্গে প্রেম হলে, সে তাকে ফুসলিয়ে এনে হীরামন্ডীতে তোলে। বালো আর সাবিহার বাবাকে নিয়ে ওখানে গান পর্যন্ত বাঁধা হয়েছে।

পরে এক অনুষ্ঠানে সাবিহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। বয়স পড়ে গেছে। মা, ভাবীর চরিত্রে তখন অভিনয় করছেন। কিন্তু তার মার্জিত ব্যবহার দেখে, এই প্রশ্ন মনে উদয়ই হয় না যে তিনি কোন স্থান থেকে এসেছেন। ‘আসু বন গ্যায়ে মতি’তে আমার সহশিল্পী ছিলেন মোহাম্মন আলী ও শামীম আরা। শামীম আরার আসল নাম পুতলী বাঈ। তার ব্যবহার, আচার আচরণ, শিল্পচেতনা, অভিনয় কুশলতা থেকে কোন প্রমাণই পাওয়া যাবে না যে তিনিও ‘বাঈ’ ঘরানার অন্তর্ভুক্ত। লাহোরী সিনেমার সব মেয়েরাই যে হীরামন্ডী গোত্রের এটাও ঠিক নয়। রোকসানা, সায়কা এরা ছিলেন শিক্ষত ভদ্র সমাজের মেয়ে। সায়কার বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরে ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর, সংসারের ঘানি টানতে টানতে, ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত হন সিনেমা জগতে।

সুজাতা ও নাসিমা খান

জেবাকে নিয়েও কনট্রোভাসি ছিল। জেবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে ‘আসু বন গ্যায়ে মতি’ থেকে। খুবই সুশীলা টাইপের। প্রচন্ড ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন মহিলা ছিলেন। আমি কপালে টিপ পরতাম। এটা জেবার একবারেই অপছন্দ ছিল। তার কথা, ইয়ে সব কাফের লোক দেতি হ্যায়। বলেই মহা বিরক্তির সঙ্গে ওড়না দিয়ে আমার কপালের টিপ মুছে দিতেন। কিন্তু আমার কাছে টিপ ছাড়া সাজসজ্জাটাই অসম্পূর্ণ লাগতো।

তবে জেবা-মোহাম্মদ আলীর মত সুধী দম্পতি আমার নজরে পড়েনি আর। ওরা সব দিকে সকল অর্থে ছিল দুজনের পরিপূরক এবং ব্যালান্সড। এই দম্পতির কোন সন্তান ছিল না বলে আমার খারাপ লাগত। আমি প্রশ্ন করতাম, ‘শাদী কি ইতনে দিন হো গ্যায়ে, ভাবী তুমহারা বাচ্চা কিউ নেহী হোতা।’

জেবা বলেন, ‘তেরে বাই সে পুছ। ইসমে মেরা কোই কলুর নেহী।’

পরে জেবা ভাবী আমাকে তার কন্যা সামিনার কথা খুলে বলেন। সামিনা করাচীতে থাকত। জেবার মায়ের কাছে। এক বৃদ্ধ নওয়াবের ওরসজাত সন্তান সে।

পাকিস্তানের মোট চারটি ছবিতে অভিনয় করি। কামাল, মো. আলী এবং হাবীব। এই তিনজন ছিল আমার চার ছবির নায়ক। হাবীব অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত প্রকৃতির ছিলেন। মোহাম্মদ আলীর মতই। কিন্তু কামাল ছিল দুষ্টের শিরোমনি। ফাজলামী হুল্লোড় না করে একমুহূর্ত থাকতে পারতো না। সবসময় ও রাজকাপুরকে কপি করতো। ছেলে হয়েছে তার বৌয়ের। তিন মাইল দূরে কাউকে দেখল কী, চিৎকার শুরু করে দিল, ‘আরে ইয়ার, শুন, মেরে লড়কা হুয়া। মু মিত্র করতে যাও।’ ওর জ্বালায় মন খারাপ করে থাকে কার সাধ্য, ওর বৌ জেরিনও খুব ভাল মানুষ ছিলেন। প্রায়ই দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে খাওয়াতেন।

