Select Page

ফেরিঘাটে হারিয়ে ফেলা মণিকাঞ্চন

ফেরিঘাটে হারিয়ে ফেলা মণিকাঞ্চন

নির্মাতা আলমগীর কবির ও অভিনেত্রী টিনা খানের মৃত্যু যে একই সূত্রে গাঁথা, কেই বা ধারণা করতে পেরেছিল। দুজন একসঙ্গে ‘মণিকাঞ্চন’  নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে কাজ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি নগরবাড়ী ফেরিঘাটে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাদের গাড়ি পানিতে পড়ে যায়, সেখানেই মারা যান তারা।

সব্যসাচী আলমগীর কবির একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, সমালোচক, সংলাপ রচয়িতা ও চলচ্চিত্র প্রশিক্ষক। তার জন্ম ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে। ওনার ডাক নাম ছিল মিন্টু, বাবা আবু সাইয়েদ আহমেদ ও মা আমিরুন্নেসা বেগম।

খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন আলমগীর কবির, বাবার কর্ম সূত্রে হুগলীতে থাকা অবস্থায় পড়াশোনা শুরু হুগলী কলেজিয়েট স্কুলে, সেখান থেকে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। এরপর দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ইন্টার মিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক  ডিগ্রি নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন, এরপর শুরু করেন সাংবাদিকতা। এর মাঝেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলচ্চিত্রের ইতিহাস ও পরিচালনার ওপর প্রশিক্ষণ নেন, সেটা ১৯৬৫ সালের কথা। এর পরের বছর ১৯৬৬ দেশে ফিরে আসেন আলমগীর কবির এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দান করেন৷

প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ নামে। যুক্ত ছিলেন আরও কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে।

আলমগীর কবির ১৯৭৩ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী গল্প নিয়ে ‘ধীরে বহে মেঘনা’। সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থান তুলে ধরে  ১৯৭৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘সূর্যকন্যা’। ছবিটির কাহিনি থেকে চরিত্র, গান-সংলাপ সবই ছিল বেশ ব্যতিক্রমী। এক কল্পনাপ্রবণ ভাস্কর্যশিল্পী (বুলবুল আহমেদ) নিজের তৈরি এক নারীমূর্তির প্রেমে পড়ে, যার বাস্তবতার কোন ভিত্তি নাই তবে কল্পনার রাজ্যে থাকে তার অবাধ বিচরণ। ছবিটিসহ ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী’ ও ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৭০ সালের এক ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের তিন মাস পর এক জোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের এক সামুদ্রিক চরে পাওয়া গিয়েছিল, যারা খুব কষ্টকর অবস্থায় বেঁচে ছিলেন, সে সময় সংবাদপত্রে খবরটি ফলাও করে প্রকাশ করা হলে তা দেখে তিনি নির্মাণ করেন ‘সীমানা পেরিয়ে’ (১৯৭৩)। ছবিতে বুলবুল আহমেদ ও জয়শ্রী কবিরের মনোমুগ্ধকর অভিনয় এখনো যে কারো মনে দাগ কেটে যায়, সঙ্গে ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

আলমগীর কবির মোট সাতটি ছবি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন— ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্য্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রুপালি সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), পরিণীতা (১৯৮৪) এবং মহানায়ক (১৯৮৬); প্রতিটি ছবিই ছিল সমালোচকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত৷

চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি তিনি মোট দশটির মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন; যার মধ্যে আছে— লিবারেশন ফাইটার্স, সুফিয়া, ভোর হলো দোর খোল, প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ, আমরা দুজন, কালচার ইন বাংলাদেশ, অমূল্য ধন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, চোরাস্রোত ও মণিকাঞ্চন। এ ছাড়া তিনি চলচ্চিত্রের ওপর কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করেন। চলচ্চিত্রে অসাধারণ অবদান রেখে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাচসাসসহ নানা সম্মান ও স্বীকৃতি পান আলমগীর কবির।

প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে টিনা খান ও আলমগীর কবিরের মাঝে চলচ্চিত্র সমালোচক ফাদার গাঁস্ত রোবেজ

দুই.

আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙাল অসম্ভব জনপ্রিয় গানটির কথা মনে পড়লেই যে স্নিগ্ধ সুন্দর মুখটির ছবি ভেসে ওঠে তিনি টিনা খান, যাকে হয়তো এই প্রজন্মের অনেকেই চেনেন না, অথচ আশির দশকে তিনি ছিলেন অনেকেরই পরিচিত মুখ। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী, পুরো নাম ফিরোজা রহমান টিনা, চলচ্চিত্র অঙ্গনে টিনা খান নামেই পরিচিত ছিলেন।

টিনার জন্ম ১৯৬২ সালের ২৫ মে চুয়াডাঙ্গায়। প্রথমে মঞ্চ নাটক পরে চলচ্চিত্রে আসেন। প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র ‘বিমানবালা’, যার কিছু অংশের নির্মাণ হলেও পরে আর সম্পূর্ণ হয়নি। অভিনীত অন্যান্য ছবির মধ্যে মৌচোর, শাহী চোর, আল হেলাল, লাগাম, আলী আসমা, মধু মালতী, সময় কথা বলে, রজনীগন্ধা, ধর্ম আমার মা, সোহাগ মিলন, আয়না বিবির পালা, প্রিন্সেস টিনা খান অন্যতম।

প্রতিভাবান অভিনেত্রী টিনা খানকে নিয়ে আলমগীর কবির ‘মণিকাঞ্চন’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার নামে নির্মিত ‘প্রিন্সেস টিনা খান’ ছিল প্রথম কোনো নায়িকার নামে নির্মিত ঢাকাই সিনেমা।

টিনা খান ১৯৮৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে জুরি বোর্ডের বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত হন। এর পরের বছরই তিনি ও আলমগীর কবির দুর্ঘটনায় মারা যান।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আরিফুল হাসান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন