পরাণ জুড়ানো বাণিজ্যিক সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’
অনেক তারকা অভিনয়শিল্পী থাকলেও তারকা নির্মাতার সংখ্যা এখন খুবই কম। সেই কমের মধ্যে একজন রায়হান রাফী। এই সময়ের দর্শকদের পালস বোঝেন তিনি। ছোট পর্দার সুপারস্টার আফরান নিশোকে নিয়ে হাজির হওয়ায় তার নতুন সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশাও কয়েকগুণ। না, প্রত্যাশা বা আগ্রহ কোনটাই বিফলে যায়নি। এককথায় ‘সুড়ঙ্গ’ আফরান নিশোকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে শক্ত জায়গা যেমন করে দিবে তেমনি রায়হান রাফীর এ যাবতকালের সেরা নির্মাণ বললেও ভুল হবে না।
অল্প করে বলতে গেলে, সুনামগঞ্জের অসাধারণ সুন্দর একটি গ্রামের তরুণ মাসুদ প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে ময়নার। এরপর সমীকরণ বা সুত্র মেনে প্রেম ও বিয়ে। তবে বউ হিসেবে ময়না প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী। বউয়ের চাহিদা মেটাতে অল্প আয়ের স্বামী ঘটনার নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামলে একটা সময় নেমে যায় সুড়ঙ্গে। এরপর কী হয়? কীভাবে মাথায় আসে এই সুড়ঙ্গ তার জীবন বদলে দেবে? জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কঠিন হিসাব কীভাবে মেলাবে সেই তরুণ! সেই উচ্চ ভিলাষী তরুনীর পরিনতি কী? সব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই জমজমাট ‘সুড়ঙ্গ’।
দর্শকদের স্ক্রিনের সামনে মন্ত্রমুগ্ধ করে বসিয়ে রাখার মতো নাজিম-উদ-দৌলার গল্প, রায়হান রাফীর বিশাল ক্যানভাসের প্রেজেন্টেশন নিঃসন্দেহে ঈদের অন্যতম বড় ধামাকা। সঙ্গে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকারের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি সিনেমাটিকে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। মোদ্দাকথায়, বিগস্ক্রিনের দর্শকদের জন্য ‘সুড়ঙ্গ’ একটি পরিপূর্ণ ভিজ্যুয়াল ট্রিটমেন্ট।
অবশ্যই আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় আর্ট ডিরেকশন টিমের কাজ। সুনামগঞ্জের নীলাদ্রি হোক বা চট্রগ্রামের নতুন ব্রীজের পার্শ্ববর্তী এলাকা ‘সুড়ঙ্গ’র ফ্রেমে ম্যাজিকের মতো মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। একটি এলাকাই বানিয়ে ফেলেছেন তারা গল্পে বিশ্বাসযোগ্যতা আনার তাগিদে। আছে মানানসই কস্টিউম ও মেকআপ। হোয়াট এ পারফেকশন! ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও কালার গ্রেডিং পারফেক্ট।
‘সুড়ঙ্গ’ সোজা বাংলায় পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক সিনেমা। প্রেম, বিচ্ছেদ, প্রতিশোধ, হালকা কমিক রিলিফ, রোমান্টিক গানের পাশাপাশি আইটেম গান, নিম্নবিত্ত সমাজ ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভংগি, ব্যভিচার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবকিছুই আছে। প্রথম হাফে রোমান্টিক গল্প মনে হলেও দ্বিতীয় হাফে যেতে যেতে সুড়ঙ্গ একটি পরিপূর্ণ থ্রিলার ও সাসপেন্স সিনেমা হয়ে উঠে। গোছানো ও টুইস্টে ভর করা ট্রান্সফরমেশন অসাধারণ লেগেছে।
অভিনয়ে তমা মির্জা নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এমন একটি চরিত্র কয়টা অভিনেত্রী এই সময়ে এসে এতো সুন্দরভাবে ক্যারি করতে পারবে সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকলেও তমা মির্জা নিজের সেরাটা দিয়েছেন। মুস্তফা মনোয়ার যতটুকু স্পেস পেয়েছেন তাতে মুগ্ধই করেছেন। তবে তার চরিত্রটি নিয়ে আরো একটু কিছু করা যেতো বলেই মনে হয়। ‘পুরানো চাল ভাতে বাড়ে’ প্রবাদের মতো করে বলতে হয় শহীদুজ্জামান সেলিমের কথা। সময় পেয়েছেন কম তবে তাতেই দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রতিভা ও মেধার দম। চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি জাদু ছড়িয়েছেন রীতিমতো। আইটেম গানে নুসরাত ফারিয়া আগুন ছড়িয়েছেন। গানটির সঙ্গে স্ক্রিনে নিশোর পারফরম্যান্সও প্রেক্ষাগৃহে শিস, তালি দিয়েই উপভোগ করেছেন সাধারণ দর্শকেরা।
আফরান নিশোকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। তবে প্রথম সিনেমা হিসেবে প্রত্যাশার চেয়ে উতরে গেছেন। এতো দমদার এন্ট্রি বিগত এক দশকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো অভিনেতার হয়েছে বলে মনে পড়ে না। মাসুদ চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন শেড ছিলো এবং চমকে দিয়ে প্রতিটা শেডেই অনন্য নিদর্শন রাখলেন নিশো। ব্রিলিয়ান্ট পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়ে দিলেন, সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিলেন তিনি ঢাকাই সিনেমার নেক্সট বিগ থিং।
বলা হয়ে থাকে জানা বা চেনা গল্প স্ক্রিনে প্রেজেন্ট করাটা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ দর্শকেরা জানে যে সামনে কী হতে পারে। তবে নির্মাতার প্রেজেন্টেশন বলি বা এক্সিকিউশন এক্ষেত্রে বিশাল ব্যবধান গড়ে তোলে। রায়হান রাফী ও তার টিম এই ক্ষেত্রে নিজেদের মেধা, ডেডিকেশন ও ভালো করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জে সফল। ‘সুড়ঙ্গ’ এককথায় অসাধারণ একটি এক্সপেরিয়েন্স। যেখানে দুই বছর অন্তর একজন নির্মাতার সিনেমা মুক্তি পায় না সেখানে রায়হান রাফী নিয়মিত সিনেমা বানাচ্ছেন যা এই সময়ে এসে অবাক করার মতোই। তবে রায়হান রাফীর ভিন্ন ভিন্ন গল্পের মোড়কে থ্রিলার বা সাসপেন্স ঘরানার গল্পে নিজেকে প্রতিনিয়ত নিজেই ছাড়িয়ে যাবার ব্যাপারটা একদিক থেকে দেখতে গেলে প্রশংসনীয়। ভালো কনটেন্ট ও তার প্রপার এক্সিকিউশন নিয়ে দর্শকদের হলমুখী করার এই ট্রেন্ড নিঃসন্দেহে প্রশংসার।
গত বছরের ‘পরাণ’ এবং ‘দামাল’ এর পরে এবার ‘সুড়ঙ্গ’। রায়হান রাফীর সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স হলে যেয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাস গড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এভাবেই মুগ্ধ করুক প্রতিনিয়ত এটাই কাম্য।