কামালের মত লেহরীও খুব মজার মানুষ ছিলেন। এরা দুজন একত্র হলে শয়তান পর্যন্ত পালাতে চাইত। কিন্তু তাদের রসিকতা কখনও শোভনতার সীমা ছাড়াত না। আমাকে খুবই সম্মান করতো। লাহোরের তারকা জগতে বাঙালী মেয়েদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ওদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশের সব মেয়েরা নাচতে জানে, গাইতে জানে এবং জাদু জানে।

পরিচালকের প্রতি ওদেশের তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যবহার দেখে আমি প্রথমে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরিচালকের নাম ধরে ওরা অবলীলায় বলতো— ‘এই মেরা কুরসী লাও’, কিছু পছন্দ হল না তো ধমকে ওঠতো। পরিচালকরা তারকাদের ভয়ে মিন মিন করতো। আমি ওদের এই অবস্থা দর্শনে হয়ে পড়লাম লা জওয়াব। সংলাপের কাগজটা ধরিয়ে দিয়েই পরিচালকরা লা-পাত্তা হয়ে যেতো। অথচ ঢাকায় দেখেছি, একটা ছবির পেছনে একজন পরিচালকের কি পরিমাণ ইনভলভমেন্ট থাকে। তারা অভিনয় থেকে কোরিওগ্রাফী নিয়ে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য ধরিয়ে দিতেন। আমাদের কাছে কি চাইছেন বুঝিয়ে বলতেন। লাহোরে গিয়ে দেখি, ওমা, এসব কোন কিছুরই বালাই নেই। ‘ধর মুরগী কর জবাই’ মত তারা সেটে এসেই শ্যুটিং শুরু করে দেন। এই অবস্থা বুঝতে পেরে পরিচালকদের ডেকে ডেকে ছবির ঘটনা সিকুয়েন্স অভিনয় নিয়ে আলাচনা করা শুরু করলাম। আমার এটুককুতেই ওরা বেজায় খুশি। লোকের কাছে বলে বেড়াত, নাসিমা খান বহুত সিরিয়াস এ্যাকট্রেস হ্যায়। আমার খুব সুনাম রটে গেল এতে।

বছর দুয়েকের মধ্যে লাহোরে মোটামুটি একটা সংসার সাজিয়ে ফেললাম। চিরকালই সংসার ভালবাসি। রান্না করতে, লোককে খাওয়াতে আমার ভারি আনন্দ হয়। যাতায়াতের সুধিযার জন্য গাড়ি কিনলাম। ঘরে এয়ার কন্ডিশনার বসালাম। হঠাৎ করে খবর সেলাম ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাক মিলিটারীরা গণহত্যা শুরু করেছে। বিদেশী রেডিও থেকে শুনলাম শেখ মুজিবুর জহমান পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হয়েছেন। এমনিতে আমি মাত্রাতিরিক্ত হোমসিক। দেশের কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠলাম। শেষতক রাতারাতি দেশে ফিরে যাওয়ার ডিসিশন নিলাম। গাড়িটা দিয়ে নিলাম ড্রাইভারকে। ছোট একটা সুটকেস নিয়ে পরের দিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। তখন মাত্র এপ্রিল মাস। একথা সত্যি, আমার দেশে ফিরে আসার পেছনে নিছক আত্মরক্ষার মতলব ছিল না। ওখানে আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার তখন পর্যন্ত কেউ করেনি। এমন কি পলিটিক্যাল কোন কথাই তারা আমার সামনে উচ্চারণ করতো না, পাছে আমার মনে আঘাত লাগে। তা সত্ত্বেও, আমার ওখানে পরবাসীর মত লাগতো, সব সময় মনে হত, ইউ বিলং টু ইয়োর কান্ট্রি। কষ্ট পেলে সন্তান মায়ের কোলে মুখ লুকায়। মায়ের সংকটেও সন্তানের উচিত মায়ের পাশে এসে দাঁড়ানো। আমার মনে হত, কেউ যদি আমার জান চায় তাও দেব তবু দেশের স্বাধীনতা আসুক। বাকি ক’টা মাস এদেশের প্রতিটি মানুষের মত আমিও অপেক্ষা করেছি কবে বিজয় আসবে। বুকে পাষাণ বেঁধে আত্মজনের বিচ্ছেদ শোক আড়াল করে রেখেছি। অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনটি এল। ১৬ ডিসেম্বর। আমি আগেই বাংলাদেশের একটা পতাকা বানিয়ে রেখেছিলাম। নিরাপত্তার জন্য পুরান পল্টনে আমার ফুপু ইডেনের হোম ইকনমিক্সের হেড আনোয়ারা সোবহানের কাছে থাকতাম। বিজয় ঘোষিত হওয়ার পর ছাদে গেলাম পতাকা উড়াতে। কাছেই আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়, তাকিয়ে দেখি, সেখানে বাংলাদেশের কোন পতাকা নেই। ফুপু আর আমি ছুটে গেলাম সেই অফিসে। পতাকা লাগিয়ে নেমে এলাম বুক ভরা আনন্দ নিয়ে। বাসায় ফিরে বলে গেলাম নতুন আর একটা পতাকা বানাতে। এমন সময় ‘জয়বাংলা’ বলতে বলতে হুড ফেলা জীপে করে দলে দলে মুক্তি বাহিনী আসা শুরু করল। মাথা ভরা লম্বা চুল। মুখ ভরা দাড়ি। কৃতজ্ঞতার এই দৃশ্য দেখে আমার দু’চোখে পানি এসে গেল। আমিও ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে উঠলাম ‘জয়বাংলা’। আমার হাতের অর্ধ সমাপ্ত পতাকাটা ওদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। ওদের কাউকে আমি চিনি না অথচ সেদিন ওদেরকে আমার সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়েছিল। এ জন্যেই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবস।

