Select Page

বরবাদ সিনেমার শাকিব খান যেন বাংলার কিয়ানু রিভস

বরবাদ সিনেমার শাকিব খান যেন বাংলার কিয়ানু রিভস

শাকিব খানের ‘অনন্ত ভালোবাসা’ যে বছর (১৯৯৯) মুক্তি পেল ততদিনে হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার অভ্যাস প্রায় বন্ধের পথে। যে আমি এক সময় স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হলে বসে বাংলা সিনেমা দেখতাম সেই আমিই হলবিমুখ হয়ে গেলাম অশ্লীল আর কাটপিস নির্ভর সিনেমা চালু হওয়ার কারণে।

শুরুতে শাকিব খানকে নিয়ে যে খুব আগ্রহী ছিলাম ব্যাপারটা তেমনও নয়। মান্না, ফেরদৌস, রিয়াজ, নাঈম ও সালমান শাহর সিনেমাগুলো মুক্তি পেলে যেভাবে বাড়তি আগ্রহ নিয়ে দেখতে যেতাম সেই ব্যাপারটা মোটেও ছিল না শাকিবের বেলায়।

দায়টা শাকিবের না আমার ওই আলোচনা আরেকদিন করা যাবে। আজ শুধু ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত শাকিবের নতুন সিনেমা বরবাদ নিয়ে কথা বলব।  

বাংলা চলচ্চিত্রে শাকিবের অভিষেক ১৯৯৯ সালে। ‘অনন্ত ভালোবাসা’ দিয়ে। এরপর গত ২৬ বছরে একে একে শাকিব উপহার দিয়েছেন অন্তত সাড়ে ৩০০-এর ওপরে সিনেমা। অভিনেত্রী ইরিন জামানের সঙ্গে ‘অনন্ত ভালোবাসা’র রোমান্টিক ইমেজের চরিত্র থেকে পরের সিনেমাগুলোয় একটু একটু করে বিবর্তন (ট্রান্সফরমেশন) ঘটেছে শাকিবের। নিজেকে ভেঙেছেন। আবার গড়েছেনও। চরিত্র নির্বাচনে খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

বরবাদ সিনেমা দেখতে দল বেঁধে সিনেমা হলে পরিবারসহ আমরা।

প্রথমবার শাকিব খানকে দেখেছি ‘সুভা’ সিনেমায়। শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প বলেই আগ্রহী হই সিনেমাটা দেখতে। কিন্তু প্রথম দেখা শাকিবকে আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল ‘সুভা’ সিনেমার প্রতাপ চরিত্রে। সত্যি বলতে বাণিজ্যিক সিনেমার তারকা হিসেবে পরিচিত শাকিবের ইমেজে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল ছবিটি। শাকিবের আরেকটি সিনেমা ‘সত্তা’ও আমাকে দারুণভাবে টেনেছিল। পাওলি দামের সঙ্গে কী ‍দুর্দান্ত অভিনয়! এই শাকিব খানকে আপনি কখনোই মেলাতে পারবেন না ‘বলব কথা বাসর ঘরে’ বা ‘প্রেম কয়েদি’ টাইপের নায়ক চরিত্রের শাকিবের সঙ্গে।

একটু একটু করে শাকিব খানে আগ্রহ বেড়েছে আমার। ততদিনে শিকারি, নাকাব, পাসওয়ার্ড, বীর, গলুই দেখা হয়ে গেছে। হালের প্রিয়তমা, রাজকুমার, তুফান, দরদ সবই দেখলাম শাকিবের অভিনয় দেখব বলে। তবে শাকিব খানের বিবর্তনের সর্বশেষ রূপটা দেখলাম ‘বরবাদ’ সিনেমায়।

ওটিটি, ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের যুগে এই প্রজন্মের দর্শকেরা সহজেই দেখে নিতে পারেন জন উইক, পুষ্পা, কেজিএফ, সালার, এনিম্যাল, মারকোর মতো ধুন্ধুমার অ্যাকশনের সিনেমা। কিন্তু চাইলেই কি মুঠোফোনে, ল্যাপটপে সেই স্বাদটা নেওয়া যায়? যে স্বাদটা পাওয়া যায় বড় পর্দায়! চোখের শান্তি বলেও তো একটা কথা আছে।

কিয়ানু রিভস, আল্লু আর্জুন, ইয়াশ, রণবীর কাপুর যখন ভিলেনের সঙ্গে ধুন্ধুমার মারামারিতে ব্যস্ত সেটার বিজিএম আর বড়পর্দায় ত্রুটিহীন ক্যালিগ্রাফি ঠিক মুঠোফোনে বা টেলিভিশনে উপভোগ করা যাবে না। এটার মাহাত্ম্যও আপনি বড়পর্দায় না দেখলে বুঝবেন না। বাংলাদেশের দর্শকেরা নিজেদের হলে, নিজেদের দেশে, নিজেদের চিরচেনা কোনও নায়কের কাছ থেকে এমন কিছুই দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যেটা এবার দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন পরিচালক মেহেদী হাসান হৃদয়। বাংলাদেশেও যে বিগ বাজেটে মুভি তৈরি করা যায় সেই দুঃসাহস করে দেখিয়েছেন প্রযোজক শাহরিন আক্তার সুমি। এতদিন পর বাংলাদেশের দর্শকেরা যেন বরবাদের মধ্যে শাকিব খানকে অনুদিত হতে দেখেছেন একজন রণবীর কাপুরের। একজন কিয়ানু রিভসের।

