Select Page

নেপথ্য কাহিনি: ঢাকায় নারী নির্মাতার অভিষেক ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’

নেপথ্য কাহিনি: ঢাকায় নারী নির্মাতার অভিষেক ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’

৭ মার্চ ১৯৭০। মুক্তি পায় ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’। রেবেকা আত্মপ্রকাশ করেন ঢাকার প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে …

অন্যান্য দেশেরগুলোর মতো ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও ভীষণভাবে পুরুষ-প্রধান। ছবিগুলো নায়ক-নির্ভর। অভিনেত্রী বাদে প্রায় সব কলাকুশলীই পুরুষ। এমনকি শুরুর দিকে নারী অভিনেত্রীও পাওয়া ছিল মুশকিল। অথচ দুই দশকের মাথায় এই ইন্ডাস্ট্রিতেই একজন নারী এর বিরুদ্ধে চোখ রাঙিয়েছিলেন! নাম লিখিয়েছিলেন পরিচালক হিসেবে।

তার নাম রেবেকা সুলতানা। ঢাকার প্রথম নারী পরিচালক। পারিবারিক নাম মনজন আরা বেগম। জীবনের শুরুটা হয়েছিল অবশ্য আর দশজন নারীর মতোই। বিয়ে করে সামলাচ্ছিলেন ঘরকন্না। সেখান থেকে পরে চলে আসেন একদম বিপরীত মেরুতে। স্বামীর সঙ্গে হয় বিচ্ছেদ। নেন ব্যাংকের চাকরি। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকে। সন্তান আগলে একাই চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। পাশাপাশি জড়িয়ে পরেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে।

শুরু করেন অভিনয় দিয়ে। রাত্রি রায় নামে। নায়িকা হিসেবে অবশ্য নয়। বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রে। মোট ১৪টা ছবিতে অভিনয় করেন। তার মধ্যে আছে জিল্লুর রহিমের ‘এইতো জীবন’ (১৯৬৪), জহির রায়হানের ‘বাহানা’ (১৯৬৫), মুস্তাফিজের ‘মালা’ (১৯৬৫), ‘ডাকবাবু’ (১৯৬৬) ও ‘ছোটে সাহাব’ (১৯৬৭), বশীর হোসেনের ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ (১৯৬৬), আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চুর ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৬৭), আজহার হোসেনের ‘উলঝন’ (১৯৬৭), ফখরুল আলমের ‘মানুষ অমানুষ’ (১৯৭০)।

তবে শুরু থেকেই আগ্রহী ছিলেন পরিচালনায়। তার নানা কলাকৌশল শিখে নেন ছবিগুলোতে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে। বিশেষ করে জহির রায়হান আর মুস্তাফিজের কাছ থেকে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন ওপার বাংলার দুইজন। ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়। তাদেরই মতোন জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের ছবি বানানোর চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। বিশেষ করে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র (১৯৬০) ব্যাপক প্রভাব দেখা যায় তার ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’-এ।

গল্পটা পছন্দ করে দেন তার গুরু। ফখরুল আলম১। একদিন আড্ডায় আলাপে আলাপে তাকে নিজের জীবনের গল্প বলেছিলেন। শুনে ফখরুল আলম বলেন তার থেকে ছবি বানাতে। ভাবনাটা পছন্দ হয় রেবেকা সুলতানার। রাজি হয়ে যান। মদন সাহু ছিলেন দুজনেরই বন্ধুস্থানীয়। তাকে দিয়ে লেখান চিত্রনাট্য। দুই নারীর দুটো গল্প নিয়ে কাহিনি। একটি প্রেমিক দ্বারা প্রতারিত এক তরুণীর গল্প। অন্যটি এক নির্যাতিত বিবাহিত নারীর। তাদের দুঃখ যেন একটা বিন্দুর মতো শুরু হয়ে ক্রমান্বয়ে বৃত্তের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রমশ বাড়তেই থাকে। তার বিপরীতে আশাও ঠিক তেমনি। তাই ছবির নাম দেয়া হয় ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’।

পরিচালক রেবেকা

এরপর আসে আসল সমস্যা। পুঁজি। তার প্রাথমিক জোগান দেন ফখরুল আলমের মা। জমি বিক্রি করে রেবেকা সুলতানার হাতে তুলে দেন ৮০ হাজার টাকা। আরো একজন এমনি বড় অংকের টাকা দেন। মফিজ। তিনি ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। আসলে ছবির প্রায় সব চরিত্রে তারা নিজেরাই অভিনয় করেন। রেবেকা সুলতানা নিজেও অভিনয় করেন। নির্যাতিত বিবাহিত নারীর চরিত্রে। অভিনয় করেন তার গুরু ও ছবির প্রযোজক ফখরুল আলমও। কেবল তরুণী নায়িকার চরিত্রে নেন পরিচিত মুখ। আতিয়া২।

কেবল অভিনয়েই নয়, খরচ বাঁচানো হয় ছবির প্রতিটি ক্ষেত্রেই। অধিকাংশ দিন তারা শুটিং করেন স্রেফ মুড়ি খেয়ে। রাখা হয়নি অতিরিক্ত প্রোডাকশন বয়। নিজেরাই পালা করে প্রম্পটের কাজ সারেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মেকআপ নেয়ার সময় নিজেরাই লাইট ধরেন। অনেক সময় মেকআপের সরঞ্জামেই টান পরত। একবার লিপস্টিক নেই দেখে আতিয়াকে পান খেতে দেয়া হয়! আক্ষরিক অর্থেই পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে শট দেন তিনি।

৭ মার্চ ১৯৭০। মুক্তি পায় ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’। রেবেকা আত্মপ্রকাশ করেন ঢাকার প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে। যে ধারার ছবি তাতে খুব একটা ব্যবসা করার কথা নয়। করেওনি। তবে দেখানো হয় বিটিভিতে৩।

বছর না ঘুরতেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। দেশটাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি ও তাদের দোসররা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এই ছবিটিও। নেগেটিভ শুদ্ধ পুড়িয়ে দেয়।

পরে আর ছবি বানাননি রেবেকা সুলতানা। ইচ্ছে অবশ্য ছিল। পরিকল্পনাও। কিন্তু তারচেয়েও গুরুদায়িত্ব বলে মনে হয় সন্তানদের দেখাশুনা। ওরা বড় হতে হতে দেশের চলচ্চিত্র জগতটাই কেমন বদলে যায়। তার সহযাত্রীদের অনেকেই মারা যান। ইন্ডাস্ট্রিটাও তার প্রত্যাশা মাফিক এগোতে পারেনি। সব মিলিয়ে শুরুটাই শেষ হয়ে থাকে রেবেকা সুলতানার।

টীকা:

১ পরিচালক। পরিচালিত ছবি ‘মানুষ অমানুষ’ (১৯৭০), ‘জয় বাংলা’ (১৯৭২), ‘শনিবারের চিঠি’ (১৯৭৪)।

২ আতিয়া চৌধুরী। শাহানা নামেও পরিচিত। ষাট ও সত্তরের দশকে বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেছেন।

৩ পাকিস্তান আমলে নাম ছিল পিটিভি।


About The Author

নাবীল অনুসূর্য

চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক

Leave a reply