‘মেঘের পর মেঘ’ (১৯৭১) আমার শেষ ছবি। ওই ছবিতে রেশমা, রহমান আর উজ্জ্বল অভিনয় করেন। মনে পড়ে, রেশমার সৌন্দর্য চর্চার কথা। এ ব্যাপারে সাংঘাতিক সচেতন ছিলেন তিনি। এখনও সেই রকম আছেন কিনা জানি না। আমাকেও বলতেন সৌন্দর্যচর্চার গূঢ় রহস্য। রহমান ভাই চিরকালই একই রকম। ভাল মানুষ। আর উজ্জ্বল বিনয়ী, নম্র, ভদ্র একটি মেলে। ওদের সঙ্গে কাজ করাটা আমার জন্য অত্যন্ত সুখকর ছিল।

কিন্তু একাত্তরের পর ছবিতে অভিনয় করার স্পৃহা আমার একেবারে উবে গেল। মহসিন চাচা ‘রাতের পর দিন’ শুরু করলেন। আমাকে বলবেন নতুন নায়কের বিপরীতে অভিনয় করার অন্য। আমি কর্কট রাশির জাতিকা বলেই কিনা, একবার কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে আর নড়চড় হয় না। আমি বললাম, অভিনয় যখন করব না বলেছি, তো করবোই না। কিন্তু কথা দিচ্ছি মেজবাহকে তৈরি করে দেব। মেজবাহ ছিল অভিনয়ে একেবারে আনকোরা, ওর রিহার্সেল দেয়া থেকে সব কিছুর প্রতি আমি সতর্ক নজর রাখতে গুরু করি, ওর নাম আমি রাখি ওয়াসীম। ববিতার ডামি হয়ে ওর সঙ্গে অভিনয় করি ওকে জড়তামুক্ত করার জন্য। ববিতার সাজ-পোশাকগুলোও আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম। এর পরও ‘বাঁদী থেকে বেগম’-এর চিত্রনাট্য ও সাজসজ্জার ব্যাপারে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করি।