সিনেমা হলে বরবাদের পোস্টারের পাশে আমার তিন কন্যা (বাঁ থেকে) মানহা, মাইশা ও মৌলি

ঈদের এগার দিন পার হওয়ার পরও গিয়ে দেখি সিনেপ্লেক্স হাউসফুল। মিরপুর সনি স্কয়ারের সিনেপ্লেক্সে রাতের শেষ শোয়ে আমরা পরিবারের সদস্যসহ সব মিলিয়ে বারো জনের একটা বিশাল দল। কিন্তু আমাদের মতো অনেকেই এসেছেন পরিবার নিয়ে। যেন একটা পিকনিক। একটা ছোটখাটো উৎসব। যে উৎসব দেখে মনে পড়ে ২০১১ সালের কথা। দিল্লির একটা সিনেমা হলে সদ্য মুক্তি পাওয়া বিদ্যা বালানের সিনেমা ‘ডার্টি পিকচার’ দেখতে গিয়েছিলাম। দিল্লির ওই সিনেমা হল থেকে শো ভাঙার পর যেভাবে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর দল বেঁধে হুমড়ি খেয়ে বের হচ্ছিল তা দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। নব্বয়ের দশকে যেভাবে বাবা মা, চাচা চাচীর সঙ্গে সবাই মিলে সিনেমা হলে যেতাম। সেই পুরনো দৃশ্যগুলোই যেন বাংলা সিনেমায় আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছে ‘বরবাদে’ ভর করে।

সিনেমার গল্পটা বলতে চাই না। শুধু বলব স্টোরি, স্ক্রিনপ্লে, সিনেমাটোগ্রাফি, মিউজিক, সেট ডিজাইন, অ্যাকশন, লোকেশন, ডায়লগ, অভিনয় সব কিছুই ছিল অসাধারণ।   

শাকিব খান প্রিয়তমার পর যেন নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছেন। একরকম দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করা এই শাকিবকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন রায়হান রাফী ‘তুফান’ দিয়ে। কিন্তু এবার সেই ইনিংসকেও ছাপিয়ে গেলেন মেহেদী হাসান হৃদয়! বরবাদে শাকিব খানকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা আগে কেউ কল্পনাও করেনি।

বরবাদ গল্পে জটিলতা নেই, কিন্তু গভীরতা রয়েছে। এটি মূলত বিত্তশালী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান আরিয়ান মির্জার গল্প, যে ভালোবাসে নীতুকে। তার জন্য সে পুরো দুনিয়া বরবাদ করে দিতেও প্রস্তুত! তবে সেই নীতুর কারণেই একসময় সে গ্রেফতার হয়। চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে শাকিব খান যা করেছেন, সেটা অনায়াসে বলিউডের খানদের সঙ্গে তুলনা করতেই পারি।

শুধু শাকিব নন, ইধিকা পালও বেশ চমক দেখিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু দৃশ্যে তিনি এমনভাবে শাকিবের বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন যে দর্শক অবাক না হয়ে পারেনি। মিশা সওদাগরকে যত দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি। আদিব মির্জার চরিত্রে তিনি ছিলেন অসাধারণ। অবাধ্য বখে যাওয়া সন্তানের কাছে একজন পিতার অসহায়ত্ব সবচেয়ে বেশি করে ফুটে ওঠে যখন আরিয়ান মির্জা অস্ত্রভর্তি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান মিতুকে মারতে। ওই সময়ের অসহায় অদিব মির্জার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। চেয়ে দেখা ছাড়া তার যেন তখন কিছুই করার ছিল না। মিশা সওদাগরের ওই অভিব্যক্তি দেখে স্রেফ গুজবাম্প হচ্ছিল। সত্যি বলতে বাংলা সিনেমায় হুমায়ুন ফরিদীর পর সম্ভবত আরেকজন গুণী ভিলেন মিশা।

আরেকজন অভিনেতা ভারতের শ্যাম ভট্টাচার্যর কথা না বললেই নয়। ‘ওই জিল্লু মাল দে’ সংলাপটি ভাইরাল হওয়ার পেছনেও কলকাতার এই অভিনেতার কৃতিত্ব আছে। পুরো সিনেমায় তাকে এক পোশাকে দেখা গেছে। অল্প সময়ের চরিত্র চিত্রায়নে ফজলুর রহমান বাবুও ছিলেন অসাধারণ। ইন্তেখাব দিনার, শহীদুজ্জামান সেলিমও অনন্য।

তবে ভারতের শক্তিমান অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তকে আরও বেশি সময় পর্দায় দেখতে চেয়েছিলাম আমি। তার চরিত্রটি যতটা ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, পর্দায় সেই শক্তিশালী উপস্থিতি ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলা হয়নি। এমনটাই মনে হয়ে আমার কাছে।

সিনেমার প্রতিটি গানই ভালো লেগেছে। বিশেষ করে ‘প্রতি নিঃশ্বাসে নাম তোমার, লেখা আমার মনের ভেতরে’ ও ‘জানি না কি করে তুমি এসে হৃদয়ে খুলে দিলে সব জানালা’— নিঃশ্বাস ও দ্বিধা শিরোনামের গান দুটি হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো।

পরিচালক মেহেদী হাসান হৃদয় নতুন হিসেবে শাকিব খানকে কতটা নতুনভাবে হাজির করতে পারবেন সেই প্রশ্ন ছিলই। কিন্তু ‘বরবাদ’ দেখার পর সে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকেনি। তিনি শুধু শাকিবকে ‘লারজার দ্যান লাইফ’ ক্যারেক্টারে উপস্থাপন করেননি। বরং তার ভেতরের সত্যিকারের তারকাকে এক নতুন উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন।

বাণিজ্যিক সিনেমা তো এমনই হওয়া উচিত।


Leave a reply