আমার সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্র জীবনে একবার একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদানের, সুযোগ হয়। সাধারণত, ফিল্ম ফ্যাস্টিভালগুলোতে বাংলাদেশের তারকাশিল্পীদের যাওয়ার সুযোগই জুটত না। সেবার (১৯৬১) তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে কম্পুচিয়া ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে যাওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান হল। যতদূর জানি পাক আমলে বাংলাদেশের জন্য এই সম্মান ওই প্রথম এবং ওই শেষ। বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন এহতেশাম ও সুভাষ দত্ত। এই চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক ছিলেন প্রিন্স সিহানুক। উৎসবে তিনি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিও পরিচালনা করেছিলেন। তার স্ত্রী মায়া দেবী সেই ছবিতে নায়িকার ভূমিকা (প্রিন্স সিহানুকের বিপরীতে) অভিনয় করেন। এই ছবিটি কম্পুচিয়ায় তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। এই উৎসবটি আমার কাছে বিশেষ কারণে স্মরণীয় এই জন্য যে এই উৎসবের পর কম্পুচিয়ায় নেমে আসে আগ্রাসনের করাল থাবা। মনে পড়ে প্রিন্স সিহানুক আমাকে বলেছিলেন ‘ইউ হ্যাভ কাম ফ্রম পাকিস্তান। মাই স্যালুটেশন টু পাকিস্তান।’

পাকিস্তান থেকে একাত্তরে যখন চলে আসি ‘কৌন আপনা কোন পরায়া’র কিছু শ্যুটিং তখনও বাকি। আরেকটা ছবির কাজ শুরু হয়েছিল মাত্র। কিন্তু অর্থ, প্রতাপ, প্রতিপত্তি এ সব কিছু সেদিন দেশের টানে আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল, আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, চলচিত্রের পরিবেশ বদলে যাওয়া দেখে, মনে হয়েছিল আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। অর্থের প্রতি আমার লোভ ছিল না কোনোদিনই। অল্পতেই আমি তুষ্ট। তাই চলচ্চিত্র জীবনের মোহ ত্যাগ করে চলে আসতে আমার একটুও বাধেনি। কোন প্রলোভনই এই সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে টলাতে পারেনি। অনেকে বলেন, শবনম অভিনয় করছেন, কবরী করছেন; আমি নেই কেন? আমি কাউকে বোঝাতে পারি না যে অভিনয় করি না বলে আমার আসলে কোন দুঃখ বোধ নেই। আমার দুটি সন্তানই এখন আমার সবচেয়ে বড় ধন। ওদের সৎ মানুষ করে গড়ে তোলাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

এছাড়া, এদেশে ক’টি এমন ছবি হয়, যে ছবিতে অভিনয় করতে পারলাম না বলে যুক ফেটে যাবে। শুধু অভিনয় ক্ষামতা থাকলেই হবে না, একজন পাফরমারের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য তেমন চরিত্রও চাই।

‘পরমা’র মত ছবি তৈরি না হলে, রাখীর অভিনয় ক্ষমতার বিস্তৃতি কতটুকু বোঝা যেত? ‘ওমরাও জান’ না বানালে রেখাকে ভাল অভিনেত্রী বলে কে চিনতো।

তাই, আমি এভাবেই ভাল আছি। বেশ আছি। চলচ্চিত্র কিম্বা টেলিভিশনে নেই বলে কোন সন্তাপ নেই। লোকে বলে, সিনেমা মায়ার জগৎ। একবার কেউ এখানে পা রাখলে, ইহজনমে এই মোহের জাল কেটে বের হওয়ার সাধ্যি নেই তার। ঘুরে ফিরে এখানে তাকে আবার ফিরে আসতেই হবে। কথাটা যে একেবারে মিথ্যে, তা বলব না। কেননা, চলচ্চিত্র জগৎ ত্যাগ করার পর, আবার ফিরে আসার দৃষ্টান্ত, আমাদের দেশে প্রচুর রয়েছে। কিন্তু, আমি বাতিক্রম। একাত্তরের পর, চলচ্চিত্র জগৎ সম্পর্কে, আমার সকল মোহ কেটে যায়। বড় চাচা বলতেন ‘ফিল্ম ইজ অ্যা পাওয়ারফুল মিডিয়া, এর মাধ্যমে সমাজকে কিছু দেয়া যায়। অভিনয় তোমার হাতিয়ার।’ কথাটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম। চলচ্চিত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে আমি অভিনয় করেছি। সহকর্মীদের কখনও অসম্মান করিনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রচন্ড এক ঘূর্ণিঝড় এসে আমার বিশ্বাসের সেই ভিত নাড়িয়ে দেয়। সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে চলচ্চিত্রের জন্য আনফিট মনে হল। নির্দ্বিধায় আমি চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে চলে এলাম। এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছেন আমার হিতৈষীরা। শুভার্থীরা অভিনয়ের জন্য প্রচুর অনুরোধ নিয়ে এসেছেন। মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকের প্রলোভনও থাকত। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি আমি। মানুষ তো হুট করে আর সিদ্ধান্ত নেয় না। জীবনাভিজ্ঞতার ফলাফল থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমার একার সিদ্ধান্তে চলচ্চিত্রাভিনয়ে এসেছিলাম। চলে যাওয়ার সময়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি একা। ফিল্মের গ্লামারাস ঝকমকে জীবনের কোন মোহই আমাকে আর ফেরাতে পারেনি।

আসলে, সিনেমার সব মানুষ এক নয়। ছবিতে অভিনয় করলেও, আর দশজন তারকার মত আমি ছিলাম না। খুব সাধারণ জীবন যাপনে আমি অভ্যস্ত। অতিরিক্ত মেক-আপ, সাজসজ্জা, অলঙ্কার পোশাক ইত্যাদি কোন কিছুতেই আমার মোহ নেই। আমি সিম্পল লিডিং-এ বিশ্বাসী। এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি, আমার বড় ছেলে উপল তখন কেজিতে পড়ে, স্কুল থেকে ফিরে আমাকে ধরে বসল, ‘মা আমাকে ঘুষ রেঁধে দাও।’ ঘুষ কিভাবে রাঁধব আমি আর বুঝে পাই না। ছেলে তখন কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অবশেষে, অনেক প্রশ্ন-টশ্ন করে যা উদ্ধার করলাম, তাহলো, ওর এক ক্লাসমেটের অনেক খেলনা। আরেক ক্লাসমেটের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে যে, এর বাবা ঘুষ খায়। উপলের কাছে এই ‘খায়’ এর অর্থ হচ্ছে-নিশ্চয়ই ওই ছেলের মা বেঁধে দেয় ‘ঘুষ’। সুতরাং আমি ঘুষ রেঁধে দিলে, ওর বাবা সেই ঘুষ খেয়ে ওকে অনেক খেলনা কিনে দেবে। এই হচ্ছে ওর ধারণা। আসলে ওকে আমরা খেলনা খুব কমই কিনে দিতাম। আমি মনে করি প্রাচুর্যের চেয়ে সচ্ছলতা অনেক ভাল।

আমার এই নিস্পৃহতার জন্যই চলচ্চিত্র জগতের কোন তারকার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠেনি। কারও সঙ্গে পেশাগত জেলাসীও তাই বোধ করিনি। ‘ধারাপাত’-এ সুজাতা ছিল আমার সহশিল্পী। নাটক থেকে চলচ্চিত্রে এসেছে সে। আমার ওরকম কোন ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। তবু ওর সঙ্গে অভিনয় করতে গিয়ে আমি আত্মবিশ্বাস হারাইনি একটুকু। একজন মানুষের জীবনে আত্মবিশ্বাস মস্ত বড় জিনিস। আমি দুর্বল, একথা কেউ জেনে ফেলল তো আর রক্ষে নেই। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের খড়গ নেমে আসবে। বিশেষ করে সে যদি নারী হয়।

আমি যখন ছবিতে এলাম, সে যুগে বাঙালী মুসলমান মেয়েদের পক্ষে সিনেমায় কাজ করা সহজসাধ্য ছিল না। এটা সম্ভব হয়েছিল এই জন্য যে আমাদের পরিবার রক্ষণশীল হলেও এনলাইটেড ছিল। আমার ফুপুরা বৃটিশ আমলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন বোরকা না পরে। আমার আত্মবিশ্বাসের মূলমন্ত্র যে আমার পারিবারিক পরিমন্ডল থেকেই এসেছে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। পথে গর্ত-খানা-খন্দ আছে জেনেই আমি এ পথে নেমেছিলাম। তবে চোখ খুলে, সতর্কতার সঙ্গে পথ চলেছি। তাই পা হড়কে পড়ে যাইনি। হোঁচট খেতে হয়নি। আর সিনেমা জগৎ ত্যাগ করার মানে তো এই নয় যে হারিয়ে যাওয়া। যে কোন শুভ কর্মের ভেতর দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। আমি কী করেছি, ভাল না মন্দ— সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব আমার নয়। এ দায়িত্ব এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিখিয়েদের। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার দীর্ঘ উনিশ বছর পর, কালের গভীর অনন্ত থেকে কতখানি স্মৃতি আর তুলে আনা যায়। অনেক মানুষ, অনেক ঘটনা, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত চরিত্র সাল, তারিখ আমার স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেছে। হঠৎ করে পেছন ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখি সবকিছু অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে। স্মরণশক্তিতে মরচে ধরেছে। যে জীবন ফেলে এসেছি জীর্ণপত্রের মত। তা নিয়ে একান্তে রোমান্থন করার মত সময় বা আগ্রহ আজ আর অবশিষ্ট নেই।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার স্বামী চলচ্চিত্র জগতের কেউ নন। সেইহেতু সিনেমা এবং সিনেমার মানুষদের কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাই। সিনেমা দেখা দূরে থাক, কালেভদ্রে একখানা সিনেমা ম্যাগাজিন পর্যন্ত পড়া হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের সিনেমা সম্পর্কে যেটুকু ধারণা, সেটা বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ থেকে। তবে বুঝতে পারি না, বিদ্যমান ধারার চলচ্চিত্রগুলোকে কোন অর্থে সর্বসাধারণের বিনোদন বলে উল্লেখ করা হয়। বিনোদন মানে তো স্থূলতা নয়। বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় করার ফন্দি-ফিকির নয়। তাহলে, আফিম, মদ, ড্রাগ থেকে নাটক, চলচ্চিত্রে পার্থক্য আর কী রইল। যতদূর জানি, উন্নত বিনোদন মানুষকে ভাবতে শেখায়। বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি সাধন করে এবং সমাজ সচেতন করে তোলে। আমাদের যুগেও সিনেমায় বিনোদন ছিল। আমরাও সে যুগে শার্ট, প্যান্ট, স্কার্ট পরেছি। নেচেছি, গেয়েছি। কিন্তু আজকের মত, সে যুগের নাচে ব্যবসায়িক ভাবনা এত প্রকট ছিল না। শোভনতার সীমা রক্ষা করেই নারীর দৈহিক সৌন্দর্য প্রদর্শন করা হত। আমাদের যুগের বাংলা ছবিকে, ভারত, পাকিস্তান, হলিউডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হতো। আমি মনে করি লোকে কী চায় সেটা বড় কথা নয়। আমি কী করব সেটাই প্রধান। ছবিতে কাজ করতে গিয়েও আমার এই বৃদ্ধি বা চেতনা ছিল। এজন্য, কোন পরিচালকই আমাকে মর্যাদাহীন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ইনফ্লুয়েন্স করতে পারেননি। সিনেমার মানুষের মধ্যে আর দশজন সাধারণ মানুবের মতন, যেমন এ্যানিম্যালিটি আছে তেমনি র‌্যাশনালিটিরও অভাব নেই। মানুষ বুঝেই তারা কথা বলে। সুতরাং একতরফা দোষ দিয়ে আমি কোনদিনই বলব না যে, মেয়েরা পরিচালকের হাতের পুতুল। তারা যেমনি নাচাবে, আমরা তেমনি নাচতে বাধ্য থাকব।

যাই হোক, ছিয়াত্তর-এর সেপ্টেম্বর মাসের উনত্রিশ তারিখে আমার কোল জুড়ে এল ‘উপল।’ আমার রক্ত মাংসে গড়া, আমার প্রথম সন্তান। এই ছেলে হয়ে উঠল আমার চব্বিশ ঘন্টার সমস্ত আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু। শিল্পচর্চার চাইতে সন্তান পরিচর্যাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। সন্তান-সংসারের মধ্যে আমি সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম। সন্তান হওয়ার সঙ্গে যেকোন বয়সের নারী— বালিকার খোলস মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে। মাতৃত্বের দায়িত্ববোধই নারীকে আমূল পাল্টে দেয়। আবার মাতৃত্বের কারণে, নারী নির্ঘাতন হয়— এটাও সত্যি। সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে নারী চোখ-কান বন্ধ করে স্বামী, শাশুড়ীর নির্যাতন সহ্য করে এর জন্য, আমার কথা হল, মা হওয়ার আগেই নারীকে অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। কখনও পুরুষের ভালবাসা বঞ্চিত হলে সন্তানদের নিয়ে আর্থিক সংকটে তাকে আর তখন পড়তে হবে না। দিনান্তে, শাকান্ন আহার করলেও, সন্তানদের বুকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারবে সে। আমি দেখেছি, এ সমাজে, একজন বিধবা নারী যে সম্মান ও শ্রদ্ধা লোকের কাছ থেকে পায় তার ষোল ভাগের একাংশও কোন স্বামী পরিত্যক্ত নারীর ভাগ্যে জোটেনা, মা, ভাই, বোনের কাছে সেই নারীর অবস্থা আরও করুণ। ফাঁসি কাষ্ঠে কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর চাইতেও জঘন্য। নারী পরার্থবাদী প্রকৃতিগতভাবেই। তাই বলে, আত্মপ্রবঞ্চনারও তো একটা সীমা আছে? ঊনাশিতে একেবারে হঠাৎ করে আমি টিভিতে চলে এলাম। এর জন্য আমায় মানসিক প্রস্তুতি পর্যন্ত ছিল না। এক নিকটতম বন্ধুর বাড়িতে টিভি প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। রেডিওতে নাটক করার সুবাদে তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। আমাকে দেখে উনি বললেন, ঘরেই তো বসে আছ। বিকেলে টিভিতে কাজ করলেই পার। প্রস্তাবটা মন্দ লাগল না। তারপর ‘৭৯ থেকে ৮৫ পর্যন্ত একটানা টিভিতে। দর্শকের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রথমদিনে আমি সামান্য একটু নার্ভাস হয়ে পড়ি। তারপর সব ঠিক হয়ে যায়।

অঞ্জলী, আইভীরা আমার বয়কনিষ্ঠ। তা সত্ত্বেও, ওদের সকলের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রত্যেক মাসে আমাদের ত্রি-ইউনিয়ন পার্টি হত। কারও আপদ-বিপদ হলে, পরস্পরের খোঁজ খবর করতাম।

টিভি নাটকে অভিনয়ের জন্য প্রযোজকরা এসে ধরতেন মাঝে মাঝে আমাকে। কিন্তু বড় পর্দার বিশাল ক্যানভাসে কাজ করার পর, ছোট পর্দায় অভিনয়ের ব্যাপারে আমার আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। অবশ্য, দেশ-বিদেশের অনেক বড় বড় পারফরমাররাও অবলীলার দুই পর্দায় কাজ করে থাকেন। তবু, আমার ধারণা, এ ধরনের কোন প্রশ্ন নিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে তাদের পছন্দ বড় পর্দা’র দিকেই যাবে।

উপস্থাপনার কাজে সৃষ্টিশীলতার কোন স্কোপ নেই। তবু এটাকে আমি একটা পারফর্মিং আর্টই বলব। কেননা, আমি দেখেছি, সামান্য দু’চারটা কথার মধ্য দিয়েও দর্শকের আস্থাভাজন হওয়া, শ্রদ্ধা অর্জন করা সম্ভব। শুদ্ধ উচ্চারণ, নিখুঁত বাচনভঙ্গী দিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও দর্শককে সম্মোহিত করে ফেলতে পারেন একজন উপস্থাপক। চলচ্চিত্র জগৎ ত্যাগ করার দীর্ঘ আট বছর পর আমি টিভিতে উপস্থিত হয়েছিলাম দ্বিতীয়বার মা হতে গিয়ে। আমি টেলিভিশন ছেড়ে আবার ঘরে এলাম। আগেই বসেছি সব কিছুর উর্ধ্বে আমার সঞ্জন। ওদের। সুখের জন্য, নিরাপত্তার জন্যই, আমি সব কিছু ত্যাগ করে স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়েছি।


Leave a reply